Thank you for trying Sticky AMP!!

লেখালেখির নানা দিক

আঁকা: সোহাগ পারভেজ

সৃষ্টিশীল লেখালেখি কীভাবে করতে হয়, কীভাবে একটি গল্প অথবা উপন্যাসের কলকব্জা জোগাড় করে অথবা তৈরি করে জোড়া দিতে হয়, বাজিয়ে দেখতে হয়, তার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম অথবা তত্ত্ব নেই। ফলে এসব ‘শেখানো’ যায় না, হাতে-কলমে করে দেখানো যায় না। যা করা যায়, তা হচ্ছে অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান। একজন কবি অথবা কথাসাহিত্যিক কীভাবে লেখেন, কোন পথে উঠে আসে তাঁর নির্মাণ-চিন্তা, আর কীভাবে কবিতা-গল্পের বিষয়-আশয় আর শৈলীর বিষয়গুলো তিনি নিষ্পত্তি করেন, সেসব নিয়ে তিনি আলোচনা করতে পারেন। এই অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়াটা অনেক সময় তরুণ কবি-লেখকদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে। পশ্চিমের অনেক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃজনশীল লেখালেখির ওপর পাঠদান করা হয়। 

অনেক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিস্টার পড়াতে গিয়ে সৃজনশীল লেখালেখির কার্যক্রমের সঙ্গে আমার প্রথম প্রত্যক্ষ পরিচয় হয়। সেই কার্যক্রমে প্রশিক্ষণ দিতে এসেছিলেন সে দেশের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক রোনাল্ড সুকেনিক। ওই কার্যক্রমের পরিচালকের আমন্ত্রণ পেয়ে এক দুপুরে আমিও ঢুকে পড়েছিলাম তাঁর ক্লাসে। তিনি শিক্ষার্থীদের তিনটি কথা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। তাঁর প্রথম কথা ছিল, যদি লিখতে চাও, পড়তে হবে। দ্বিতীয় কথা, যদি লিখতে চাও, জীবনটাকে জানতে হবে। আর তৃতীয় কথা ছিল, লেখালেখির নিয়মগুলো প্রথমে নিজের মতো আয়ত্ত করে নিয়ে পরে প্রয়োজনমতো ভাঙতে হবে। আমাকে কিছু বলার আমন্ত্রণ জানালে আমি বলেছিলাম, কথাগুলো আমারও এবং একটু যোগ করে এটুকু বলেছিলাম, চতুর্থ একটি কথা হতে পারে, কোনো লেখক থেকে অনুপ্রেরণা পেলেও তাঁকে অনুসরণ করা যাবে না। অনুকরণ তো নয়ই। অনুসরণ কখনো মূলকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। সুকেনিক মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলেন।
ছোটগল্প নিয়ে তাঁর একটি মন্তব্য এখনো কানে বাজে, তিনি বলেছিলেন, খুব বড় একটা জীবন ধরার বাসনা থেকে এগোলে ছোটগল্পের কেন্দ্রে পাওয়া সহজ হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্ট মাস্টার’-এর রতন অথবা ‘হৈমন্তী’র হৈমন্তীর জীবন কি খুব বড়? এর উত্তরে আরেকটি প্রশ্ন করা যায়। বড় না হলে তাদের আমরা ভুলতে পারি না কেন? এই বড়ত্ব বস্তুর নয়, বৈভবের নয়—এই বড়ত্ব কল্পনার। একটি ছোট মেয়ে যখন আমাদের মনটা অধিকার করে নেয়, তখন তা সে করে কল্পনার বড়ত্বের জোরে। বড় জীবন বলতে সুকেনিক বুঝিয়েছিলেন সেই কল্পনার বিষয়টি, যা একটি ছোটগল্পকে এটি বড়সড় হীরকখণ্ডের মহিমা দিতে পারে।

