Thank you for trying Sticky AMP!!

সিনেমার মতো জীবনের গল্প

ইভান রাকিতিচ। ছবি: এএফপি
এই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলছে ক্রোয়েশিয়া। আজ নিশ্চয়ই বুকভরা রোমাঞ্চ, স্বপ্ন আর দৃঢ়তা নিয়ে তারা মাঠে নামবে। কিন্তু মাঠের বাইরেও যে ফুটবলারদের একটা অন্য জীবন থাকে, সে কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন ইভান রাকিতিচ। ক্রোয়েশিয়ার এই মাঝমাঠের খেলোয়াড় পুরো টুর্নামেন্টেই দারুণ খেলেছেন। পড়ুন দ্য প্লেয়ারস ট্রিবিউনে লেখা তাঁর নিবন্ধ।


হলিউডের জন্য আমার কাছে একটা গল্প আছে। রোমান্টিক কমেডি বলতে পারেন। কিন্তু কাহিনিটা সত্যি। প্রথম দৃশ্যটা হতে পারে এমন—একদিন ক্রোয়েশিয়ার এক লোক একটা পানশালায় প্রবেশ করল...

২০১১ সাল। আমার বয়স তখন ২১। আমি যখন স্পেনে পৌঁছেছি, তখন অনেক রাত। প্রায় ১০টা বাজে। ৪ বছর জার্মানির শালকেতে খেলার পর পরদিন সকালেই স্পেনের ফুটবল ক্লাব সেভিয়ার সঙ্গে আমার যাত্রা শুরু হওয়ার কথা। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। শুধু মেডিকেল টেস্ট আর কিছু কাগজপত্র সই করা বাকি।

আমার সঙ্গে ছিল বড় ভাই ডেজান। হোটেলে পৌঁছে ক্লাবের আরও কিছু লোকের সঙ্গে আমরা নৈশভোজ সেরে নিলাম। কী কারণে জানি না, আমার একটু নার্ভাস লাগছিল। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, রাতে আমার ঘুম হবে না। ভাইকে বললাম, ‘চলো, একটা কিছু পান করা যাক।’

তখনো জানতাম না এই একটা বাক্য আমার জীবন বদলে দেবে।

হোটেলের পানশালায় খাবার পরিবেশন করছিল যে মেয়েটি, সে এককথায়...অপূর্ব! এটা চলচ্চিত্রের সেই দৃশ্য, যেখানে সবকিছু স্থির হয়ে যায়...বুঝতেই পারছেন। অদ্ভুত সুন্দর! আপনমনেই বলে উঠেছিলাম, ‘বাহ্! সেভিয়া জায়গাটা তো মন্দ নয়!’

সেদিন ‘ওলা’ (স্প্যানিশ ভাষায়: হ্যালো) ছাড়া তাঁকে আর কিছুই বলতে পারিনি। কারণ, আমার স্প্যানিশ শব্দভান্ডারে এই একটি শব্দই ছিল। স্প্যানিশ ছাড়া আমি জার্মান, ইংরেজি, ইতালীয়, ফ্রেঞ্চ, ক্রোয়েশিয়—সব ভাষাই জানতাম। পোড়াকপাল আর কাকে বলে! এমন সময় আমার ভাইকে ইউরোপিয়ান ক্লাবের এক কর্তাব্যক্তি ফোন করলেন। বললেন, আমার সেভিয়ায় যোগ দেওয়ার খবর তাঁরা পেয়েছেন। তাঁরা চান, আমি যেন চুক্তি সম্পন্ন না করে ফিরে যাই। তাঁরা আমাকে নিতে আগ্রহী। এমনকি একটা প্লেন পাঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবও তাঁরা করলেন।

সেভিয়ার সঙ্গে তখনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়নি। স্পেন আমার জন্য অচেনা দেশ। নতুন জায়গা, নতুন ভাষা। কাউকে চিনি না। অতএব, প্লেন ধরার প্রস্তাবটা আমার জন্য বেশ ভালো ছিল।

ভাই বলল, ‘তো, কী করতে চাও?’

বললাম, ‘আমি সেভিয়ার প্রেসিডেন্টকে এরই মধ্যে “হ্যাঁ” বলে দিয়েছি। আমার মুখের কথার দাম একটা সইয়ের তুলনায় বেশি।’

ভাই বলল, ‘ঠিক আছে। আমি ওদের বলে দিচ্ছি।’

এবার আসল কথাটা বললাম, ‘ওই মেয়েটাকে দেখছ? আমি সেভিয়ায় খেলব, আর ওকে বিয়ে করব।’

আমার ভাই হেসে ফেলল। বলল, ‘ঠিক আছে, তা-ই হোক।’ সে ভেবেছিল, আমি রসিকতা করছি।

এরই মধ্যে আমাদের খাওয়া শেষ হয়েছে কি না, খোঁজ নিতে মেয়েটি এল। আমি বড় ভাইকে বললাম, ‘আজ রাতে যে ঘুম হবে না, সে ব্যাপারে এখন আমার আর কোনো সন্দেহ নেই। আমরা কি আরও এক গ্লাস পানীয় নিতে পারি?’

পরদিন সেভিয়ার সঙ্গে আমার চুক্তি সই হয়ে গেল। সেই হোটেলে আমি তিন মাস ছিলাম। প্রতিদিন সকালে হোটেলের পানশালায় যেতাম, এক কাপ কফি, একটা ফানটা নিয়ে বসে থাকতাম। আর মুগ্ধ হয়ে তাঁকে দেখতাম!

তাঁর নাম রাকেল। এ ছাড়া আর কিছু জানতাম না। সে ইংরেজি জানত না, আমি স্প্যানিশ জানতাম না। প্রতিদিন সকালে তাঁর সঙ্গে একটাই বাক্য বিনিময় হতো, ‘বুয়েনোস দিয়াস, রাকেল। উন কাফে ই উন ফানতা নারাংখা।’ (শুভ সকাল, রাকেল। একটা কফি আর একটা ফানটা চাই।)

কীভাবে বোঝাব জানি না। তাঁর সঙ্গে দেখা হলেই একটা অন্য রকম অনুভূতি হতো। যেন আমার বুকের ভেতর একটা বোম ফুটল! আমি প্রাণপণ স্প্যানিশ শেখা শুরু করলাম। মনের ভাবটা কিছুতেই তাঁকে মুখে বলতে পারি না, তাই ইশারায় বোঝাতে চেষ্টা করতাম।

আমার কাণ্ডকীর্তি ওর কাছে হাস্যকর মনে হতো। একদিন মজা করে বলল, ‘আমি...জেন। তুমি...টারজান।’

কাপের পর কাপ কফি শেষ হলো, কাজের কাজ কিছুই হলো না। প্রায় ২০-৩০ বার আমি তাঁকে বোঝাতে চাইলাম, চলো, আমরা বাইরে কোথাও যাই। সে কখনো না বলেনি। কিন্তু প্রতিবারই কাজের ছুতোয় এড়িয়ে গেছে। তিন মাস পর হোটেল ছেড়ে বাসায় উঠলাম। তবু প্রতিদিন গাড়ি চালিয়ে হোটেলে চলে যেতাম, স্রেফ এক কাপ কফির জন্য। যদি হোটেলে ঢুকে দেখতাম সে নেই, এক দরজা দিয়ে ঢুকে আরেক দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতাম। আর যদি দেখতাম সে আছে, তাহলে তো কথাই নেই!

জোর করে স্প্যানিশ টিভি দেখা এবং স্প্যানিশ রেডিও শোনা শুরু করলাম। দিনে দিনে আমার স্প্যানিশ ভাষার কিছুটা উন্নতি হলো। শুরু হলো টুকটাক কথা বলা। অবশেষে একদিন রাকেল জানাল, কেন সে আমার সঙ্গে কোথাও যেতে চায় না। ‘তুমি একজন ফুটবলার। আজ এখানে আছ, কালই হয়তো অন্য কোথাও চলে যাবে। অতএব, আমি দুঃখিত।’

আমি মনে মনে ভাবলাম, ‘সেরেছে! ও বোধ হয় আমার খেলা দেখে। ও বুঝতে পেরেছে, আমি খুব একটা ভালো খেলছি না। ওর ধারণা, আগামী গ্রীষ্মেই সেভিয়া আমাকে বিদায় করে দেবে।’

এই ভয় আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাল। আরও জোর প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করলাম। যেন সেভিয়ার দলে আমার জায়গাটা থাকে।

অবশেষে একদিন সে রাজি হলো। একসঙ্গে একটা নৈশভোজের সম্মতি পেতে আমার লেগে গেল সাত মাস!

