Thank you for trying Sticky AMP!!

রোবটিকস কার্যক্রমের প্রাণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল। ছবি: প্রথম আলো

নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী হোসেন জামাল যখন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মারা যান, তখন তাঁর মেয়ে ইভার বয়স মাত্র ১১ মাস। ইভার মা, ২১ বছর বয়সী মীনা হোসেনের নতুন সংগ্রাম শুরু। ইভার দাদা আবদুস সোবহান ও চাচা কাশেম জামাল হাল ধরলেন ইভাদের সংসারের। ‘আমার সৌভাগ্য কারণ, চাচা কাশেম জামাল সেদিন থেকে আমার বাবার ভূমিকা নিয়ে নেন। আমি তাঁকে বাবাই ডাকি।’ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্র কক্ষে আমরা কথা বলছিলাম। ইভা বলছিলেন, কেমন করে নারায়ণগঞ্জের ছোট্ট ইভা বাংলাদেশের শিশু–কিশোরদের নতুন প্রযুক্তির ভুবনে হয়ে উঠেছেন একজন লাফিফা জামাল। এর একটু আগেই তিনি ব্রিটিশ কাউন্সিলের সঙ্গে একটি চুক্তি সই করেছেন। ফলে সারা দেশের ছেলেমেয়েরা ২০২০ সাল থেকে যুক্ত হতে পারবে বাংলাদেশের দুটি রোবট অলিম্পিয়াডের সঙ্গে। দেশে এর আয়োজনকারী সংগঠন বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের (বিডিওএসএন) সহসভাপতি এবং বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি অধ্যাপক লাফিফা জামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক। একই সঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডের কেন্দ্রীয় কমিটিরও একজন সদস্য।

এইচএসসি পেরিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন লাফিফা। কিন্তু পরে চলে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগে। ‘পড়ালেখা বা চাকরির সময় প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় বাসে আসা-যাওয়া করতাম। মন খারাপ হতো, কারণ বাসায় একাধিক গাড়ি ছিল। এখন বুঝি, বাবার এই সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক ছিল। একা গণপরিবহনে আসা–যাওয়া আমাকে পরিপূর্ণ হতে সাহায্য করেছে,’ বলছিলেন লাফিফা জামাল।

কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়তে পড়তেই লাফিফা ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু মিলে তৈরি করলেন দুটি সফটওয়্যার। একটির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য মাল্টিমিডিয়া কুইজ পরীক্ষা নেওয়া যায়। অন্যটি ইন্টারনেট সেবাদাতাদের বিলিং সফটওয়্যার। দুটি সফটওয়্যার থেকে নিয়মিত কিছু আয় হতে থাকে। ‘সেই টাকা জমিয়েই আমি প্রথম মোবাইল ফোন কিনি,’ বললেন তিনি।

স্নাতকোত্তরের থিসিস ভাইভার পরদিন সাক্ষাৎকার দিয়ে একটি আমেরিকান ডেটা মাইনিং প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ অফিসে চাকরি নেন লাফিফা জামাল। পরে সেটি ছেড়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের বিভাগে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চালু করে দেশের প্রথম রোবটিকস শিক্ষার বিভাগ। ‘সিএসইতে পড়ার সময়ই রোবটিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং—এসব নিয়ে কাজ করেছি। ভাবলাম দেশেই যখন সুযোগ হচ্ছে, তখন কেন সেটাতেই জোর দিই না।’ কাজেই সিএসই বিভাগের নিয়মিত কাজের বাইরে রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগে শুরু থেকে যুক্ত হন লাফিফা। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লাফিফা জামালকেই এই নতুন বিভাগ গড়ার দায়িত্ব দেয়। সাড়ে তিন বছর ধরে তিলে তিলে বিভাগটিকে তৈরি করেছেন লাফিফা, তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন একটি বিভাগের অবকাঠামো তৈরি করা মোটেই সহজ নয়। লাফিফাকে ছুটতে হয়েছে সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে, ধরনা দিতে হয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকের সিএসআর (করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি) তহবিলের জন্য, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়কে বোঝাতে হয়েছে সবকিছু ‘মাথাপিছু হিসাবে হয় না’। শুধু লাইব্রেরি নয়, গড়ে তুলতে হয়েছে নতুন কয়েকটি পরীক্ষাগার। একযোগে কাজ করার লক্ষ্যে যোগাযোগ করতে হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ভিনদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে।

বিভাগীয় প্রধান হিসেবে প্রশাসনিক এত দায়িত্বের মধ্যে নিজের ও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় যেন ঘাটতি না হয়, সেদিকেও লক্ষ রেখেছেন তিনি। সংসার বড় হয়েছে। স্বামী নওরোজ রহমান, পুত্র শ্রেষ্ঠ ও কন্যা শ্রেয়সীর পড়াশোনাও আছে। সবকিছু সামলে অর্জন করেছেন পিএইচডি ডিগ্রি। ২০১৯ সালে অধ্যাপক হয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের জন্য রোবটিকস শিক্ষার পাশাপাশি লাফিফা ভাবেন, আরও ছোটদের কাছে রোবটিকস জনপ্রিয় করা যায় কি না। তাঁরই নেতৃত্বে ২০১৮ সালে ফিলিপাইনে আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো যোগ দিয়ে লাভ করে স্বর্ণপদক। ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রেখে ২০১৯ সালেও স্বর্ণপদক পেয়েছে বাংলাদেশ।

তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য কাজ করছেন লাফিফা। বললেন, ‘এখন আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তথ্যপ্রযুক্তি–সংক্রান্ত বিভাগে এক-চতুর্থাংশ শিক্ষার্থীই মেয়ে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের সংখ্যা ১০ শতাংশও নয়। এ জন্য আমাদের অনেক কাজ করতে হবে।’ এই কাজগুলোর জন্য লাফিফা যুক্ত হয়েছেন বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে। বিডিওএসএন ও রোবট অলিম্পিয়াডের পাশাপাশি লাফিফা এখন বাংলাদেশ ওম্যান ইন আইটির সভাপতি এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটির কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। ‘আমরা মেয়েদের বলছি, কেবল পড়াশোনা করলেই হবে না। নিজেদের জায়গা করে নিতে হবে সবখানে।’ এ জন্য এসব প্রতিষ্ঠান থেকে আয়োজন করা হয় কর্মশালা, প্রশিক্ষণ, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বুট ক্যাম্প। আর এসব আয়োজনের জন্য লাফিফা ছুটে যান নানা জায়গায়। দেশে বা দেশের বাইরে।

লেখক: প্রথম আলোর যুব কার্যক্রমের প্রধান ও গণিত অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক