Thank you for trying Sticky AMP!!

শখ থেকে স্বর্ণ

>

ডাকটিকিট সংগ্রাহক শেখ শফিকুল ইসলাম। ছবি: সুমন ইউসুফ

ডাকটিকিটের সমৃদ্ধ এক সংগ্রহ আছে শেখ শফিকুল ইসলামের। তাঁর কাছে আছে পূর্ববঙ্গের রাজস্ব ডাকটিকিটও। এই সংগ্রহ প্রদর্শন করে ইন্দোনেশিয়ায় আয়োজিত ‘ফোর নেশনস স্ট্যাম্প এক্সিবিশনে’ স্বর্ণ জিতেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে বাংলাদেশি ডাকটিকিট সংগ্রাহকদের মধ্যে এটাই প্রথম স্বর্ণপদক। শেখ শফিকুল ইসলাম এই সংগ্রহসহ আরও তিনটি সংগ্রহ দেখালেন আমাদের।

ফোর নেশনস স্ট্যাম্প এক্সিবিশনে পাওয়া স্বর্ণ পদক

শেখ শফিকুল ইসলামের ভাষায়, ‘প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ডাকটিকিট সংগ্রহ করছি। এখন আমার বয়স ৫৮। দীর্ঘ এই সময়ে সংগ্রহ কম হয়নি!’ তা ঠিক কতগুলো ডাকটিকিট সংগ্রহ করেছেন এই জীবনে? এই প্রশ্নে তিনি এমনভাবে হাসলেন যেন আকাশের তারার সংখ্যা জানতে চেয়েছি। মোটা দাগে ৩০টি সংগ্রহ আছে তাঁর। এ পর্যন্ত বিশ্বের নামকরা প্রায় সব প্রদর্শনীতে দেখিয়েছেন সংগ্রহগুলো। পেয়েছেন অনেক পুরস্কার আর সীমাহীন আনন্দ। প্রশ্ন করে জানা গেল বর্তমানের ১৯৫টি দেশের তিন লাখের বেশি ডাকটিকিট রয়েছে তাঁর সংগ্রহে।

ওয়ার্ল্ড স্ট্যাম্প শোতে পাওয়া পদক

শেখ শফিকুল ইসলাম সফল ব্যবসায়ী। দারুণ গোছানো মানুষ। ঢাকার গুলশান ১–এ তাঁর বাসা। সেখানেই কথা হচ্ছিল। পরিপাটি বসার ঘর। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর ডাকটিকিটের সংগ্রহশালাটিও নিপুণ হাতে গোছানো। কিন্তু ওই গোছানো সংগ্রহশালা দেখতে দেখতেই মাথায় প্যাঁচ লেগে গেল! কত রং, আকার, বয়স, দাম আর গন্ধের ডাকটিকিট যে সাজিয়ে রাখা তাঁর অ্যালবামগুলোতে! কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখি অবস্থা। কিংবা বলা যায়, ফুলের বনে যার পাশে ‘যাই’ তারেই লাগে ভালো। কোনোটা দেখতে সুন্দর, কোনোটির দাম শুনে মুখ হাঁ হয়ে যায়, কোনোটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব শিহরণ জাগায়।

আবার বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে সেঁটে থাকা ডাকটিকিটগুলো ছুঁয়ে দিলে কেমন গর্ববোধ হয়। তাই এই বিচিত্র ৩০টি সংগ্রহ থেকে বাছাই করা ৪টি নিয়ে বিস্তারিত বললেন শেখ শফিকুল ইসলাম।

