Thank you for trying Sticky AMP!!

সঙ্গী তাঁর সাইকেল

সাইকেলে এলিজা পাড়ি দিয়েছেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। ছবি: সংগৃহীত

টানা তিন দিন বিছানায় কাটানোর মানুষ তিনি নন। কিন্তু বিছানাটা যেহেতু হাসপাতালের জরুরি বিভাগের; তাই তিনি বিছানাবন্দী। থাকতে হবে হয়তো আরও কয়েকটা দিন। ২ মার্চ ‘ঢাকা হাফ ম্যারাথন’ নামের একটি আয়োজনে অংশ নিয়ে দৌড়ানোর সময় চোট পেয়েছেন; এরপর থেকে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি এলিজা আহমেদ।

শয্যাশায়ী থাকলে হবে কি, মনকে তো আর বন্দী রাখা যায় না। ৪ মার্চ সকালে আমাদের আলাপের খানিকটা আগে নার্স এসে ব্যথানাশক ইনজেকশন দিয়ে গেছেন। বললেন, ‘চিনচিনে ব্যথাটা এখন আর নেই। কিছুটা সুস্থবোধ করছি।’ তাই হয়তো খানিকটা ভাবনায় ডুবে ছিলেন। জিজ্ঞেস করি, কী ভাবছিলেন? ‘আগামী মাসের দিকে সাইকেল নিয়ে ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে। সে অভিযানের অনেকটা প্রস্তুতি এখনো বাকি। আমার অনেক দিনের স্বপ্নের ট্যুর। ভালোয় ভালোয় এখন এমআরআই রিপোর্টটা পেলে হয়।’ এলিজা আহমেদের কণ্ঠে একই সঙ্গে উচ্ছ্বাস আর উৎকণ্ঠা ভর করে।

হাসপাতালে থাকা একজন মানুষের মুখে এমন কথা শুনে বিস্ময় জাগতে পারে, কিন্তু এলিজা আহমেদকে যাঁরা চেনেন; তাঁরা বলবেন, ‘ও তো এমনই!’ বলবেই না কেন; এলিজার জগৎজুড়ে যে কেবল পড়াশোনা-সাইকেল-দৌড়-ফুটবল-ভলিবল-পর্বতারোহণ-দুর্গত এলাকায় ত্রাণ নিয়ে ছুটে চলা—এসবই।

তবে নানা প্রতিভার এলিজা আহমেদ পরিচিতি পেয়েছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সাইকেল হাঁকিয়ে। গত বছর কক্সবাজার জেলার টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার পথ একা পাড়ি দিয়ে তিনি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধায় পৌঁছান। পথের বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে এ কাজটি একজন নারীর জন্য নিঃসন্দেহে অনেক বড় ব্যাপার। আমরা তাঁর সে বিশাল ব্যাপারের গল্পই নতুন করে শুনছিলাম।

গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের কথা। এলিজা তাঁর সব সময়ের চলার সঙ্গী ট্রেক ৬৫০০ মডেলের সাইকেলসহ গেলেন কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায়। অনেক দিনের স্বপ্নপূরণের এক দুর্নিবার প্রাণশক্তি ততক্ষণে এলিজাকে পেয়ে বসেছে। ‘আমার পরিচিত অনেকেই সাইকেলে সারা দেশ ভ্রমণ করেছেন। আমি নিজেও বহুবার বেরোনোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। তাই সে সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি।’ বলছিলেন এলিজা আহমেদ।

কিন্তু তাঁর পকেটে তখন মোটে ১৫০০ টাকা। পথ না হয় সাইকেলেই চললেন। থাকা, খাওয়া আর আনুষঙ্গিক খরচ? ‘তখন আসলে টাকার চিন্তা মাথায় আসেনি। যেমন আসেনি পথের বিপদ কিংবা একজন মেয়ে হিসেবে আরও যত সমস্যায় পড়তে পারি, সেসব চিন্তা।’ যোগ করেন এলিজা।

