Thank you for trying Sticky AMP!!

বেড়ে উঠেছি নজরুল পরিবারে

কবি ভবনে (বাঁ দিক থেকে) উমা কাজী, মিষ্টি কাজী, কাজী নজরুল ইসলাম, বাবুল কাজী ও খিলখিল কাজী। ছবি: সংগৃহীত

ছোটবেলায় যখন স্কুলে যেতাম, তখন অবাক হতাম। কারণ, দেখতাম, আমার দাদুর লেখা কবিতা স্কুলে পড়ানো হচ্ছে! স্কুলে সবাই আমাকে একটু আলাদা চোখে দেখত, কদর করত। দেশের বিখ্যাত মানুষজন প্রতিনিয়ত বাসায় আসতেন। পুরো বিষয়টা বুঝে উঠতে পারতাম না। একদিন বাবার (কাজী সব্যসাচী) কাছে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, কেন এ রকম হচ্ছে। বাবা একটু হেসে আমাকে বোঝালেন যে আমার দাদু হচ্ছেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি, যিনি বাঙালির অধিকারের জন্য আজীবন কথা বলেছেন। লেখনীর মাধ্যমে মানবতার কথা বলেছেন, সর্বস্তরের মানুষের কথা বলেছেন। তিনিই নানাভাবে দেখিয়েছেন, আগে মানুষ, পরে ধর্ম। তিনিই লিখেছেন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, অন্যায়-শোষণ-অবিচারের বিরুদ্ধে। দাদুকে ছোট থেকেই দেখে আসছি কিন্তু তাঁকে প্রথম চিনেছি সেদিন।

খিলখিল কাজী। ছবি: অধুনা

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দাদুকে বাংলাদেশে নিয়ে এলেন এবং বিশাল একটি বাড়ি দিলেন। সেই বাড়িতেই দাদুর সঙ্গে থাকতাম আমরা। বাড়িটিতে বড় একটি ফুলের বাগান ছিল। দাদু এই বাগানে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতেন। আমার মা (উমা কাজী) দাদুর খাওয়াদাওয়া, অক্সিজেন, ওষুধ, বাইরে যাওয়াসহ সবকিছুর খেয়াল রাখতেন। দাদুও মাকে অনেক আদর করতেন। দাদু কারও কথা বলতে পারতেন না; কিন্তু আমরা যখন কথা বলতাম বুঝতেন এবং ইশারায় আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন।
দাদু বাইরে ঘুরতে যেতে খুব ভালোবাসতেন। আমরা মাঝেমধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে দাদুর সঙ্গে ঘুরতে যেতাম। দাদু প্রকৃতির কাছে থাকা এই সময়টা খুবই উপভোগ করতেন। ওখান থেকে ফিরে আসতে চাইতেন না। শিশুর মতো জেদ করতেন। বেশি সময় ঘোরাঘুরি করতে চাইতেন।
বাবা দাদুর সামনে মাঝে মাঝেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন, আমরাও শুনতাম। এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করত। বাসায় ফিরোজা বেগম থেকে ইন্দু বালা, সুপ্রভা সরকার থেকে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় দাদুর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, গান শোনাতেন দাদুকে। তাঁদের সঙ্গে আমরা ছোটরা গলা মেলাতাম। দাদু এই সময়ে মিষ্টি একটা হাসি দিতেন, যা এখনো আমার স্মৃতিপটে খোদিত রয়েছে। বাসায় প্রায় সব সময় গান হতেই থাকত। বিখ্যাত শিল্পীরা গান গাইতেন, বাবা আবৃত্তি করতেন, আমরা ছোটরা গান গাইতাম, দাদু খুবই উপভোগ করতেন। আমার নিজের সংগীতচর্চাও অনেকটা এভাবেই শুরু। এরপর বাবা আমাদের ছোটদের গান শেখাতেন। নিজেরও দাদুর লেখা, সুর করা গান গাইতে ভালো লাগত।
দাদুর ১১৭তম জন্মলগ্নে এসে মনে পড়ছে, দাদু বেঁচে থাকা অবস্থায় পালন করা জন্মদিনগুলো। দাদুর জন্মদিনে আমাদের বাড়িতে লোকে-লোকারণ্য থাকত। ক্রিস্টোফার রোডে বিরাট একটা তোরণ বানানো হতো। দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ দাদুকে দেখতে আসতেন। বাড়িটা ফুলে ফুলে ভরে যেত। দাদু যে বিছানায় শুয়ে থাকতেন, সেই বিছানা ফুলে ভর্তি হয়ে যেত। আমার বোন মিষ্টিসহ আমাদের ছোটদের কাজ ছিল দাদুর বিছানা ফুলে ভরে গেলে ফুলগুলো সরিয়ে অন্যদের ফুল দেওয়ার জন্য জায়গা তৈরি করা। দাদুকে এসে সবাই শুভেচ্ছা জানাতেন, আমরা দাদুর দিকে তাকিয়ে থাকতাম এবং তাঁর অভিব্যক্তি দেখতাম।
বাবা আমাদের সব সময় দাদুর লেখা পড়ে শোনাতেন। দাদুর গল্প বলতেন। দাদুর চিন্তা-ভাবনা আমাদের বোঝাতেন। দাদুর জেলে থাকার সময়কার ঘটনা, লেখালেখি, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে দাদুর প্রকাশ্য বিদ্রোহ, দাদুর বিদ্রোহী কবিতা, বাঙালিদের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার লক্ষ্যে দাদুর আন্দোলনের বর্ণনা বাবার কাছ থেকে শুনতাম আমরা। দাদুর লেখা পড়তাম, দাদুর গান গাইতাম, দাদু সম্পর্কে আরও বেশি জানার চেষ্টা করতাম। দাদুর আশপাশে থেকেই বড় হয়েছি, সারা জীবন দাদুর অসাধারণ কর্মকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করার চেষ্টা করেছি।
আমার নিজেকে খুবই ভাগ্যবান একজন মানুষ মনে হয়। কারণ, আমি এ রকম অসাধারণ একজন মানুষের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। তিনি বাঙালি জাতির গর্ব। প্রত্যাশা থাকবে তরুণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দাদুকে নিয়ে আরও বেশি চর্চা করবে।
(অনুলিখিত)
খিলখিল কাজী: কাজী নজরুল ইসলামের নাতিন