পূর্ববঙ্গের রাজস্ব ডাকটিকিট

এই রাজস্ব ডাকটিকিটগুলো ব্যবহৃত হয়েছিল ১৭১২ থেকে ১৮৯০ সালের মধ্যে। রাজস্ব ডাকটিকিট বলতে বিচারকাজ ও বিচারকাজের বাইরে এগুলো ব্যবহার করা হতো। এগুলোর মধ্যে ১৮৩১ সালের একটি দুষ্প্রাপ্য। যশোরের কোনো এক ব্যক্তির জমির মালিকানা হস্তান্তরের দলিল। এতে ১ হাজার ৬০০ রুপির রাজস্ব ডাকটিকিট ব্যবহৃত হয়েছে। এর আর দ্বিতীয় কোনো কপি নেই বলে জানালেন শেখ শফিকুল ইসলাম; ফলে দামও অনেক। ১৭১২ সালের আরেকটি দানপত্র চোখে পড়ল, ফারসি ভাষায় লেখা। প্রাচীন কাগজটি হাতে নিতেই মনে হলো, অতি বৃদ্ধ কোনো মানুষের হাত ধরেছি! ২০০৪–০৫ সাল থেকে এগুলো সংগ্রহ করছেন শেখ শফিকুল ইসলাম। মজার ব্যাপার হলো, এগুলোর কোনোটাই তিনি বাংলাদেশ বা ভারত থেকে সংগ্রহ করেননি। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়াসহ আরও বেশ কিছু দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিল পূর্ববঙ্গের দলিলগুলো! এই সংগ্রহের জন্য ২০০৯ সালে কোরিয়া থেকে লার্জ সিলভার পদক জিতেছিলেন শফিকুল। তারপর গত বছরের আগস্ট মাসে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর—এই চার জাতি আয়োজিত ‘ফোর নেশনস স্ট্যাম্প এক্সিবিশনে’ থেকে পেলেন স্বর্ণ। আর এ পর্যন্ত মোট ১০টি পুরস্কার পেয়েছেন এই সংগ্রহের জন্য।

পাকিস্তানি ডাকটিকিটের ওপর ‘বাংলাদেশ’ ওভারপ্রিন্ট

কেবল ডাকমাশুল আদায়ের জন্য নয়, বাংলাদেশের প্রথম ৮টি ডাকটিকিট স্বাধীনতা আদায়ের হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করেছিল। স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টির জন্য মুজিবনগর সরকার ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে ওই ৮টি ডাকটিকিট প্রকাশ করে। শেখ শফিকুল ইসলাম বলছিলেন, ‘ডাকটিকিট প্রকাশিত হলেও বাংলাদেশে ডাকঘরের যাত্রা শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর থেকে। স্বাধীনতার পরও অবশ্য পাকিস্তানের ডাকটিকিট চালু ছিল। সে ক্ষেত্রে ডাকটিকিটে “পাকিস্তান” শব্দটির ওপর “বাংলাদেশ” শব্দটি ওভারপ্রিন্ট করা হতো। ১৯৭৩ সালের ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত এমনটা করা হয়েছিল। আর পাকিস্তানি খাম–পোস্টকার্ডের ব্যবহার ছিল ১৯৭৪ সালের ৬ অক্টোবর পর্যন্ত। এর মধ্যে অল্প কিছু খামের ওপর পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টাররা লিখে দিয়েছিলেন, “এই পোস্ট অফিসে এই রবার স্ট্যাম্পটি পাকিস্তানি স্ট্যাম্পের ওপর ব্যবহৃত হচ্ছে”।’

এ ধরনের ডাকটিকিটের সংখ্যা কম বলে শেখ শফিকুল ইসলামের এই সংগ্রহও মূল্যবান। তাঁর ভাষায়, ‘এই সংগ্রহটি আমার খুব প্রিয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের সাক্ষী এই ডাকটিকিট বা খামগুলো নিছক কাগজের টুকরা নয়, আরও বেশি কিছু।’

মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে বাংলাদেশে ডাকঘরের যাত্রা শুরুর পুরো সময়টার ডাকটিকিট, খাম, পোস্টকার্ডসহ নানা কিছু সংগ্রহ করেছেন শেখ শফিকুল ইসলাম। এসব নিয়ে পোস্ট অফিস রাবারপ্রিন্ট ‘বাংলাদেশ’ অন পাকিস্তান স্ট্যাম্প অ্যান্ড পোস্টাল স্টেশনারি ১৯৭১–১৯৭৪ নামে একটি বই–ও প্রকাশ করেছেন ২০১৫ সালে। বইটির জন্য ২০১৬ সালে নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড স্ট্যাম্প শোতে ‘লার্জ সিলভার’ পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। বইটির নতুন সংস্করণ করছেন প্রভিশনাল ওভারপ্রিন্টস ক্ল্যাসিফিকেশন নামে। এ পর্যন্ত এই সংগ্রহের জন্য পেয়েছেন ১৫টি পুরস্কার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের চিঠির খাম

