Thank you for trying Sticky AMP!!

যে বই পড়তে পারে না কেউ

এই হলো ভয়নিশ ম্যানুস্ক্রিপ্ট। বইটিতে লেখার পাশাপাশি আছে রং-বেরঙের আঁকিবুঁকি। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নানা ধরনের অজানা ফুল, লতাপাতার ছবি। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

বিভিন্ন পশুর চামড়া থেকে তৈরি পার্চমেন্ট কাগজে লেখা হয়েছে বইটি। লেখার পাশাপাশি আছে রং-বেরঙের আঁকিবুঁকি। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নানা ধরনের অজানা ফুল, লতাপাতার ছবি। আছে জ্যোতির্বিদ্যার সঙ্গে সংগতি থাকা নানা সংকেত। মানুষের অবয়বও আছে ঢের। কিন্তু এসবের অর্থ উদ্ধার করা কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। আদতে এখনো পর্যন্ত বইটি কেউ পড়তেই পারেনি। কারণ, এর বর্ণমালাও যে অচেনা!

রহস্যাবৃত বইটি মতান্তরে পাণ্ডুলিপিটি ‘ভয়নিশ ম্যানুস্ক্রিপ্ট’ নামে বিশ্বে সুপরিচিত। অজানার প্রতি মানুষের আগ্রহ সব সময়ই বেশি। তাই কয়েক শ বছর ধরে এই পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিদ্বজ্জনেরা। কিন্তু চেষ্টাই সার। এখনো পর্যন্ত এর কোনো সর্বজনগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেকেই নানা ‘থিওরি’ দিয়েছেন। কোনোটায় বলা হয়েছে, এটি নাকি স্নায়ুযুদ্ধকালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি কমিউনিস্ট প্রোপাগান্ডা। কেউ আবার মনে করেন, এর সঠিক পাঠোদ্ধার করা গেলে নাকি জানা যাবে চিকিৎসা থেকে জ্যোতির্বিদ্যার নিত্যনতুন তথ্য। কারও কারও দাবি, বইটির পুরোটাই নাকি ভাঁওতা!

অবশ্য বইটি যে ভাঁওতা নয়, তা চলতি শতকের শুরুতেই প্রমাণিত হয়েছে। ২০০৯ সালে এক কার্বন টেস্টে (প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তুর বয়স নির্ধারণের পরীক্ষা) জানা গেছে, ভয়নিশ ম্যানুস্ক্রিপ্ট তৈরি হয়েছে পনেরো শতকের মাঝামাঝি থেকে ষোলো শতকের মাঝামাঝি সময়ে। ঐতিহাসিক সময় বিবেচনায় নিলে, সময়টা ইউরোপীয় রেনেসাঁর যুগ। এসব উপাত্ত বিবেচনায় নিয়েই বলা হচ্ছে, রেনেসাঁ সময়েই লেখা হয়েছিল ভয়নিশ ম্যানুস্ক্রিপ্ট। কিন্তু কোন ভাষায় কে এটি লিখেছে, তা এখনো ঠাওর করা যায়নি।

গত কয়েক শ বছর ধরে এই পাণ্ডুলিপিটির পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিদ্বজ্জনেরা। এখনো পর্যন্ত এর কোনো সর্বজনগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

রহস্যের শুরু
১৯১২ সালে দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সংগ্রাহক ও বিক্রেতা উইলফ্রিড ভয়নিশ বইটির খোঁজ পান। ভদ্রলোক ছিলেন পোল্যান্ডের নাগরিক। রোমে খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদের এক আশ্রম থেকে কিছু পুরোনো বই কেনার সময় এই পাণ্ডুলিপি তাঁর নজরে পড়েছিল এবং তা কিনে নিয়েছিলেন তিনি। যেহেতু এর নাম জানা যায়নি, তাই পরবর্তী সময়ে ভয়নিশ ম্যানুস্ক্রিপ্ট নামেই এটি বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পায়।

শুরুতে বেশ কয়েক বছর এই পাণ্ডুলিপি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন উইলফ্রিড ভয়নিশ নিজেই। কিন্তু পাঠোদ্ধার হয়নি। এই বইয়ের অনেক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন ভয়নিশ। ১৯২১ সালে তিনি ও ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার দর্শনের অধ্যাপক উইলিয়াম নিউবোল্ড দাবি করেছিলেন, দক্ষিণ ইউরোপের এক দুর্গে এই পাণ্ডুলিপি প্রথম পাওয়া যায় এবং এটি নাকি লিখেছিলেন ১৩ শতকের ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রজার বেকন। তবে এই দাবি ২০০৯ সালে এসে অসাড় হয়ে যায়। ওই সময় করা কার্বন টেস্টে জানা যায়, আরও এক শ-দেড় শ বছর পর লেখা হয়েছে ভয়নিশ ম্যানুস্ক্রিপ্ট।

১৯৬১ সালে ভয়নিশ এস্টেটের কাছ থেকে পাণ্ডুলিপিটি কিনে নেন নিউইয়র্কের বইবিক্রেতা হানস পি খ্রাউস। পরে ১৯৬৯ সালে তিনি বইটি যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির বাইনেকি লাইব্রেরিতে দান করে দেন। সেই থেকে বইটি সেখানেই আছে এবং রহস্য গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে।

শোনা যায়, প্রখ্যাত গণিতবিদ ও কম্পিউটার বিজ্ঞানী অ্যালান টুরিং থেকে শুরু করে এফবিআই, সিআইএ ও এনএসএ-এর মতো গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও ভয়নিশ ম্যানুস্ক্রিপ্ট নেড়েচেড়ে দেখেছে। কিন্তু কারও ভাগ্যে পাঠোদ্ধারের শিকে ছেঁড়েনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার কোড ব্রেকাররাও এ নিয়ে কাজ করেছেন বছরের পর বছর। তবে বইটির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

