Thank you for trying Sticky AMP!!

সূর্য উৎসবে বর্ষবরণ

বছরের শেষ রাতে ফানুস ওড়ানো

সড়কপথের বেহাল অবস্থা। সবার মত তাই—‘ট্রেনে যাব’। সময় বাঁচবে, পেরেশানিও কমবে। কথামতো সূর্য উৎসবের চেয়ারম্যান মেজবাহ য়াযাদ দায়িত্ব নিলেন টিকিট সংগ্রহের। যাত্রীসংখ্যা ২৩। দলে কে নেই? অবসরে যাওয়া ব্যাংকার, সংগীতশিল্পী, সাংবাদিক, আছে আট বছরের তোতনও।

দল বেঁধে আমরা যাব সূর্য উৎসবে। এবার আয়োজনটি ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গীর কালমেঘের নিরাশী পুকুরপাড়।

যাত্রা শুরু হয়েছিল ৩০ ডিসেম্বর। রাত আটটার ট্রেন সেদিন ছাড়ল ১০টায়। তাতে কী! এমন মিলনমেলায় দুই ঘণ্টার অপেক্ষা ব্যাপারই না! নানা বয়সী অভিযাত্রীদের নিয়ে দিনাজপুরগামী দ্রুতযান দ্রুতই এগিয়ে চলে দিনাজপুরের পথে।

বছরের প্রথম সূর্যোদয় দেখার এই আয়োজন ২০০১ সালে শুরু হয়। বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে সূর্য উৎসবে থাকে দেশের নতুন দেখার জায়গাগুলোয় ঘুরতে যাওয়া। সূর্য দেখা। অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প। টেলিস্কোপে গ্রহ-তারাদের দেখা। এসব নিয়েই নানা বয়সী মানুষের এক মিলনমেলা এই সূর্য উৎসব।

সূর্যমুকুট পরে সূর্য উৎসবে। ছবি: সংগৃহীত

একদিন মাটির পৃথিবী হবে ঘর

সে রাতে চলমান ট্রেনে পথচলতি ভিক্ষুকের সুরেলা কণ্ঠের আহ্বান আর দোতারার মূর্ছনায় চোখ মেলে দেখি দিনাজপুর। তবু কানে বাজতে থাকে তার সুর—‘একদিন মাটির পৃথিবী হবে ঘর...’। দিনাজপুর থেকে সংযুক্ত ট্রেনে চলে আসি ঠাকুরগাঁও। স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মী সাহিদ চৌধুরী দলকে অভ্যর্থনা জানালেন। আগে থেকে ঠিক করা বাসে পৌঁছে যাই একদম গন্তব্যে।

সূর্যপুরীর আমগাছ

সূর্য দেখতে এসে সূর্যপুরীর আমগাছ দেখব না! সেটা হওয়ার নয়।

নাকে-মুখে দুপুরের খাবার খেয়েই দে ছুট। জনশ্রুতি আছে, আজ থেকে ২০০ বছর আগে এই আমগাছটার জন্ম। সে এক দেখার মতো ব্যাপার বটে। হাত-পা ছড়িয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে গাছটি।

ডালগুলো নিজের ভারে মাটিতে লুটিয়ে আছে। গাছটি জীবন্ত এখনো। প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ জন পর্যটক আসেন এই গাছ দেখতে। ফিরতে পথে সন্ধ্যা নেমে আসে। দূরে আবার কখনো বা কাছেপিঠেই শেয়ালের ডাক শুনতে পাই।

টেলিস্কোপে চাঁদ দেখা

চাঁদ দেখা

সবার মধ্যেই আতঙ্ক ভর করল—রাতে শীতে ভীষণ কষ্ট হবে। তাই সন্ধ্যা নামতেই টেলিস্কোপ নিয়ে খোলা প্রান্তরে। চাঁদ দেখা। চাঁদের গায়ে উল্কার আঘাতে তৈরি হওয়া গর্তগুলো খুব পরিষ্কার। দেখা মেলে জেমিনির ক্যাস্টর আর পোলাক্স, প্রসায়ন, কৃত্তিকা, আলদাবরান। ক্রমে রাতের সঙ্গে কুয়াশা নেমে আসে।

সন্ধ্যা নামতেই সবাই একে একে জড়ো হয় নিরাশী পুকুরপাড়ের উসান পল্লির বড়সড় হলরুমে। মেসবাহ য়াযাদের কথামালা হিবিজিবি শেষে শিল্পী শেখ সাহেদের ‘আড্ডায় আড্ডায় গান’। গান শুনি তৃতীয় শ্রেণির ফারদিন ও তার পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া বোন ফাইয়জার।