১৯৭৪–৭৫ সালের কথা। শেখ শফিকুল ইসলাম তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুলতানপুরে সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন। ‘সে সময় আমাদের আত্মীয় পীর শাহ মঈনুদ্দীন চিশতির বাড়িতে গিয়ে গুপ্তধনের খোঁজ পেলাম!’ বলছিলেন শফিকুল, ‘তখন পিয়নের পেছন পেছন সারা দিন ঘুরতাম একটা ডাকটিকিটের জন্য। ওই বাড়িতে গিয়ে মনে হলো, এ তো গুপ্তধন। বড় এক ঘরের ছাদে ঝুলে থাকতে দেখলাম অনেকগুলো খাম। ব্যস, হাজারো মাকড়সার জাল দুহাতে সরিয়ে সেগুলো নামিয়ে আনলাম। অনেক চিঠি। অধিকাংশই আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বাঙালি সৈনিকদের লেখা। পীর সাহেবের মুরিদ হিসেবে লিখেছিলেন তাঁরা। ওগুলোর মূল্য বোঝার বয়স তখন আমার ছিল না। কেবল ডাকটিকিটগুলোই নিয়ে এসেছিলাম।’

দীর্ঘ ২০ বছর পর শফিকুল ঠিকই উপলব্ধি করলেন, গুপ্তধনের কিছুই তো তিনি নিয়ে আসেননি। ফলে আবার ফিরে গেলেন ওই বাড়িতে। আগের চেয়েও আরও অযত্নে পড়ে ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকদের লেখা চিঠির খামগুলো। গুরমুখী, আরবি, রোমান, উর্দু—কত ভাষায় লেখা সেসব চিঠি! এগুলোর গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে ‘সেন্সর’ করার কারণে। অর্থাৎ চিঠির অনেক কিছুই মুছে দেওয়া হয়েছিল। এই সংগ্রহ শেখ শফিকুল ইসলামকে এনে দিয়েছে ৫টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার।

যুগে যুগে বৈশ্বিক যোগাযোগ

অধিকাংশ নবীন ডাকটিকিট সংগ্রাহকের বেলায় রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলার এই কথাগুলো খুব খাটে, ‘ইচ্ছেমতো কুড়িয়ে-বাড়িয়ে যা পেয়েছি ঝুলি ভরতি করেছি তাই দিয়েই’। কিন্তু শেখ শফিকুল ইসলামের পরামর্শ, ‘নতুন যারা ডাকটিকিট সংগ্রহ করছে, তারা একটা বিষয় বেছে নিলে ভালো করবে। যা পাই তা–ই সংগ্রহ করি—এমনটা হলে জট পাকিয়ে যায়। আমি যেমন এই সংগ্রহটি সাজিয়েছি বৈশ্বিক যোগাযোগ নিয়ে।’

কী আছে এই অ্যালবামে? বতসোয়ানার ডাকটিকিটে দেখা যাচ্ছে গুহাচিত্র, অস্ট্রিয়ার ডাকটিকিটে টাইপরাইটার, ভারতের ডাকটিকিটে টেলিফোন আবার যুক্তরাষ্ট্রের ডাকটিকিটে শিক্ষক–শিক্ষার্থীর কথোপকথন। যোগাযোগের প্রায় সব মাধ্যমই উঠে এসেছে এই সংগ্রহে। এমনকি সংগীত তারকার সঙ্গে শ্রোতার যোগাযোগ কিংবা স্যাটেলাইটের মতো বিষয়ও বাদ যায়নি। শেখ শফিকুল ইসলামের ভাষায়, ‘পৃথিবীটাই চলছে যোগাযোগের কারণে। যোগাযোগ কোথায় নেই? আদিম যুগ থেকে এই আধুনিক যুগের যোগাযোগব্যবস্থা ডাকটিকিটে দেখা যায়। আমি সেসব নিয়েই গবেষণা ও সংগ্রহ করেছি। সংগ্রহটির জন্য গত বছর “ফোর নেশনস স্ট্যাম্প এক্সিবিশনে” লার্জ ভার্মিল পেয়েছি আমি।’