সৃজনশীল লেখালেখি, আরও নির্দিষ্ট করে বললে, কী করে গল্প-উপন্যাস লিখতে হয়—বিষয়ে আমাকে যখন অভিজ্ঞতা ভাগ করার জন্য বলা হলো, আমার মনে হলো, সুকেনিকের মতো আমিও তাহলে কয়েকটি কথাকে আমার মতো করেই বলি। তাহলে আমার ‘শেখানো’র ব্যাপারটা থাকে না, আবার বক্তৃতা দেওয়ার ভাটাও তাতে চলে যায়। এসব শেখানো যায় না, যদিও লেখার শক্তিটা জাগানোর ক্ষেত্রে কিছুটা অনুপ্রেরণা সব সময় দেওয়াই যায়।
সুকেনিকের কথাগুলো আমার মতো করে যদি বলি, তাহলে তাঁর তিনটির সঙ্গে আমার আরও তিনটি কথা জুড়ে এভাবে বলতে পারি।
১.
একটা প্রস্তুতিপর্ব থাকাটা ভালো। আজ সকালে যদি আমি ভাবি আমি কবি হব অথবা কথাসাহিত্যিক হব এবং আজকেই লেখা শুরু করে দিলাম, এ রকমভাবে এগোনোর পরিবর্তে যদি একটা প্রস্তুতিপর্বে ঢুকে পড়া যায়, তাহলে ফলটা ভালো হয়। এই প্রস্তুতিপর্বটা হবে পড়ার। প্রচুর পড়তে হবে। রবীন্দ্রনাথের পড়াশোনাটা ছিল ব্যাপক। এমনকি নজরুল, যিনি দারিদ্র্যের সঙ্গে সারা জীবন যুদ্ধ করেছেন, স্বভাবে ছিলেন উড়ুক্কু, তিনিও প্রচুর পড়েছেন। লালন হয়তো বই পড়েননি, কিন্তু পৃথিবীটা পড়েছেন, মানুষকে পড়েছেন, তাঁর নিজের মতো করে। যত বেশি পড়া, তত বেশি জানা—এটি কোনো আপ্তবাক্য নয়, এটি জীবনসত্য। আমি যদি পৃথিবীর পাঁচজন গল্পকারের পাঁচটা গল্প পড়ি, শুধু যে পাঁচ রকম জীবন আমি দেখতে পাব তা নয়, ওই পাঁচ লেখকের মিল-অমিল, চিন্তাভাবনা, শৈলী, মেজাজ ও গল্প বলার ভঙ্গি সম্পর্কে জানতে পারব। এই পাঁচ যদি পাঁচ শতে নিয়ে যেতে পারি, তাহলে আমার অভিন্নতার ঝুলিটা যে কত বড় হতে পারে, তা তো সহজেই অনুমেয়।
তবে পড়াশোনার জায়গাটা শুধু গল্প-উপন্যাসে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। পড়তে হবে দর্শন থেকে মহাকাশ বিজ্ঞান। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ একটি উপন্যাস লিখেছেন, নিউজ অব অ্যা কিডন্যাপিং। এ উপন্যাস লেখার আগে ছয় মাস তিনি পড়াশোনা করেছেন রাজনৈতিক ও উগ্রবাদী অপহরণ নিয়ে, মিডিয়া নিয়ে। তাঁর মতো বড় লেখকও ভেবেছেন, প্রস্তুতির প্রয়োজন।
২.
জীবনটাকে জানতে হবে: ভারতীয় ঔপন্যাসিক মুল্ক্ রাজ আনন্দ, যিনি ইংরেজি ভাষাকেই বেছে নিয়েছিলেন সাহিত্যচর্চার মাধ্যম হিসেবে এবং লিখেছেন সমাজের নিম্নবর্গীয় বলে কথিত অবজ্ঞা আর অবহেলার শিকার মানুষজনকে নিয়ে। একটি কথা বলতেন, হাতির দাঁতের মিনারে বসে রাস্তার জীবনকে জানা যায় না। রাস্তার জীবন মানে বাস্তব, কঠিন বাস্তব—একজন লেখককে দৃষ্টি দিতে হবে জীবনের ভেতরে। যতখানি পারা যায়, জীবনকে জানতে হবে।
৩ .
