Thank you for trying Sticky AMP!!

বুলবুলের ঝোড়ো দিনে সুন্দরবনে

ঝড়ের জানান দিচ্ছিল মেঘকালো আকাশ। ছবি: লেখক

গহিন সুন্দরবনের খালে চলছিল আমাদের ছোট নৌকা। আমরা চারজন ব্যস্ত পাখির ছবি তুলতে। একটি খয়রাপাখ মাছরাঙার পিছু নিয়েছিলাম। কিন্তু দুষ্টু পাখিটার ভালো একটা ছবি কিছুতেই তোলা যাচ্ছিল না। হঠাৎ মনোযোগে বিঘ্ন ঘটাল গুমোট আবহাওয়া। এতক্ষণ ছবি তোলায় মগ্ন থাকায় চারপাশ কখন অন্ধকার হয়ে এসেছে, খেয়ালই করা হয়নি। মুহূর্তেই শুরু হলো টিপ টিপ বৃষ্টি। ৮ নভেম্বর সকালের কথা এটা।

আমরা তখন সুন্দরবনের হরিণটানা খালে। মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন। জনবিচ্ছিন্ন। নীরব একটা সময়। আবহাওয়ার ছন্দপতনে ভয়ে গা ছমছম সবার। ভাবনা তখন একটাই—এলাম তো আনন্দে, ফিরব কীভাবে? কারণ, আমরা জেনে গেছি, এই রূপ ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের।

বেলা তখন একটা। বনে নামতেই পেলাম ঝড়ের তাণ্ডব–বার্তা। কুয়াশা কিংবা মেঘের আঁধার নেমে এল চারপাশে। অন্ধকার হতে থাকল সুন্দরবন। ভয়ে নৌকা ঘুরিয়ে ফিরে এলাম জাহাজে। নাবিকও শোনালেন ভয়ের বার্তা। এখনই ফেরা দরকার। কিন্তু ভাটার সময় বলে ফেরারও কোনো উপায় নেই। সবাই বুঝে নিলাম, এ যাত্রায় বিপদ অনিবার্য।

যাত্রাসঙ্গী ছিলেন পাবনার বন্য প্রাণিবিষয়ক সংগঠন নেচার অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন কমিউনিটির সভাপতি এহসান বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক শাহ মোহাম্মদ হামিম, সদস্য সুপ্রতাপ চাকী, লিসান আসিফ, কামরুজ্জামান, সাব্বির সজিব এবং এস আর লিটন। সবাই শৌখিন বন্য প্রাণী আলোকচিত্রী। তাই শখের বশে ছয় মাস আগে এই যাত্রার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। জাহাজভাড়াসহ লাখ টাকা খরচ করে সুন্দরবনে ছবি তোলার এক মহাপরিকল্পনা। শতবার বৈঠক, ক্যামেরার কারিশমা। লেন্স জোগাড়, আরও কত কী!

শেষ পর্যন্ত শখের গুড়ে বালি ঢালল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল।

সুন্দরবনের সরু খাল বেয়ে জাহাজে যাওয়ার সময়।

বেলা দুইটা তখন। ভাড়া করা জাহাজে চলছে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন। নদীর হরেক রকম মাছ। কিন্তু মন যেন বসছে না কিছুতেই। তখন নিরাপদে বাড়ি ফেরার চিন্তা। অন্যদিকে শখের ছবি তোলার ইচ্ছাও তো আছে। কখন বৃষ্টি থামবে, কখন ক্যামেরা হাতে আবার নামব বনে। এ তৃষ্ণায় মন উতলা।

কিন্তু প্রকৃতি কোনো অনুভূতিকেই পাত্তা দিতে রাজি নয়। সময় যত যাচ্ছিল ততই যেন বিপদ ঘনিয়ে আসছিল চারপাশে। বাড়ছিল বৃষ্টি, ঝোড়ো বাতাস। বিরূপ হচ্ছিল আবহাওয়া। সন্ধ্যা নামতেই আরও ভয়ংকর হলো সেই রূপ।

