Thank you for trying Sticky AMP!!

মিতির ফেরা

অলংকরণ : মাসুক হেলাল

‘কেমন আছ ফড়িং আপু?’
মেসেজটা দেখে বুকটা ধক করে কেঁপে উঠল। ‘ফড়িং’ নামে একমাত্র মিতিই আমাকে ডাকত। কিন্তু নামটা দেখি ‘সাজিদা চৌধুরী’। কৌতূহলী হয়ে মেসেঞ্জারে কল করে বসি। ফোনের ওপারে চিরচেনা কণ্ঠ। অবাক হয়ে যাই আমি। ২০১১ সালের পর থেকে যাকে খুঁজছি, সেই মিতির সঙ্গে কথা বলছি! মুহূর্তে রাশি রাশি প্রশ্ন ছুড়ে দিই ওর দিকে।

মিতির সঙ্গে আমার পরিচয় ২০০৭ সালে। একটা খ্যাতনামা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ নির্বাহী হিসেবে কাজ করি তখন। আমার এক মাস পর যোগ দেয় মিতি। মেধাবী, চঞ্চল আর কর্মঠ মেয়েটার সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে সময় লাগেনি। একসঙ্গে কত সময় কাটাতাম। এমনই একদিন সে ভীষণ খুশি আর আনন্দমাখা মুখ নিয়ে আমার কাছে এল। টেনে নিয়ে গেল কফি লাউঞ্জে। একটা চেয়ারে বসিয়ে জানাল, আমাদেরই প্রতিষ্ঠানের এক কর্তাব্যক্তির সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে।

আবার সেই মিতিই দুই সপ্তাহ পর আমার ডেস্কে এসে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, তার হবু বর লন্ডন যাচ্ছেন তিন মাসের একটা কোর্সে। চঞ্চলা, ফুরফুরে, সারাক্ষণ মুখে কথা ফোটা মিতির মনটা একেবারে শ্রান্ত পাতার মতো ঝিমিয়ে গেল যেন।

ভদ্রলোক লন্ডনে চলে গেলেন। আরও দুই মাস পর জানলাম লোকটা যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছেন। মিতি তাঁর কাছে এসবের কারণ জানতে চাইলে তিনি কোর্সের পড়াশোনার চাপ আর অফিসের যাবতীয় পেরেশানির অজুহাত দেখান। এরই মধ্যে আমি মাতৃত্বকালীন ছুটি নিই। তারপরও বিভিন্ন সময় মিতির সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। তারপর একদিন কল দিতে গিয়ে তার নম্বর বন্ধ পাই। সেই যে বন্ধ পেলাম, এর মধ্যে কেটে গেল আটটি বছর। আজ কথায় কথায় জানাল তার হারিয়ে যাওয়ার কারণ।

আমার ছুটি নেওয়ার কদিন পর মিতি তার হবু বরের ফেসবুকে বিয়ের ছবি দেখে। অনেক ভেঙে পড়ে সে। তারপর চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি ঘরকুনো হয়ে যায়। কয়েক মাস মানসিকভাবে অগোছালো থাকার পর প্যানিক ও ডিপ্রেশন রোগে ভুগতে থাকে টানা তিন বছর। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২০১২—পুরো একটা বছর মিতির মস্তিষ্ক থেকে পুরোপুরি মুছে যায়। ভারতে চিকিৎসা হয়। এমন মানসিক অবস্থা দেখে তার মা স্ট্রোক করে মারা যান। ছোট বোনটা চাকরি করে মিতিকে চিকিৎসায় সহযোগিতা করতে থাকে। এভাবে ২০১৫ সালে সেই মানসিক পীড়া থেকে বেরিয়ে আসে মিতি।

আরও তিন বছর পর বাড়ির পাশের এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয় সে। বছরখানেক পর স্কুলেরই এক শিক্ষক মিতির বাসায় সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। মিতির পরিবার রাজি হয়ে যায়। মিতি প্রথমে বিয়েতে রাজি না হলেও পরিবার আর স্কুলের শিক্ষকদের কথায় রাজি হয়ে যায়। এ বছরের জানুয়ারিতে তাদের বিয়ে হয়। 

মিতি বলে, ‘লোকটা অনেক সহনশীল আর অন্যকে সম্মান দিতে জানে।’

এতক্ষণ ওর কথায় ডুবে ছিলাম। নিজেকে ভালো রাখার সংগ্রামের গল্প শুনে কেঁদে ফেলেছি কখন, টেরই পাইনি। এত ঝড় গেল, আমি
জানলামই না!

তখনই খেয়াল করলাম, আমি আবিষ্কার করলাম প্রায় ১২ বছর আগের স্বাধীন, উচ্ছল, প্রাণবন্ত সেই মিতিকে। আমার প্রথম চটপটে কলিগ মিতিকে। সে আবার হাসছে, স্বপ্ন বোনার সাহস করছে। জীবনটা সামনের দিকে সুন্দর করে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলছে। সে বলছে, নিজেকে সুন্দরভাবে বাঁচিয়ে নেওয়ার অধিকার ও দায়িত্ব একান্তই তার নিজের। কত আত্মবিশ্বাসী সে! আমিও যেন এই উপলব্ধিটা আবার নতুন করে পেলাম।

ঢাকা।