শিশুপ্রহর

৩১ ডিসেম্বর ২০১৭। ভোর হয়। দেখা দেয় বছরের শেষ সূর্য। ছোট ছোট শিশুর আনন্দধ্বনিতে ভরে উঠে উৎসব প্রাঙ্গণ। স্থানীয় স্কুলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আয়োজন ছোটদের জন্য বিজ্ঞান। শিশুসংগঠক মোশাররাফ হোসেনের সঞ্চালনায় প্রায় ১৫০ জন শিশু এতে অংশ নেয়। শুভাকাঙ্ক্ষী তারেক আর মিল্লাতের সৌজন্যে সব শিশুকে দেওয়া হয় সূর্য উৎসবের টি-শার্ট।

বিকেলে আকাশে ডানা মেলে নানান রঙের ঘুড়ি। চলে ঘুড়ির সঙ্গে কাটাকাটি। ক্লান্ত অভিযাত্রীদের সঙ্গে ক্লান্ত হয় সূর্য, ডুব দেয় দিগন্তের ওপারে। অভিযাত্রীরা বিদায় জানায় বছরের শেষ সূর্য অস্তকে।

আকাশের কথা মানুষের কথা

এ সময় আকাশে শিকারি কালপুরুষ পূর্ব-দক্ষিণ দিগন্ত দিয়ে ক্রমেই তার যাত্রাপথে এগিয়ে। সঙ্গে নিত্যসহচর ক্যানিস মেজর নক্ষত্রমণ্ডলীর লুব্ধক। আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা লুব্ধকের কথা জানতে জানতে প্রসঙ্গক্রমে জানা হয় মানুষের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তার বিজ্ঞান-ভাবনার উন্মেষকাল।

আনন্দলোকের আহ্বান

ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টা পেরোতেই ফানুস উড়িয়ে আর আলোকসজ্জার মধ্য দিয়ে বরণ করা হয় নতুন বছরকে। স্থানীয় আগ্রহী আর অভিযাত্রীদের উচ্ছল অংশগ্রহণে ক্যাম্পফায়ার করতে করতে আনন্দলোকের আহ্বানের গান আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

লজ্জাবতী সূর্য

বছরের প্রথম দিনের শুরুর এক নিস্তব্ধ সকালে আমরা সমবেত হই নিরাশী পুকুরপাড়। কুয়াশার আড়াল থেকে সূর্যকে দেখা না গেলেও আনন্দ থেমে থাকেনি। নতুন বছরকে বরণ করার সঙ্গে সঙ্গে নিস্তব্ধ সকাল ভরে ওঠে আনন্দ উচ্ছ্বাসে।

শিশুদের নিয়েও আয়োজন ছিল উৎসবে

বসে আঁকো

স্থানীয় শিশুদের নিয়ে আয়োজন ছিল ছবি আঁকার। কেউ বা আঁকছে গাছ কেউ বা গাড়ি আবার কেউ সূর্য। ছিল না কোনো নির্দিষ্ট বিষয়। তাদের মনের মতো করে আঁকার কথা বলা হয়। শিশুদের প্রত্যেককে একটা করে জ্যাকেট আর আঁকার উপকরণ দেওয়া হয়।

সাওঁতাল সন্ধ্যায় সাওঁতাল নৃত্য

কান্তজি মন্দিরে

সবারই আশা ছিল কান্তজির মন্দির দেখার। ফেরার পথে ট্রেন না পেয়ে বাসে। তাতে ভাবনা ছিল কান্তজিউ মন্দির দেখতে গেলে সময় চলে যাবে। ঢাকা ফিরতে রাত গভীর হবে। অভিযাত্রীদের অনেকেই মন খারাপ। বিশেষ করে বিকাশের। শেষে বুড়ি ছোঁয়ার মতো দেখে ঢাকার পথে বাস এগিয়ে চলে। কথা হয়, আসছে ৬ জানুয়ারি শনিবার বিকেল পাঁচটায় উৎসবের সবাইকে নিয়ে হবে আনন্দসভা আর আগামী সূর্য উৎসব হবে সুন্দরবন।

বরাবরের মতো এবারের সূর্য উৎসব আয়োজনের সহযোগিতায় ছিল প্রথম আলো এবং চ্যানেল আই। আর ছিলেন উসান পল্লির ওবায়েদুল হক।