সকালে যে পরিষ্কার আকাশ দেখে জাহাজে উঠেছিলাম, তার লেশমাত্র নেই। বনে ঢুকতেই চাঁদপাই রেঞ্জে সঙ্গী হয়েছিলেন বন বিভাগের গানম্যান। শুনেছিলাম, তখন নাকি ছিল ৩ নম্বর বিপৎসংকেত। কথা ছিল বুলবুল ভারতের ওডিশা রাজ্যে আঘাত হানবে। বিধি বাম, সমুদ্রে বেশি সময় অবস্থান করায় আরও শক্তিশালী হয়ে ঝড়টি নাকি গতি পরিবর্তন করে ধেয়ে আসছে সুন্দরবন ও খুলনার দিকে।

এসব ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যায় কটকা সমুদ্রসৈকতের কাছাকাছি আসায় মুঠোফোনের দুর্বল সংযোগ পেলাম। ফোন না এলেও খুদে বার্তা আসছিল তখন। জানা গেল বুলবুলের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে। বুঝতে আর বাকি রইল না, বুলবুল সুন্দরবনে আঘাত হানছে।

জাহাজের সঙ্গে ডিঙি থাকে। নাবিক সগীর আহমেদ, সঙ্গে নৌকার মাছি গাউস উদ্দিন। দুজনই সুন্দরবনযাত্রায় অভিজ্ঞ। ঝড়, বৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাসের মধ্যেই তাঁদের বাস। তাঁরা নাকি ৭ নম্বর বিপৎসংকেতে সুন্দরবনে থেকেছেন অনেকবার। সাহসী সব গল্পে ফিরে পাচ্ছিলাম মনোবল। সফরসঙ্গীরাও কেমন জানি চাঙা হয়ে উঠছিলেন নিমেষে।

তবে সান্ত্বনা মাঝি আর নাবিকের চোখ বলছিল অন্য কথা। রাজ্যের ভয় যেন তাঁদের চোখে।

সবাই মিলে বসলাম জরুরি বৈঠকে। বুঝতে পারলাম বিপদ সন্নিকটে। ততক্ষণে জাহাজের নাবিক দ্বিধান্বিত—উত্তাল নদী পাড়ি দিয়ে ফিরবেন কি ফিরবেন না। নাবিকের দুশ্চিন্তায় আমরাও তখন দ্বিধাগ্রস্ত।

এর মধ্যেই খুদে বার্তা পাঠালেন প্রথম আলোর খুলনার আলোকচিত্রী সাদ্দাম হোসেন। একটাই কথা ছিল, ‘পরিস্থিতি ভালো না, যত দ্রুত সম্ভব ফিরে আসেন।’

কিন্তু বললেই তো আর ফিরে আসা যায় না। অপেক্ষা করতে হবে জোয়ারের। কটকা সমুদ্রসৈকত থেকে কয়েক কিলোমিটার ভেতরে কোনো একটা খালে নোঙর করা জাহাজ। জাহাজের রেডিওতে বার্তা পেলাম সব নৌযানকে সুন্দরবন থেকে পাড়ে ফিরে আসতে হবে। সিদ্ধান্ত হলো ফিরতে হবে তীরে।

ভাবতে ভাবতে রাত ১১টা তখন। সময় যেন কাটছে না। কখন আসবে জোয়ার। থামছে না বৃষ্টির মুষলধারা। বাতাসের বেগ বাড়ছে। উত্তাল হচ্ছে নদী। প্রচণ্ড ঢেউয়ে দুলছে জাহাজ। ভয়ে জড়সড় সফরসঙ্গীরা। ভয় কাটাতে সিদ্ধান্ত হলো গান করার। কিন্তু গলা যেন সায় দিচ্ছিল না তাতে। গিটার হাতে বেসুরো কণ্ঠেই শুরু হলো ভয় কাটানোর গান। রাত গভীর হচ্ছে, কণ্ঠ নুয়ে আসছে সবার। তবু অপেক্ষা জোয়ারের।