এমন প্রাণশক্তির জোরেই শাহপরীর দ্বীপ থেকে সাইকেলের প্যাডেলে ভর দিলেন তিনি। ২৮ সেপ্টেম্বর শুরু হলো স্বপ্নপূরণের যাত্রা। এলিজার এ যাত্রা শেষ হয় ৬ অক্টোবর। ততক্ষণে পৌঁছে গেলেন বাংলাবান্ধা।

পথে কোনো সমস্যা হয়নি? এলিজা বললেন, ‘সমস্যার চেয়ে বরং সহায়তা পেয়েছি বেশি। র‍্যাম্বল রাইডার্স নামের একটি সাইক্লিস্ট দলের সঙ্গে যুক্ত আমি। যাত্রা শুরুর আগে ফেসবুকে ওই দলের অনেকে র‍্যাম্বল রাইডার্সের পেজে পোস্ট দিতেন। তারপর সারা দেশের সাইক্লিস্টরা যোগাযোগ করত, তাদের এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় যেকোনো সহায়তা করত। আর ইভ টিজিংসহ যে ধরনের সমস্যায় নারীরা পড়ে, সেগুলো আমি নিজেই সামলে নিতে পারি।’

৯ দিনের সাইকেলযাত্রায় তিনি আটটি জায়গায় রাত কাটিয়েছিলেন। বেশির ভাগ জায়গায়ই ওই সব অঞ্চলের সাইক্লিস্টরা সহযোগিতা করেছেন। কোথাও কোথাও আবার সাইক্লিস্টরা পথে এগিয়ে দিয়েছেন। পাশে দাঁড়িয়েছে হিমু পরিবহন, বিকন নাট্যকেন্দ্রসহ বিভিন্ন সংগঠন। এই পথ পেরোনোটা তাঁর জন্য ছিল পর্বত জয়ের মতোই অ্যাডভেঞ্চার।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার মেয়ে এলিজা রাজধানীর দ্য ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টস অব বাংলাদেশে (আইসিএমএবি) কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিং (সিএমএ) বিষয়ে পড়ছেন। এলিজা বললেন, ‘কোর্সের প্রথম পর্ব শেষ করেছি। পড়াশোনা ঠিক রেখেই বাকি কাজ করি। তাই হয়তো সব সময় মা-বাবা ও ছোট দুই ভাইবোনের সমর্থনটুকু পাই।’

সমর্থন পেয়েছেন বলেই স্কুল থেকেই ফুটবল-ভলিবলসহ বিভিন্ন দলে যুক্ত হয়েছেন। শখের বশে শিখেছেন সাইকেল চালানো। কিন্তু সাইক্লিস্ট হয়ে ওঠা? ‘সে আরেক গল্প’, ছোট বাক্যে বললেন এলিজা। সে গল্পটা এমন, উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ২০১৩ সালে তিনি চলে আসেন ঢাকায়; রাজধানীতে যানজটের কারণে সাইকেল ব্যবহার করা শুরু করেন। ফেসবুকে খোঁজ পান হোন র‍্যাম্বল রাইডার্স নামের একটি সাইক্লিস্ট দলের। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে যুক্ত হন এ সংগঠনের কার্যক্রমে। তারপর থেকে ওই দলের সদস্যদের সঙ্গে সাইকেল চালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরেন। অংশ নেন বিভিন্ন ইভেন্টে, যুক্ত থাকেন সংগঠনটির প্রশাসনিক কাজে। আর এই যুক্ততাই তাঁকে স্বপ্ন দেখায় নতুন কোনো অভিযানের, রোমাঞ্চকর যাত্রায় বেরিয়ে পড়ার। ম্যারাথনে দৌড়াতে গিয়ে চোট পাওয়ার মতো ঘটনা হয়তো তাঁর রোমাঞ্চকর যাত্রায় বাধা সৃষ্টি করে, কিন্তু দমাতে তো পারে না। তাই এই অদম্য এলিজা আহমেদের জন্য আমাদের শুভকামনা।