সেই থেকে আমরা একসঙ্গে আছি। ছয় বছর কেটেছে। আমাদের দুটো ফুটফুটে মেয়ে আছে। মাঝেমধ্যে মনে হয় তাঁর সম্মতি পাওয়াই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন কাজ, এমনকি চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার চেয়েও!

একজন ফুটবলার তাঁর আশপাশের মানুষদের দ্বারা কতটা প্রভাবিত হয়, এটা অন্যেরা কখনোই বুঝবে না। যখন আমাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়, সবাই জানতে চায় প্রশিক্ষণের কথা, ম্যানেজারের কথা, আমাদের পরিকল্পনার কথা। বেশির ভাগ সময়ই মাঠের বাইরের খবর কেউ নেয় না। কিন্তু আমার কাছে পরিবারও ক্যারিয়ারের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। গত ছয় বছরে আমি সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, স্পেনে গেছি। কখনো কখনো খুব ব্যস্ত কিংবা খুব একাকী সময় কেটেছে। বাসেল আর শালকেতেও আমি ভালো খেলোয়াড় ছিলাম। কিন্তু তখন মনে হতো, কী যেন নেই।

যখন আমার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলো, তখন মনে হলো, আমি ভালো খেলার একটা কারণ খুঁজে পেয়েছি। এরপরই আমার খেলা একটা অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেল।

ফুটবলের প্রতিটা মুহূর্ত আমি উপভোগ করি। স্বপ্ন পূরণ করতে আমি ১০ বছর আগে সুইজারল্যান্ড ছেড়েছিলাম। আমার খুব সৌভাগ্য, শেষ পর্যন্ত আমার ঠিকানা হয়েছে বার্সেলোনা। আশা করছি, আরও বহু বছর এই জার্সিটা গায়ে দিতে পারব।

যখন এখানে এসেছি, অনেকেই আমার স্প্যানিশ উচ্চারণ শুনে অবাক হতো। তবে সত্যি বলতে, ভালো স্প্যানিশ জানা ছিল বলেই আমি ড্রেসিংরুমের পরিবেশের সঙ্গে দ্রুত খাপ খাওয়াতে পেরেছি। সে জন্য আমার স্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। তাঁর জন্যই আমি টারজান থেকে সেভিয়ার অধিনায়ক হয়েছি, বার্সেলোনার সঙ্গে আমিও চ্যাম্পিয়ন হয়েছি।

আমাদের বড় মেয়েটার বয়স এখন চার বছর। বার্সেলোনায় মানুষ কতটা ফুটবল-পাগল, সেটা সে এরই মধ্যে বুঝতে শুরু করেছে। আমি আর আমার স্ত্রী প্রায়ই অনুমান করতে চেষ্টা করি, ও কি আমার মতো ফুটবলপ্রেমী হবে, নাকি আমার স্ত্রীর মতো; যে কিনা ফুটবল নিয়ে মাথা ঘামায় না। আপাতত মেয়ে আমাদের দুজনের মাঝামাঝি অবস্থানে আছে।

যখন আমি ঘরে বসে ফুটবল খেলা দেখি, মেয়েও আমার সঙ্গে বসে দেখে। বাবাকে ছাড়া অন্য কাউকে গোল করতে দেখলেই সে খেপে যায়। চিৎকার করে বলে, ‘নাআআ! গোল তো তুমি করবে!’

গোলটা মেসি বা সুয়ারেজ যে-ই করুক, তাতে ওর কিছু যায় আসে না। ও শুধু চায়, বাবা গোল করুক। গোল করতে সহায়তা করলে হবে না, গোলই করতে হবে! অতএব, আমি আমার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। মনে হয় এ ব্যাপারে লিওর কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হবে! (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