Thank you for trying Sticky AMP!!

সোয়েটার

শীতের রাত। হাড় কাঁপুনি ঠান্ডার সঙ্গে বাড়াবাড়ি রকমের বাতাস। এমন আবহাওয়ায় বিশেষ কাজ না থাকলে কেউ বাইরে থাকে না। মানুষ নেই বলেই হয়তো রাস্তার পাশের দোকানপাট সব বন্ধ।

আমরা গিয়েছিলাম শীতবস্ত্র বিতরণ করতে। অসহায় মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন মিলে আমাদের এ প্রচেষ্টা। সবার কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করেছি। এই টাকায় কিছু চাদর আর সোয়েটার নিয়েছিলাম। কিছু পুরোনো শীতপোশাকও জোগাড় করেছিলাম।

ক্যাম্পাস থেকে কিছুটা দূরে একটা বস্তি আছে। সেখানে বিতরণ করা হলো। একটা পুরোনো সোয়েটার পেয়েও মানুষের মুখের হাসি এমন সুন্দর হতে পারে, সেটা এখানে না এলে বুঝতাম না। যারা শীতবস্ত্র পেয়েছে তারা সবাই ভীষণ খুশি। ছোট-বড় মাপের সোয়েটারগুলো একরকম জোর করেই শরীরে মানিয়ে নিল সবাই। যারা পেল না তারাও খুশি। আমাদেরই খারাপ লাগছিল, আরও বেশি আনতে পারলে ভালো হতো।

বস্তির পাশের রাস্তায় একজন নারী পিঠা বিক্রি করেন। তিনি আমাদের পিঠা বানিয়ে খাওয়ালেন, বাচ্চারা গান গাইল, নাচল, অভিনয় করল। সময় যে কীভাবে কেটে গেল, বুঝলাম না।

বিপত্তি বাধল ফেরার সময়। কোনো যানবাহন পাইনি বলে হেঁটেই ফিরছিলাম। ক্যাম্পাসের কাছাকাছি ল্যাম্পপোস্টের নিচে এক বন্ধ দোকানের সামনে জবুথবু হয়ে কে যেন বসে আছে। গায়ে পাটের বস্তা জড়ানো। মনে হলো মাদকসেবী কেউ পড়ে আছে। আমরা এড়িয়ে যেতে চাইছিলাম, কিন্তু লোকটি আমাদের একজনের নাম ধরে ডাকল। গলা শুনে বুঝলাম জহির ভাই।

: আপনারা এতক্ষণে আইলেন?

: জি ভাই, আপনি এখানে কেন? কিছু বলবেন?

: হ, পোলার সুইটারখান।

এটুকু বলে থেমে যান জহির ভাই। আমাদের ক্যাম্পাসে পপকর্ন বিক্রি করেন তিনি। প্রতিদিন মোটামুটি রাত নয়টার ভেতর ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যান তিনি, আজ হয়তো আমাদের জন্যই এত রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন।

আজ বেরোনোর সময় তাঁর ছেলের জন্য একটা সোয়েটার চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন সবকিছু বাঁধা ছিল, এখানে খোলা সম্ভব ছিল না। তাই ওনাকে বলেছিলাম যে, খুলেই ওনার ছেলের জন্য একটা সোয়েটার আলাদা করে রাখব। কিন্তু বস্তিবাসীদের করুণ অবস্থা দেখে আর জহির ভাইয়ের কথা মনে ছিল না। এ কথাটাই বা এখন ভাইকে বলি কীভাবে।

আমাদের ভেতর হৈমন্তী কথা বলল প্রথমে, ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতে শুরু করল যে ওখানে যাওয়ার পর কী কী হয়েছে। এগুলো কোনোটিই তাঁর প্রশ্নের উত্তর নয়। তবু তিনি ভীষণ আগ্রহ নিয়েই শুনছেন, তাঁর মুখটা খুশিতে জ্বলছে, তিনি অপেক্ষায় আছেন কখন তাঁর ছেলের সোয়েটারের কথা বলব।

একসময় নদী বলে ফেলল যে সব সোয়েটার শেষ। কথাটা মানতে যেন ভীষণ কষ্ট হলো তাঁর। এরপর আমরা যা বলে গেলাম তাঁর কোনটি তিনি শুনলেন আর কোনটি শুনলেন না, সেটা বুঝতে পারলাম না। আমরা তাঁকে বিদায় দিয়ে ভার্সিটির ভেতরে ঢুকে গেলাম।

রুমে যেতে যেতে ভাবছি, আমরা যত সহজে তাঁকে না বলে দিলাম, তিনি কি তত সহজে তাঁর ছেলেকে না বলতে পারবেন?

নওরীন নাহার

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা