Thank you for trying Sticky AMP!!

বোন (মাঝে) ও মায়ের সঙ্গে তানজিলা তারতুসী

বোনের জন্য শিখেছি ইশারা ভাষা

যারা কানে শুনতে পায় না, তারা কথাও বলতে পারে না। এমন মানুষের যোগাযোগের জন্য দরকার পড়ে একটি বিশেষ ভাষা। যে ভাষায় সে তার মনের ভাব প্রকাশ করবে; সেই ভাষার নামই হচ্ছে ইশারা ভাষা। তবে আমি স্বাভাবিক মানুষ হয়েও এই ভাষা শিখেছি আমার প্রয়োজনে। খানিকটা আমার বোনের প্রয়োজনেও। আমার বড় বোন তাসনিয়া তারতুসী একজন বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী। যার সঙ্গে আমি ছোটবেলা থেকে কথা বলতাম, আমাদের নিজস্ব ইশারা ভাষায়।

বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের যোগাযোগের জন্য ইশারা ভাষা সারা বিশ্বেই জনপ্রিয়। আজ আন্তর্জাতিক ইশারা ভাষা দিবস। তবে বাংলাদেশে আলাদাভাবে ‘বাংলা ইশারা ভাষা দিবস’ ৭ ফেব্রুয়ারি পালন করা হয়। অনেকেই মনে করেন, ইশারা ভাষা মূলত সারা বিশ্বে একই রকম। সেটা কিন্তু ভুল ধারণা। বাংলা, হিন্দি, চীনা বা স্প্যানিশ যেমন একেক দেশের স্থানীয় ভাষা, ইশারা ভাষারও তেমন অঞ্চলভেদে ধরন আছে ভিন্ন ভিন্ন। তবে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে অনেক বিদেশির সঙ্গে যোগাযোগে আমরা যেমন ইংরেজি শিখি, ইশারারও তেমন একটি স্বীকৃত আন্তর্জাতিক রূপ আছে। বাংলার মধ্যে যেমন অনেক দেশের ‘কমন’ শব্দ আছে, ইশারা ভাষাতেও তেমন আছে।

তাই বোনের সঙ্গে আমি ছোটবেলায় যে ইশারায় কথা বলতাম, সেটা ছিল আমাদের নিজস্ব আবিষ্কার। এরপর সে যখন স্কুলে ভর্তি হলো, তখন বিষয়টি আমরা বুঝতে শিখলাম। তার প্রথম স্কুল ছিল হাইকেয়ার। সেখানে লিপ রিড করে পড়ানো হতো। তবে সে যখন সপ্তম শ্রেণিতে স্কুল বদলে ঢাকা বধির স্কুলে ভর্তি হলো, তখন সেখানে শেখানো হলো বাংলার প্রাতিষ্ঠানিক ইশারা ভাষা (সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ)। সে স্কুলে, বন্ধুদের কাছে নতুন যেসব ভাষা শিখে আসত, আমাকে সেটা বোঝাত। আমিও তার ও আমার যোগাযোগের সুবিধার জন্য সেটা শিখে নিতে লাগলাম। এভাবে আমি স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই বাংলা ইশারা ভাষা রপ্ত করলাম। বোনের যেসব বন্ধু আমাদের বাসায় আসত, তারাও আমাকে আদর করত। কারণ, আমি তাদের ভাষা বুঝি। তারা আবার নানাভাবে আমার পরীক্ষা নিত।

অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর আমি মায়ের উৎসাহে ২০১৪ সালে এসডিএসএল নামের একটি প্রতিষ্ঠানে গেলাম ইশারা ভাষার একটি সংক্ষিপ্ত কোর্স করতে। কোর্স শেষে তারা আমাকে তাদের কয়েকটি অনুষ্ঠানে ইশারায় উপস্থাপনার সুযোগ করে দিল। এরপর ঢাকা বধির সংস্থা থেকে একটি সরকারি প্রশিক্ষণ কোর্স করলাম। আবেদন করলাম বিটিভিতে, ইশারা ভাষার সংবাদপাঠক বিভাগে। নানা রকম পরীক্ষা দিয়ে ২০১৭ সালে নির্বাচিত হলাম বিটিভির তালিকাভুক্ত ইশারা ভাষার সংবাদপাঠক হিসেবে। এখন নিয়মিত সংবাদ পড়ি দেশের নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য। যারা মুখে কথা বলতে পারে না।

বিটিভিতে ইশারা ভাষায় খবর পড়ছেন তানজিলা (নীচে)

একই সঙ্গে আরেকটি মজার বিষয় হচ্ছে, আমার মা ইসরাত জাহানের চেষ্টায় আমার বড় বোনও উচ্চশিক্ষা শেষ করে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির ড্রয়িং শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয় ২০১৭ সালে। পাশাপাশি এখন নতুন করে সে যুক্ত হয়েছে গ্রামীণফোন অ্যাপের ইশারা ভাষার কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধি হিসেবে। এই কাজে যুক্ত আছে তাঁর শ্রবণপ্রতিবন্ধী স্বামীও।

ইশারা ভাষা একদিক থেকে বেশ সুবিধার। আপনি যখন অনেক মানুষের মধ্যে আলাদাভাবে কাউকে কিছু বলতে চান, সে যদি ইশারা বোঝে, তাহলে শব্দ ছাড়াই সহজে বলে ফেলতে পারবেন। পরিবারে বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী কেউ থাকলে তার পাশাপাশি অন্যরাও ভাষাটা শিখে নিলে জীবনযাপন সহজ হয়ে যায়। দেশে খুব কম জায়গাতেই ইশারা ভাষা শেখার সুযোগ আছে। তবে আমি মনে করি, চাইলেই সুযোগ সৃষ্টি হয়। এখন তো প্রধানমন্ত্রীর প্রায় সব অনুষ্ঠানেই এক বা একাধিক ইশারা ভাষার উপস্থাপক থাকেন। আমরাও এমন অনুষ্ঠানে যাই বিটিভি থেকে। নানা দেশের মানুষের সঙ্গে কথা হয় ইশারা ভাষায়। সেটাও একধরনের ভাষা শেখার আনন্দ। দেশে ইশারা ভাষা শেখার আরও সুযোগ তৈরি হওয়া জরুরি।

তানজিলা তারতুসী : বিটিভির ইশারা ভাষার সংবাদপাঠক