রাত তিনটা তখন। নাবিক জানালেন জোয়ার আসছে। ভিতু মনটায় উচ্ছ্বাস দোলা দিল। একদিকে জোয়ার, অন্যদিকে স্রোতের অনুকূলে বাতাস। জাহাজ ছাড়লেন নাবিক। এই বাতাসে এগিয়ে নিতে হবে জাহাজ। কিন্তু আবার বিপত্তি।

তখন সংকেত বেড়ে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত। নাবিকের এককথা, ‘মূল নদী দিয়ে ফেরা সম্ভব না, গেলে জাহাজ চূর্ণ হবে ঢেউয়ের আঘাতে।’

আবার ভয় জেঁকে বসল মনে। ভরসা জাগালেন সঙ্গে থাকা নৌকার মাঝি গাউছ উদ্দিন। মূল নদী নয়, ‘ছোট খাল ধরে ফিরব আমরা।’ গাউছের কথায় প্রাণ ফিরল আবার।

আমরা বসলাম কাগজের মানচিত্র আর কম্পাস নিয়ে।

ভোর চারটা তখন। উত্তাল ঢেউ আর প্রচণ্ড ঝোড়ো বাতাসে অস্থির হতে শুরু করেছে সুন্দরবন। কাগজে আঁকা মানচিত্র দেখে এগিয়ে চলছে আমাদের জাহাজ। নতুন পথে বারবার আলো জ্বেলে পথ খুঁজছেন নাবিক।

শেলা নদী পার হয়ে আমাদের জাহাজ তখন পশুর নদের কাছাকাছি। ঢেউয়ের তালে লাফিয়ে চলছে যানটি। মনে হচ্ছিল কখন যেন উল্টে যাবে। লাইফ জ্যাকেট গায়ে যেকোনো বিপদ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত ছিলাম আমরা।

প্রচণ্ড বৃষ্টি। উত্তাল পশুর নদ। ঘুরতে ঘুরতে জাহাজ এল আন্ধারমানিকে। নির্জন অন্ধকার কাটিয়ে তখন ৯ নভেম্বর ভোর। চোখ মেলতেই দেখা গেল উপকূলের বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে ছোটার দৃশ্য। উদ্ধার তৎপরতায় ব্যস্ত কোস্টগার্ড সদস্যরা। টানা ১২ ঘণ্টা পর আবার প্রিয় ক্যামেরা হাতে নিলাম।

ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে ঝড়ের তাণ্ডব। প্রতিকূলতার মধ্যেও বাদ যায়নি ছবি তোলা। দেখছিলাম উপকূলের মানুষের নিরাপদে যাওয়ার আকুতি। ক্যামেরায় ধারণ করা দৃশ্যগুলোর ফল পেলাম পরের দিন প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায়। ১২ ঘণ্টার অস্থির যাত্রার প্রাপ্তি মিলল সেখানেই।

আমরা তখন নিরাপদ। যেন নতুন জীবন পেলাম। সঙ্গীদের একজন তাই বলে উঠলেন, ‘রাতে গিটার বাজিয়ে গানের সময় টাইটানিক সিনেমার কথা খুব মনে পড়েছিল। জাহাজ ডোবার সময় সেই ছবিতেও এভাবে গান হয়েছিল সাহস জোগাতে। ভেবেছিলাম, হয়তো সেই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হবে। এ গানই জীবনের শেষ!’

আমরা নিরাপদে ফিরেও পরে দেখেছি সুন্দরবনের ক্ষতির চিত্র। বুক দিয়ে আমাদের রক্ষা করেছে সুন্দরবন।

লেখক: প্রথম আলোর আলোকচিত্রী, পাবনা