লেখার নানান শৈলী সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হবে: সুকেনিক নিয়ম জেনে নিয়ম ভাঙার যে কথা বলেছিলেন, তা আরেকটু ঘুরিয়ে এ রকম বলা যায়, যত বেশি জানা যাবে লেখালেখির নানা কৌশল সম্পর্কে, তত বেশি সেসব থেকে বেরিয়ে অথবা সেসব থেকে আলাদা নিজস্ব একটি কৌশল তৈরি করা যাবে। অনেক কৌশল বা শৈলী সম্পর্কে ভালোভাবে জানা হলে একটা বিকল্প অথবা সমান্তরাল কৌশল/শৈলী নিজ থেকেও ধরা দিতে পারে। ব্যক্তিগত একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারি। অনেক বছর আগে যখন লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্যিকদের লেখা পড়ে জাদুবাস্তবতার বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত হই, আমার মনে হচ্ছিল, এটি তো অপরিচিত কিছু নয়। জাদুবাস্তবতা আমাদের রূপকথায় আছে, অনেক লেখকের গল্প-উপন্যাসে আছে। সেগুলো নিয়ে ভাবতে বসে মনে হলো, জাদুবাস্তবতার জন্য ওই সব লেখকের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। যদিও তাঁদের ব্যাখ্যাটা জানা থাকলে এই ধারণার বৈচিত্র্যটি ধরা পড়ে।
অনেক সময় ধোলাই খালের কর্মকুশলীদের মতো নানা জায়গা থেকে নেওয়া যন্ত্রাংশ দিয়ে দিব্যি একটি নতুন জিনিস তৈরি করা যায়। তবে এ জন্য প্রয়োজন কল্পনা।
৪.
কল্পনার জগৎটা তাই বিস্তৃত ও অবারিত করতে হবে: শুধু যে কবিদের কল্পনাশক্তি থাকতে হয়, তা নয়, সৃজনশীল সব লেখকের ক্ষেত্রেই কল্পনার একটি বড় ভূমিকা আছে। শুধু সৃজনশীলই বা বলি কেন, বিজ্ঞানীদেরও কল্পনা থাকা চাই, চাই অর্থনীতিবিদদেরও। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, একজন বিজ্ঞানীকে আরেকজন বিজ্ঞানী থেকে আলাদা করবেন কীভাবে। হকিং কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিয়েছিলেন, একটা বড় প্রভেদ গড়ে দেয় কল্পনাশক্তি। একজন লেখক চারদিকের জীবন দেখেন, বাস্তবকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, তারপর কল্পনার রসায়নে সেগুলোকে জারিত করেন।
৫.
অনুপ্রেরণা ভালো, অনুসরণ নয়, অনুকরণ তো নয়ই: প্রথম যে কথা, পড়তে হবে, তাতে একটা লাভ হয়—অনেক অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়। অনুপ্রেরণা ভালো কিন্তু কোনো লেখককে অনুসরণ করা ভালো কথা নয়। অনেক গল্পকারকে দেখি, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে অনুকরণ করছেন। এঁদের গল্প চার-পাঁচ লাইন পড়ে রেখে দিতে হয়। ওয়ালীউল্লাহ থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়ার অনেক কিছু আছে, তাঁর গ্রামদর্শন, জীবনপাঠ, জটিল মনস্তত্ত্ব উন্মোচন। কিন্তু ঠিক তাঁর মতো করে এসব করতে গেলে বিপত্তি ঘটবে। তাঁর ভাষার অনুকরণ করলে কোনো দিনই একটা গণ্ডি থেকে বেরোনো যাবে না।
৬.
ভাষা হতে হবে নিজস্ব: ভাষার প্রসঙ্গ যখন এল, তা দিয়েই শেষ করি। আমরা সবাই একই ভাষায় কথা বললেও সবারই কথা বলার ভঙ্গি আলাদা। সে রকম লেখার ক্ষেত্রেও ভাষাটা নিজস্ব হওয়া চাই। এ জন্য অনেক ভাবতে হবে, লিখতে হবে। একই কথা অনেকভাবে যে বলা যায়, সেটি রপ্ত করতে হবে। বড় লেখকেরা কীভাবে ভাষার ওপর তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন, তা যদি বোঝা যায়, কাজটা সহজ হয়।