Thank you for trying Sticky AMP!!

মানবতার আরেক নাম মারোত

>
মারোতের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত
মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন—মানসিক রোগীদের তহবিল বা মারোত। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় মানসিক রোগী পেলেই সংগঠনের সদস্যরা পাশে দাঁড়ান। অসহায়দের যত্নআত্তি ছাড়াও হারিয়ে যাওয়া মানুষকে পৌঁছে দেন পরিবারের কাছে।

সন্দেহটা দানা বেঁধেছিল দেশজুড়েই। ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে তখন প্রায় গণপিটুনির ঘটনা ঘটছিল। কক্সবাজারের টেকনাফেও ঘটেছিল এমন একটি গণপিটুনির ঘটনা। 

সেটা গত ২৬ জুলাইয়ের কথা। টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে অস্বাভাবিকভাবে ঘুরতে দেখে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকে ছেলেধরা বলে সন্দেহ করে স্থানীয় মানুষ। একান–ওকান ঘুরে রীতিমতো গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। কয়েকজন অতি উৎসাহী মানুষ ছুটে যায় নারীকে মারতে। সেই খবর থানায় পৌঁছালে টেকনাফ থানার পুলিশ দ্রুত ছুটে আসে। মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকে উদ্ধার করে। থানাতেই কাটতে থাকে সেই নারীর দিন। পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও তাঁর অভিভাবক খুঁজে না পেয়ে যোগাযোগ করে ‘মারোত’-এর সঙ্গে। 

মারোত বা মানসিক রোগীদের তহবিল। মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। কক্সবাজারের টেকনাফে মানসিক রোগী পেলেই পাশে দাঁড়ান সংগঠনের সদস্যরা। মারোতের সভাপতি আবু সুফিয়ান শোনাচ্ছিলেন সেদিনের কথা, ‘আমাদের তিনজন সদস্য ওই নারীর কাছে যায়। দফায় দফায় কথা বলেও তাঁর পরিচয় শনাক্ত করতে পারে না। তিনি এতই অসুস্থ ছিলেন, অধিকাংশ তথ্য এলোমেলোভাবে দিচ্ছিলেন।’

তবে তাঁর কথায় গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের জিয়ানগরের পাড়েরহাটে বলে একাধিকবার ঘুরেফিরে আসে। তখন মারোতের সদস্যরা জিয়ানগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সহায়তায় স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর ছবি, ভিডিও আদান-প্রদানের মাধ্যমে ওই নারীর পরিচয় উদ্​ঘাটন করতে সক্ষম হন। জানা যায়, এই নারীর নাম শাহেদা আক্তার। ৪৫ বছর বয়সী এই নারী প্রায় ১০ বছর ধরে ঘরছাড়া। মা শাহেদা আক্তারকে নিতে দুই সন্তান মোহাম্মদ সাইফুল ও মোহাম্মদ সজীবুল আসেন টেকনাফে। ৩০ জুলাই রাতে দুই ছেলের হাতে টেকনাফ মডেল থানার পুলিশ তাঁকে হস্তান্তর করে। হাসি ফোটে মারোত সদস্যদের মুখে। 

শাহেদা আক্তারকে সন্তানদের হাতে তুলে দেওয়ার দিন।

এমন আনন্দের ঘটনা মারোত সদস্যদের জীবনে আগেও এসেছিল। কারণ, শাহেদা আক্তারের মতো পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া ২০ জন মানসিক রোগীকে বিভিন্ন সময়ে তাঁদের নিকটাত্মীয়-স্বজনের কাছে তুলে দিয়েছেন। এই মানসিক রোগীদের কেউ কেউ নিখোঁজ ছিলেন ২ থেকে ১৬ বছর। ব্যতিক্রমী এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাজ টেকনাফে তাই বেশ আলোচিত।  

সংগঠনের শুরুটা কীভাবে? প্রশ্ন শুনে, প্রতিষ্ঠার শুরুর গল্প শোনালেন মারোতের সাধারণ সম্পাদক রাজু পাল, ‘একদিন দুপুরে খাবার শেষ করে উচ্ছিষ্ট বাইরে ফেলামাত্র দেখি একজন মানসিক রোগী (পাগল) দৌড়ে এসে খাবারগুলো খাচ্ছেন। এ দৃশ্য দেখে ভীষণ মর্মাহত হলাম। এরপরই সিদ্ধান্ত নিলাম নিজের খাবারের একটি অংশ আশপাশের কোনো একজন মানসিক রোগীকে খেতে দিব।’ ঘটনাটি সাত-আট বছর আগের। এভাবে চলল কিছুদিন। এরপর তিনি চিন্তা করলেন, মানসিক রোগীদের জন্য কিছু একটা করা দরকার। সেই ‘কিছু করার’ তাগিদে পাশে পেলেন সুমন নামে তাঁর এক বন্ধুকে।

শুরু হলো মানসিক রোগীদের জন্য সাধ্যের মধ্যে সেবা কার্যক্রম। পাগলদের প্রতি তাঁদের অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখে আশপাশের টেকনাফের লামার বাজারের দোকানিরাও এগিয়ে এলেন। আগে যাঁরা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতেন, তাঁরাই কেউ চা-নাশতা, কেউ ভাত, কেউ কাপড়, কেউবা আবার চুল-দাড়ি কেটে যথাসাধ্য সেবা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। অনেকে আশ্রয় পেলেন বিপণিবিতানের খোলা জায়গায়।

রাজু পাল বলেন, ‘কিছুদিন পর এ ক্ষুদ্র কাজ বৃহৎ পরিসরে করার চিন্তা করলাম। কাজটি যেহেতু একার পক্ষে সম্ভব নয়, তাই বিষয়টি নিয়ে সন্তোষ কুমার শীল, আবু সুফিয়ান, ঝুন্টু বড়ুয়াসহ কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর সঙ্গে আলাপ করলাম। এভাবে আমরা ২০ জন একত্র হয়ে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে মানসিক রোগীদের তহবিল (মারোত) সূচনা করি। তবে সংগঠনটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ২০১৭ সালে।’ 

সেই থেকে সংগঠনটি মানসিক রোগীদের সেবা-শুশ্রূষাসহ খাবার বিতরণের জন্য মাসে অন্তত দুবার পথে বের হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব তো বটেই, জাতীয় দিবসেও আয়োজন করে ভালো খাবারের, হাতে তুলে দেয় নতুন পোশাক। যেমনটি তারা করে তীব্র শীতের সময়, শীতবস্ত্র বিতরণের মাধ্যমে। 

শুধু খাবার আর পোশাকের উষ্ণতা নয়, অসহায় মানসিক রোগীদের মধ্যে ভালোবাসার উষ্ণতাটাই ছড়িয়ে যাচ্ছেন মারোতের সদস্যরা। তাই তো মারোত হয়ে উঠেছে মানবতার আরেক নাম।