১৯১২ সালে দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সংগ্রাহক ও বিক্রেতা উইলফ্রিড ভয়নিশ বইটির খোঁজ পান। শুরুতে বেশ কয়েক বছর এই পান্ডুলিপি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন উইলফ্রিড ভয়নিশ নিজেই। কিন্তু পাঠোদ্ধার হয়নি। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

কী আছে এতে?
ভয়নিশ ম্যানুস্ক্রিপ্টে প্রায় ২৩৪টি পৃষ্ঠা আছে। ছবি আছে প্রায় ২০০টি। ধারণা করা হয়, এতে মোট ছয়টি অধ্যায় আছে। মূলত ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা এই ধারণা করে থাকেন। বলা হয়ে থাকে, অধ্যায়গুলো উদ্ভিদবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষবিদ্যা, জীববিজ্ঞান, ওষুধশিল্প ও মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্ব–সম্পর্কিত। এ ছাড়া নকশা করা অনেক লেখাসংবলিত একটি অংশও রয়েছে।

এই পাণ্ডুলিপিতে অজানা বিভিন্ন ফুল, লতাপাতার ছবি আঁকা আছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, কিছু ছবিতে সূর্য, চাঁদ ও বিভিন্ন নক্ষত্রের মতো অবয়ব আছে। আবার কিছু চিহ্নের সঙ্গে জ্যোতিষ–সম্পর্কিত সংকেতের মিলও পাওয়া যায়। পাণ্ডুলিপিতে থাকা নারী দেহের অবয়ব দেখে ধারণা করা হয়, এতে সন্তান প্রতিপালন ও মা–বাবার দায়িত্ব– সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েও আলোচনা রয়েছে।

মজার বিষয় হলো, এই সব ধারণাই স্রেফ অনুমানের ওপর দাঁড়িয়ে। কেউই এগুলো যুক্তিসহ ব্যাখ্যা করতে পারেননি।

ভয়নিশ ম্যানুস্ক্রিপ্টে প্রায় ২৩৪টি পৃষ্ঠা আছে। ছবি আছে প্রায় ২০০টি। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

তর্কে-বিতর্কে জেরবার
চলতি বছরের মে মাসে ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টলের এক গবেষক দাবি করে বসেন যে তিনি ভয়নিশ ম্যানুস্ক্রিপ্টের পাঠোদ্ধার করতে পেরেছেন। পিএইচডি ডিগ্রিধারী এই গবেষকের নাম জেরার্ড চেশার। এ–সংক্রান্ত তাঁর গবেষণা কর্মটি ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টলের প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইটেও প্রকাশিত হয়। ফলে হইচই পড়ে যায় পুরো বিশ্বে। শত শত বছরে যে বই কেউ পড়তে পারেননি, মাত্র দুই সপ্তাহে নাকি সেই বইয়ের পাঠোদ্ধার করে ফেলেছেন জেরার্ড চেশার।

এই পান্ডুলিপিতে অজানা বিভিন্ন ফুল, লতাপাতার ছবি আঁকা আছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, কিছু ছবিতে সূর্য, চাঁদ ও বিভিন্ন নক্ষত্রের মতো অবয়ব আছে। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

এই গবেষকের দাবি, প্রোটো–রোমান্স নামের একটি হারিয়ে যাওয়া ভাষায় বইটি লেখা হয়েছে। এক সন্ন্যাসিনী বইটি লিখেছিলেন। এতে ভেষজ চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা সংশ্লিষ্ট নানা তথ্যসহ ঐতিহাসিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। জেরার্ড চেশার বলছেন, লাতিন, ইতালি ও স্প্যানিশ ভাষার সংমিশ্রণে তৈরি একটি বিশেষ পদ্ধতিতে লেখা হয়েছে ভয়নিশ ম্যানুস্ক্রিপ্ট। এতে ভূমধ্যসাগরের চারটি দ্বীপের ছবি আঁকা আছে এবং মধ্যযুগের কয়েকটি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত বিষয়েও তথ্য দেওয়া আছে।

অবশ্য এরই মধ্যে জেরার্ড চেশারের এমন দাবি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়ে গেছে। নিন্দুকেরা বলছেন, চেশার যেভাবে পাঠোদ্ধার করার কথা বলেছেন, তা অযৌক্তিক। এই প্রক্রিয়ায় পুরো পাণ্ডুলিপিটির সব অংশের পাঠোদ্ধার করা যাচ্ছে না। এমনকি ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টল কর্তৃপক্ষও জেরার্ড চেশারের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। শুরুতে চেশারকে সমর্থন করলেও এখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, ভয়নিশ ম্যানুস্ক্রিপ্টের পাঠোদ্ধার করার দাবি একান্তই গবেষকের। এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নেই। এ বিষয়ে আরও পরীক্ষা–নিরীক্ষা প্রয়োজন। এমন বিবৃতি দেওয়ার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলা হয় জেরার্ড চেশারের ওই গবেষণাপত্র।

সব মিলিয়ে ভয়নিশ ম্যানুস্ক্রিপ্ট নিয়ে রহস্য উন্মোচনের বদলে তা আরও ঘনীভূত হয়েছে। আপাতত এ নিয়ে গবেষণা চলছেই। বইটি পড়ার জন্য আরও কত বছর অপেক্ষা করতে হবে, কে জানে!

তথ্যসূত্র: হিস্টরি টুডে, লাইভ সায়েন্স, ফোর্বস, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, গার্ডিয়ান, বিবিসি ও হিস্টরি এক্সট্রা