Thank you for trying Sticky AMP!!

মানবপুঁজির বিকাশে শিক্ষার অবদান গুরুত্বপূর্ণ : স্যার ফজলে হাসান আবেদ

>২০ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেছেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বাংলাদেশের মানুষের শিক্ষা নিয়ে তাঁর অনেক স্বপ্ন ছিল। কাজও করেছেন বিস্তর। গত বছর প্রথম আলোর ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একটি বিশেষ রচনা লিখেছিলেন তিনি। সেখানে উঠে এসেছিল শিক্ষা নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথা। আজ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই লেখাটি আবার প্রকাশিত হলো।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ মনে করতেন, আনন্দঘন শিক্ষা-পরিবেশ তৈরি হলে শিক্ষার্থীরা আত্মবিশ্বাসী ও সৃজনশীল হয়ে উঠবে। ছবি: সংগৃহীত

২০৩০ সালের মধ্যে উপনীত হওয়ার জন্য যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য আমরা স্থির করেছি, তার প্রথম অভীষ্ট হচ্ছে চরম দারিদ্র্য নির্মূল করা। উল্লেখ্য, মানব ইতিহাসে এই প্রথম আমরা চরম দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করছি। মানবপুঁজির বিকাশে প্রকৃত বিনিয়োগ বলতে কী বোঝায়, সে বিষয়ে আমাদের স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার। এই বিনিয়োগ বলতে নতুন নতুন স্কুল বা হাসপাতাল তৈরি কিংবা বেকার যুবসমাজের জন্য আরও বেশি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করার মতো যান্ত্রিক কার্যক্রমকেই বোঝায় না। প্রকৃত মানবপুঁজি বিকাশের উদ্যোগ হবে সেটাই, যা নাকি মানুষকে সৃজনশীল ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে সহায়তা করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই, পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা সুপ্তই থেকে যায়।

সম্প্রতি পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ টোগোর উদ্যোক্তাদের জন্য মনোবিজ্ঞানভিত্তিক ‘ব্যক্তিগত প্রচেষ্টামূলক প্রশিক্ষণ’ বিষয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে যে ব্যবসায় মুনাফা লাভের ‌ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্যবসায় প্রশিক্ষণের চেয়েও এটি অধিকতর ফলপ্রসূ হয়েছে। আত্মবিশ্বাস যত বাড়ানো যাবে, তার ফলও তত বেশি পাওয়া যাবে। উগান্ডায় কিশোরীদের জন্য পরিচালিত ব্র্যাকের একটি কর্মসূচিতে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি জীবনদক্ষতা, পারস্পরিক আদান–প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষা, প্রজননস্বাস্থ্য এবং আবেগজনিত ইস্যুগুলো যুক্ত রয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, যেসব গ্রামে কিশোরী ক্লাব রয়েছে, সেখানকার মেয়েদের আয় অন্য গ্রামগুলোর তুলনায় ৪৮ শতাংশ বেশি। উল্লেখ্য, নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে আত্মপ্রত্যয় জাগিয়ে তোলার প্রয়াস ছাড়া শুধু উপার্জনমূলক কাজের প্রশিক্ষণ দিলে তা তেমন সুফল বয়ে আনে না।

আমাদের অতিদরিদ্র কর্মসূচির ‘গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম’-এর সঙ্গে যুক্ত প্রান্তবাসী মানুষ, যারা স্বল্প পরিমাণ খাবার খেয়ে জীবন ধারণ করে, তাদের টেকসই জীবিকার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে সহায়তা করা হচ্ছে। এই কর্মসূচি দরিদ্র পরিবারগুলোকে নগদ অর্থ ও গরু–ছাগল দিচ্ছে কিংবা অন্য কোনো উপার্জনমূলক সম্পদ হস্তান্তর করছে। সেই সঙ্গে প্রত্যেককে জীবিকাসহায়ক প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে এবং প্রা‌ন্তিক নারীরা যে হাজারো সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হয়, তার মোকাবিলায় সহমর্মী ভূমিকা পালন করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দরিদ্র নারীদের কেবল সম্পদ আর প্রশিক্ষণ দিলে তা থেকে আশানুরূপ সাফল্য আসে না। প্রকৃত পরিবর্তন তখনই ঘটে, যখন ব্যক্তিগতভাবে পাশে দাঁড়িয়ে সমস্যা সমাধানের পথ দেখিয়ে তাদের মনে আশাবাদ ও আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা যায়। আমি মনে করি, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ শীর্ষক সরকারি প্রকল্পটির আওতাভুক্ত অংশগ্রহণকারীরা আরও সফল হতে পারতেন, যদি এই প্রকল্পের মধ্যে আত্মপ্রত্যয় ও আশাবাদ জাগিয়ে তোলার উপকরণগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকত।

বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে কয়েক দশক ধরে আমরা কাজ করছি। আমাদের এখানে স্বাস্থ্য পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নতি হয়েছে। ৪০ বছর আগে যেখানে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের প্রতি ৪ জনে ১ জন মৃত্যুবরণ করত, এখন সেই হার প্রতি ১ হাজারে ৪০ জনে নেমে এসেছে। শুধু আরও বেশি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এটি সম্ভব হয়েছে, তা কিন্তু নয়। এটা সম্ভব হয়েছে এ কারণে যে বিভিন্ন স্বাস্থ্য কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দরিদ্র মানুষ পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যসেবায় সচেতন হয়ে উঠেছেন। খাওয়ার স্যালাইনের মতো কর্মসূচি এ ক্ষেত্রে একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই কর্মসূচির মাধ্যমে মায়েদের খাওয়ার স্যালাইন তৈরির প্রক্রিয়া শেখানো হয়েছে। অন্যদিকে দেশে বড় আকারে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালিত হয়েছে। শিশুদের টিকা দেওয়ার সুফল সম্পর্কে মা–বাবাকে সচেতন করে তোলা হয়েছে। ফলে টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিপুল চাহিদা ও আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ফলত দেশে শিশুমৃত্যুর হার ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এভাবে মানবপুঁজির বিকাশে আমরা বিনিয়োগের আরও সুযোগ সৃষ্টি করতে পারি।

মানবপুঁজির বিকাশে শিক্ষার অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার মান যদি বাড়ানো না যায়, তাহলে নতুন নতুন স্কুল তৈরি করে জাতির শিক্ষাব্যবস্থার সামান্যই উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। শিক্ষা যদি মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে তার ব্যর্থতা অনিবার্য। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাধারণত এটাই ঘটে থাকে। আমরা শিক্ষার্থীদের আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠতে সহায়তা করতে পারছি না। একজন শিল্পী বা ভাস্কর যেভাবে চিত্রাঙ্কন করেন অথবা ভাস্কর্য তৈরি করেন, একজন শিক্ষক সেভাবে তাঁর শিক্ষার্থীদের তৈরি করতে পারেন না। ব্রাজিলীয় শিক্ষাবিদ পাওলো ফ্রেইরি বলেছিলেন, ‘প্রকৃত শিক্ষা শিক্ষার্থীর সামর্থ্যের বিকাশ ঘটিয়ে, তাকে স্বাধীন ও সৃজনশীলভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা দিয়ে তার নিজস্ব সত্তাকে জাগিয়ে তুলতে পারে।’ আমাদের শিক্ষাঙ্গনে এই অনুশীলনগুলো আমরা চালু করতে পারিনি। যদি এটা চালু করা সম্ভব হয় এবং শ্রেণিকক্ষে আনন্দঘন শিক্ষা-পরিবেশ তৈরি করা যায়, তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীরা আত্মবিশ্বাসী ও সৃজনশীল হয়ে উঠবে এবং দেশ ও জাতিকে উন্নতির পথে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে।

আমরা যদি আত্মবিশ্বাস ও সামর্থ্যের বিকাশে বিনিয়োগ করার জন্য নীতিনির্ধারকদের প্রতি আহ্বান জানাই, তাহলে আপাতভাবে তাকে অস্পষ্ট ও দুর্বল আবেদন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এটি মোটেও তা নয়। বহু যুগ ধরে মানুষ বিশ্বাস করে এসেছে, দারিদ্র্য নিয়তির দান, চন্দ্র–সূর্যের মতোই তা অপরিবর্তনীয়। এটি শুধুই একটি কল্পকথা। প্রমাণিত সত্য হলো এই, যদি কোনো দেশ মানুষের মনে আশা এবং নিজেদের সামর্থ্যের ওপর আস্থা জাগিয়ে তুলতে পারে, তাহলে মানবসম্পদ বিকাশে তার চেয়ে বড় বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না।

ঈষৎ সংক্ষেপিত