Thank you for trying Sticky AMP!!

মুক্তিসংগ্রামে মায়ের প্রেরণা

আইভি রহমান
মুক্তিযুদ্ধ চলছে। নারীদের নিয়ে একটি সভা আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেত্রী আইভি রহমান। সেখানেই এক লড়াকু মায়ের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন তিনি। যে মায়ের ছেলেও যুদ্ধে গেছে। রণাঙ্গন থেকে লিখে পাঠিয়েছে একটি চিঠি। আইভি রহমান সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন ১৯৭১ সালের ১০ ডিসম্বের প্রকাশিত জয়বাংলা পত্রিকায়। লেখাটি এখানে তুলে দেওয়া হলো।

মুক্তাঞ্চলেই মায়েদের সভা ডাকা হয়েছিল। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে চলছিল সভার কাজ। একে একে সবাই বিদায় নিয়ে গেলেন। সারা দিনের খাটুনিতে মাথা ঝিমু ঝিমু করছে। টেবিলের উপর মাথাটা রেখে চোখ বুজেছিলাম কিছুক্ষণের জন্যে। হঠাৎ পায়ের শব্দে মাথা তুলে দেখি আনুর মা এসে দাঁড়িয়েছেন আমার টেবিলের কাছে।

আমাকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসতে দেখে বললেন, ‘মাথাটা ধইরছে বুঝি, টিইপ্যা দিমু?’ হেসে বললাম, ‘না তেমন কিছু না, এমনিতে সেরে যাবে।’
‘না না শরম কইরন না। যা খাটুনি পইড়ছে ধইরব না কেন।’ আনুর মা ভাবি সত্যি সত্যি মাথায় হাত লাগাতে আসছে দেখে রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। বললাম তেমন কিছু মাথা ধরেনি। সভা শেষ হবার পর একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। থাক ওসব। আচ্ছা ভাবি সভা তো হলো, সবাইকে বললাম এবং সবাই স্বীকার করলেন প্রত্যেকে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের জন্যে কিছু কাপড়, জামা, কাঁথা সেলাই করে দেবেন। সত্যি হবে তো?
‘অইব না মানে আইজ থাইক্যা হগলে লাইগ্যা যাইব। মুক্তিবাহিনীর ছা–ও–য়া–লগুলা আমাগো ছাওয়াল না? ছাওয়ালগো বাঁচান আমাগো ফরজ না?’—একটা গর্বিত দীপ্তিতে আনুর মা ভাবির মুখখানি ঝলমল করে উঠল। মাতৃত্ব ঝরে পড়ল তাঁর কণ্ঠ থেকে। বিস্মিত হলাম এই অশিক্ষিত গ্রাম্য মহিলার তেজস্বীতায়। মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম দরদে। একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা ভাবি, আনুর কোনো খবর পেয়েছ?’ আনোয়ার ওরফে আনু ভাবির একমাত্র ছেলে। ভাবি বিধবা, দুটি মেয়ে, একটি ছেলে। আর এক ছেলের নাম ছিল হাবীব। কারখানায় কাজ করত। অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে দুবছর আগে। মেয়ে দুটির বিয়ে হয়েছে, যার যার স্বামীর বাড়ি থাকে। আনুই ছিল ভাবির কাছে। বৈশাখের শেষে বিয়ে ঠিক হয়েছিল একটা লক্ষ্মী মেয়ের সঙ্গে। সে বিয়ে আর হতে পারেনি। এরই মধ্যে ইয়াহিয়ার জল্লাদবাহিনী বাংলাদেশের ওপর চালিয়েছে নারকীয় আক্রমণ। রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছে সারাটা দেশ। যে মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিলে তার বাবা–মাকে হত্যা করেছে খুনি পাকসেনা। মেয়েটির কোনো হদিস নেই। আনু তার মাকে নিয়ে চলে এসেছে মুক্তাঞ্চলে। তার মামার বাড়িতে। এখানে এসে আনু শুধু ছটফট করত আর বলত, ‘মা, আমাকেও কিছু করতে হবে।’
ভাবি প্রথমে ভয় পেতেন। আনুকে বোঝাতে চেষ্টা করতেন। ‘আমারে দেহাই তোর অহন ফরজ কাম।’ আনুও বেশি কিছু কথা বাড়াত না। একদিন আনু ফিরল বিকেলে, মুখটা থমথম করছে। মাকে ডেকে বলল, ‘শুনেছ মা, রিজিয়াকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে।’ রিজিয়ার সঙ্গেই তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল।
আনুর মা ভাবি আফসোস করেছিলেন খবরটা শুনে। কিন্তু তাঁর জন্যে আরও কিছু অপেক্ষা করছিল। আনুই বলল, ‘মা, আমি মুক্তিফৌজে যাব। রিজিয়াকে উদ্ধার করব।’
আনু মুক্তিফৌজে যাবে শুনে হক্চকিয়ে গিয়েছিলেন, আনুর মা ভাবি। বোকার মতো জিজ্ঞেস করলেন, ‘রিজিয়াকে উদ্ধার কইর্যা (করে) কি কইরবি (করবি)?’
‘বিয়ে করব। তার দোষ কী মা আমারই সঙ্গে তার বিয়ের কথা ঠিক হয়েছিল। আমারই তাকে রক্ষা করা উচিত ছিল। আমি পারিনি আমারই দোষ। ও যদি বেঁচে থাকে আর ওকে উদ্ধার করতে পারি, তবে আমি ওকেই বউ করে ঘরে আনব।’ আনু লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলে ফেলে কথাটি। আনুর মা ভাবি আনুর কথার জবাব দিতে পারেননি। ঠিকই তো রিজিয়ার দোষ কী? আজ যদি তার দুই মেয়ের এই অবস্থা হতো? ছেলের কথায় রাগ হয় না। তাঁর গর্বই হয়। তার কয়েক দিন পর আনু মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। এখন সে আছে পূর্ব রণাঙ্গনে। তারই কুশল জিজ্ঞাসা করলাম ভাবিকে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় গেরিলা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন নারীরা

