Thank you for trying Sticky AMP!!

ভোজ্যতেল কলে দুস্থদের মুখে হাসি

চুইয়ে পড়ছে সরিষার তেল। ছবি: খালেদ সরকার

কাঠের তৈরি ঘানি। সেই ঘানিটা ঘোরাচ্ছে কলুর বলদ। ধীরে ধীরে মাটির পাত্রে চুইয়ে পড়ছে সরিষার তেল। তবে গ্রামবাংলার এই অতি পরিচিত দৃশ্যটি এখন খুব একটা চোখে পড়ে না। বৈদ্যুতিক যন্ত্রেই করা হয় তেল ভাঙানোর কাজ। অবাক করার বিষয় হলো, ঠিক এমন একটি ভোজ্যতেলের কল রয়েছে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে। যেখানে বড় বড় দালানে থাকা দোকানপাটের মধ্যে একতলা এই তেল ভাঙানোর কারখানা। শুধু কি তাই? এই তেলকলের বদৌলতে পাশের রাস্তাটিও মানুষ চেনে ‘ভোজ্যতেলের গলি’ হিসেবে। আর এই কলের সব আয় খরচ করা হয় দাতব্য কাজে।
এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যালের পাশেই ‘ভোজ্য তেলকল’ নামের তেলের কারখানাটি। তবে কখন যে গলিটার নাম ভোজ্যতেলের গলি হলো, তা ঠিক করে বলা মুশকিল। স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই তেলকল প্রতিষ্ঠার পরই খাঁটি সরিষার তেলের খোঁজে আসা মানুষের মুখে গলিটা ভোজ্যতেলের গলি বলে পরিচিতি পায়।
৯ অক্টোবর বিকেলে সেখানে গিয়েই দেখা গেল, কারখানায় তেল ভাঙার কাজ চলছে। তেলকলটি ঘুরে দেখালেন হেলাল উদ্দিন। এই কারখানার কর্মী তিনি, বছরখানেক হয় কাজ করছেন। কারখানাটির আয়তন খুব একটা বড় নয়। সেখানেই পাশাপাশি ১০টা তেল ভাঙানোর কল বসানো। কলের ঘানিগুলো একসঙ্গে ঘুরছে, সবগুলোতেই ভাঙানো হচ্ছে সরিষার তেল।

সরিষা ভাঙার কাজ করছেন একজন

কর্মীদের কাছেই জানা গেল, প্রতিটা ঘানিতে একবারে ১০ কেজি সরিষা ভাঙানো হয়। ঘানির পাশেই একটি ফিল্টারে সে তেল ছেঁকে পরিষ্কার করা হচ্ছে। এরপর তেল ভরা হচ্ছে বড় একটি ড্রামে। এখান থেকেই ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে খাঁটি সরিষার তেল। তেলকলটিতে কর্মরত শ্রমিক হেলাল উদ্দিন বলেন, সরিষার পাশাপাশি তিল এবং কালোজিরার তেলও ভাঙানো হয় এখানে। তবে সেগুলোর চাহিদা কম হওয়ায় এক বা দুবার ভাঙালেই সারা বছর পার হয়ে যায়।
একতলা ভবনের এই ভোজ্যতেল কলের আশপাশে ঘরের পর্দা, বিছানার চাদর, ম্যাট্রেস, বাসনকোসনের ঝাঁ চকচকে সব দোকান আর বড় বড় দালান। এসবের মধ্যেই টিকে আছে কলটি।

রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের এই ভবনে সেই তেলকল

খাঁটি হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে এখানকার তেলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কারখানার ব্যবস্থাপক মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, প্রতিদিন ১০-১৫ মণ সরিষা ভাঙানো হয় এখানে। উৎপাদিত সব তেলই খুচরা বিক্রি হয়।
খাঁটি সরিষার তেল পেতে প্রতিদিন এখানটায় ভিড় করেন ক্রেতারা। এখান থেকে নিয়মিত তেল কেনেন ৭০ বছর বয়সী আবুল খায়ের। এখানে এসে কেন তেল কেনেন? তিনি বলেন, ‘কলটি ঘরের কাছেই এবং চোখের সামনেই তেল ভাঙানো হয়। তাই বিশ্বস্ততা আছে। তা ছাড়া এই টাকাগুলো এতিমদের জন্য ব্যয় হয়। নিজের কাছেও ভালো লাগে, ভালো কাজে আমরাও পরোক্ষভাবে কিছুটা সাহায্য করতে পারছি।’

লাভের অর্থ পান দুস্থরা
প্রায় ৪৫ বছর আগে সাবেক শিক্ষাসচিব মো. ইরশাদুল হকের হাত ধরেই যাত্রা শুরু তেলকলটির। শুরুতে যন্ত্রগুলোকে যেভাবে বসানো হয়েছিল, এখন অবধি ঠিক সেভাবেই আছে। তেলকলটি সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল অন্য তথ্য। এই তেলকল থেকে যে আয় হয়, তার পুরোটাই চলে যায় দাতব্য সংগঠন আবেদা–নূর ফাউন্ডেশনে। ব্যয় হয় গ্রামীণ বিত্তহীন, এতিম ও দুস্থদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায়।

সব তেলই খুচরা বিক্রি হয়

শুরুর দিকে এখানে যা আয় হতো, তা দিয়ে সাহায্য করা হতো গ্রামের অসহায় ও দুস্থ মানুষদের। ১৯৯২ সালে তেলকলটির মালিক ইরশাদুল হক কুমিল্লার চান্দিনায় তাঁর নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন দাতব্য সংগঠন আবেদা–নূর ফাউন্ডেশন। এই সংগঠনের অধীনে বর্তমানে একটি হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদসহ মোট ১১টি সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান চলে।
জীবদ্দশায় এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেই দেখভাল করতেন ইরশাদুল হক। বছর দুয়েক হলো গত হয়েছেন তিনি। এখন এই সংগঠনের দেখাশোনা করছেন ইরশাদুল হকের বড় মেয়ে ও সংগঠনটির চেয়ারম্যান নাশেতা নাহরীর হোসাইন। মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর আগে আমার বাবা এই তেলকলসহ তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দান করে গেছেন এই দাতব্য সংগঠনে। আর সেই টাকা দিয়েই চলে দুস্থ-এতিম ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, খাওয়া, মসজিদ-মক্তব আর হাসপাতাল।’