Thank you for trying Sticky AMP!!

রিকশামিস্ত্রি নাজমা

রিকশা মেরামত করছেন নাজমা আক্তার। ছবি: সুমন ইউসুফ

আবাহনী মাঠের পশ্চিম পাশের ফুটপাত ঘেঁষে পরপর কয়েকটি রিকশা-সাইকেল সারাইয়ের দোকান। রাজধানীর ধানমন্ডির এ জায়গাটায় আসতেই কানে ভেসে এল মানুষের কোলাহল আর গাড়ির হর্নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঠুকঠুক, টুংটাং শব্দ। রিকশা-সাইকেল সারাই মিস্ত্রিরা যে যার মতো কাজে ব্যস্ত। খুবই সহজ স্বাভাবিক পরিচিত শহুরে ফুটপাতের দৃশ্য। কিন্তু একটু এগোতেই চোখ আটকে যায় সম্পূর্ণ অপরিচিত দৃশ্যে। বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা বড় বহিরঙ্গন ছাতা। ছাতার নিচে রিকশা মেরামতের যন্ত্রপাতি থরে থরে সাজানো। তার সামনে বসে একমনে রিকশা সারাইয়ের কাজ করছেন একজন নারী। ঢাকা নামের এই জাদুর শহরে জীবন-জীবিকা নির্বাহের কতই না পন্থা মানুষের। শ্রম আর ঘাম বিক্রির এই বিনিময় চক্রে পিছিয়ে নেই নারীরাও। কিন্তু তাই বলে রিকশা সারাইয়ের কাজে একজন নারী! শহরজুড়ে এ রকম দৃশ্য দ্বিতীয়টি চোখে পড়বে বলে মনে হয় না। কৌতূহলে এগিয়ে গিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

নাম তাঁর নাজমা আক্তার। বয়স ৪৫। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। নাজমা আক্তার বললেন, ‘বাবা ছিলেন রিকশামিস্ত্রি। জন্মের পর থেকে বড়ই হইছি রিকশা সারাইয়ের যন্ত্রপাতির সঙ্গে। ফলে কাজটা নতুন করে শিখতে হয়নি।’ সেই ছোটবেলাতেই বাবার কাছ থেকে আগ্রহভরে শেখেন মেরামতের বিভিন্ন কাজ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে কাজের দক্ষতা। তবে রীতিমতো পেশা হিসেবে কাজটি গ্রহণ করবেন—শুরুতে এমন ভাবনা ছিল না মোটেই। অন্য আর দশটা বাঙালি মেয়ের মতো বিয়ে করে গৃহিণীর জীবন শুরু করেছিলেন নাজমা। ‘কিছুদিন যেতে না যেতেই স্বামীর আচরণ বদলাতে থাকে। অত্যাচার-অপমান করতেন। ব্যাপারটি মানতে পারিনি।’ বলছিলেন তিনি।

নাজমা তখন বুঝে গিয়েছিলেন, আর্থিক স্বাবলম্বিতাই তাঁকে এই অপমান-অত্যাচার থেকে মুক্তি দিতে পারে। একমুহূর্ত ভাবেননি আর। বাবার শেখানো কাজটাকেই গ্রহণ করেন পেশা হিসেবে। তবে প্রয়াত স্বামীর প্রতি ক্ষোভ নয়, একধরনের কৃতজ্ঞতা যেন রয়েছে তাঁর। প্রয়াত স্বামীর অগ্রহণযোগ্য আচরণের জন্যই তো আজ কত কত মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন। হয়ে উঠেছেন আত্মনির্ভরশীলতার দৃষ্টান্ত।

নাজমা আক্তার

একজন দক্ষ রিকশামিস্ত্রি হিসেবেই শুধু নয়, রিকশা মেরামতের প্রশিক্ষক হিসেবেও নাজমা আক্তার প্রতিষ্ঠিত। শহরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাঁর শিষ্যরা। উস্তাদ হিসেবে ভীষণ শ্রদ্ধা করেন তাঁরা। বর্তমান স্বামী আবদুর রহমানও তাঁর একসময়ের শিষ্য। সেও বছর বিশেক আগের কথা। কাজের পাঠ দিতে গিয়ে কোন ফাঁকে মনটাও দিয়ে ফেলেন আবদুর রহমানকে। তারপর থেকে গাঁটছড়ার বিশ বছর। শিষ্য থেকে স্বামী হয়ে ওঠার পর কি বদলে গেছেন রহমান? দুই দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে প্রশ্নটাকেই প্রত্যাখ্যান করলেন নাজমা। জানালেন, ‘স্বামীত্ব ফলানো তো দূরের কথা, খুব শ্রদ্ধাই করেন তিনি। কখনো কখনো ডাকেন ‘‘উস্তাদ’’ সম্বোধনে।’ কেমন লাগে এই ডাক? কিছুটা লজ্জা পেলেন নাজমা। বললেন, ‘ভালোই লাগে। মানুষের সামনে যখন ‘‘ওই যে আমার উস্তাদ আইতাছে’’ বলে ডাক দেয়, খারাপ লাগে না। যদিও লজ্জা লজ্জা লাগে মাঝেমধ্যে।’

পাঁচ সন্তানের মা নাজমা আক্তার। দুই ছেলে আর তিন মেয়ে। সবাইকেই এ কাজে হাতেখড়ি দিয়েছেন। এ যেন নিজের বাবার কাছ থেকে পাওয়া কারিগরি জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে দেওয়া। তিনি মনে করেন, ‘নারীর কাজ-পুরুষের কাজ’ বলে কাজের কোনো বিভাজন হয় না। জানা থাকলে যেকোনো কাজই পুরুষ বা নারী জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন বলে বিশ্বাস করেন ব্যতিক্রমী নারী নাজমা আক্তার।