‘তার লাইগ্যাই ফিরা আইলাম। এইহানে আইবার আগে আনুর একখানা চিডি আইছে। তোমার কাছেত পইড়া শুনুম বইল্যা নিয়া আইছি। তোমাগো কথা শুনতে শুনতে ভুইল্যা গেছলাম। মনে অইতে ফিরা আইছি।’ আনুর মা ভাবি তাঁর বুকের জামার ভেতর থেকে একখানা খাম বের করলেন। আট দিন আগের লেখা চিঠি। আনু লিখেছে:
মা,
কয়েক দিন তোমাকে কোনো খবর দিতে পারিনি। কারণ, আমাদের দুটো লড়াই লড়তে হয়েছে। মা, তোমার দোয়ায় দুটো লড়াইতেই আমরা জিতেছি। হানাদার পাকসেনাদের আমরা মেরে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিয়েছি। দুটো ঘাঁটি আমরা দখল করেছি। দুটো লড়াইয়ে আমরা ৮১ জন পাকসেনাকে খতম করেছি। তোমার দোয়ায় আমাদের কারও গায়ে আঁচড়টিও লাগেনি। জানো মা, লড়াইতে যাওয়ার আগে আমি কিছুক্ষণের জন্যে চোখ বুজে তোমার মুখটি স্মরণ করতাম, আর আমার দেহে শক্তির বান ডাকত, কেন এমন হয় মা? আমার মনে হয় মায়েরাই সকল শক্তির উৎস। তাই তো আমরা দেশকে মা বলে ডাকি, বলি দেশমাতা। আর একটি খবর বলি মা, একটা ঘাঁটি থেকে আমরা ১৩ জন মেয়েকে উদ্ধার করেছি। বর্বর দস্যুরা ওদের উলঙ্গ করে আটকে রেখে ওদের ওপর বর্বর পাশবিক অত্যাচার করত। সবগুলো মেয়েই রিজিয়ার বয়সী। উদ্ধার করার পর কী কান্না ওদের। দুজন আত্মহত্যাই করতে চেয়েছিল। আমিই ওদের রিজিয়ার গল্প বলেছি। বলেছি রিজিয়াকে উদ্ধার করতে পারলে আমি ওকে বিয়ে করব, স্ত্রীর সম্মান দেব। ওরা তাতে কিছুটা সান্ত্বনা পেয়েছে। আমাকে ওরা ভাই বলে ডাকে। ওরাও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। আমাদের হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রূষা করে।
মা, আমার দেশকে যারা ধ্বংস করেছে, তাদের আমরা ধ্বংস করব। আমরা পশুদের বাংলার পবিত্র মাটি থেকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দেব। তুমি দোয়া করো মা, আমরা জিতব, নিশ্চয়ই জিতব। তারপর তোমার কোলে মাথা রেখে খুইব করে ঘুমাব। কেমন? ইতি—
তোমার ‘আনু’
চিঠি পড়া শেষ হলো। আনুর মা ভাবির চোখ থেকে টসটস কর জল ঝরে পড়ছে।
‘কেঁদো না ভাবি। আনু নিশ্চয়ই ফিরবে। মন খারাপ কোরো না।’ আনুর মা ভাবিকে সান্ত্বনা দিতে গেলাম।
‘মন খারাপ না, খুশি লাগতাছে। আনু আমাগো দেশের লাইগ্যা লড়তাছে, এর থাইক্যা আর খুশি কী অইব। কারবালায় কাসেমের মাথায় কাসেমের মা যুদ্ধে যাওনের আগে পাগড়ি বাইন্ধ্যা দিছিল। আমিও নিজের হাতে ওর কাপড় পরাইয়া দিছি। আনু আমার কাসেম।’ চোখের পানি মুছে ফেলে আনুর মা ভাবি হাসলেন। তাঁর সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছে একটা স্বর্গীয় দীপ্তি। একদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাংলাদেশের মায়েরা এমনি বলেই বাংলার অজেয় মুক্তিবাহিনীর সোনার ছেলেরা আজ নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।