Thank you for trying Sticky AMP!!

১৬৬ বছরের লাইব্রেরি

বই পাঠে নিমগ্ন দুই পাঠক। ছবি: এহসান–উদ–দৌল্লা

পড়ন্ত বিকেলের রোদ ঘরজুড়ে। লম্বাটে ঘরের দেয়াল ঘেঁষে বইয়ের তাক। মাঝখানে বসানো লম্বা টেবিলে সারি সারি চেয়ারে বসে আছেন বেশ কয়েকজন নিমগ্ন পাঠক, পড়ছেন। কেউ বই, কেউবা দৈনিক পত্রিকা আর সাময়িকী। ১৬৬ বছর ধরে এভাবেই পড়ুয়াদের নিমগ্ন করে রেখেছে যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি।

যশোর শহরের দড়াটানা চত্বরের পাশেই এই লাইব্রেরির অবস্থান। তিনতলা ভবনটির নাম আঞ্চলিক কেন্দ্রীয় বই ব্যাংক ভবন। ভবনের নিচতলায় ডান পাশে যশোর ইনস্টিটিউটের প্রশাসনিক কার্যালয়। বাঁ দিকে সংবাদপত্র পাঠকক্ষ। এখানে ৩৮টি জাতীয় ও আঞ্চলিক সংবাদপত্র এবং ৮টি সাময়িকী নিয়মিত রাখা হয়। ঘরের চারদিকে বইয়ের তাক।

ব্যবসায়ী সূর্য বিশ্বাস আট বছর ধরে এই লাইব্রেরিতে আসেন পড়তে। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনই আমি এখানে সংবাদপত্র পড়তে আসি। সময় থাকলে সাময়িকীও পড়ি।’

সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে দেখা গেল, ডান পাশে একটি ঘর। এটা রেফারেন্স বিভাগ। এর পাশে বইয়ে ভর্তি তাক। বেশির ভাগ পাঠ্যবই। মাঝে লম্বা টেবিল। সামনে সাজানো চেয়ারে বসে বই পড়ছিলেন তিনজন ছাত্র। তাঁদের একজন রিপন বিশ্বাস বলেন, ‘সবে লেখাপড়া শেষ করেছি। এখন চাকরির চেষ্টা করছি। চার মাস ধরে প্রতিদিন এখানে এসে বিভিন্ন বই পড়ি। মাঝেমধ্যে গল্পের বই পড়ি।’

বাঁ দিকে লাইব্রেরির কার্যালয়। এখানে বইয়ের প্রসেসিং, ক্যাটালগ তৈরি এবং কম্পিউটারে বইয়ের ডেটাবেইস তৈরি করা হয়। সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠে দেখা গেল, বাঁ পাশে একটি বড় কক্ষ। এটা পাণ্ডুলিপি, দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ, সংরক্ষণ এবং সংগ্রহশালা বিভাগ। মাঝখানে কিছুটা ফাঁকা রেখে কক্ষটি সাজানো রয়েছে অনেকগুলো বইয়ের তাকে। তাকগুলো ভরা একাডেমিক ও বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থে। পাশে দুটি টেবিল। টেবিলের ওপর অনেকগুলো পাণ্ডুলিপি রাখা আছে। তার ওপর কাচ দিয়ে ঢাকা রয়েছে। তার পাশে বাঁধাই করা কয়েকটি সংবাদপত্রের স্তূপ। কক্ষের মাঝে দুটি ছোট টেবিল। সামনে চেয়ার। সেখানে বসে বই পড়ছিলেন দুজন ছাত্র।

তালপাতার পাণ্ডলিপি

ডানে রয়েছে অধ্যাপক শরীফ হোসেন গবেষণা হল। এটা মূলত গবেষকদের জন্য। এর মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কর্নার ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের রচনা সম্ভার ও তাঁর গবেষণাকর্ম নিয়ে আছে ‘মাইকেল কর্নার’, কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচনা সম্ভার নিয়ে আছে ‘নজরুল কর্নার’ আর যশোরের ইতিহাস-ঐতিহ্য জানার জন্য আছে ‘যশোর কর্নার’।

পাশের দোতলা ভবনটিতে রয়েছে, লাইব্রেরির বই ইস্যু বিভাগ এবং শিশুদের জন্য রয়েছে শিশু বিভাগ।

সরকারি ছুটি বাদে লাইব্রেরিটি প্রতিদিন বেলা আড়াইটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শুক্রবার সংবাদপত্র পাঠ বিভাগ এবং বই ইস্যু বিভাগ ব্যতীত লাইব্রেরির সব বিভাগ বন্ধ থাকে।

গ্রন্থাগারে যা আছে

গ্রন্থাগারের সংগ্রহে রয়েছে বাংলা, আরবি, ফারসি, উর্দু ও ইংরেজি গ্রন্থসহ দুই শতাধিক পাণ্ডুলিপি। আছে তালপাতার পুঁথি। আছে হাতে লেখা কবি কালিদাসের  পুঁথি। হাতে লেখা মহাভারতও আছে। আছে প্রাচীন রামায়ণ। নলখাগড়ার কলমে আর ভূষা কালিতে লেখা দুর্গাপূজাপদ্ধতির বর্ণনা আছে। এখানে আছে ৯০ হাজার বই। মোট বইয়ের ৬০ শতাংশ উপন্যাস, ৩০ শতাংশ রেফারেন্স বুক ও গবেষণাগ্রন্থ আছে ১০ শতাংশ।

লাইব্রেরির পাঠাগার সম্পাদক এস নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, লাইব্রেরিতে নিয়মিত নবীন-প্রবীণ কবি-সাহিত্যিকদের শনিবাসরীয় সাহিত্য আসর বসে। শনিবাসরীয় সাহিত্য আসর নৈকট্য নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করে।

ইতিহাসের পাতা থেকে

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম পাঠাগারগুলোর একটি যশোরের পাবলিক লাইব্রেরি। ১৮৫১ সালে যশোরের ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর আর সি রেকস যশোরে এই পাবলিক লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৭ সালে নড়াইলের লোহাগড়ার কৃতী সন্তান যদুনাথ মজুমদার যশোর পাবলিক লাইব্রেরি, নিউ আর্য থিয়েটার এবং টাউন ক্লাব মিলে একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। এভাবেই ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় যশোর ইনস্টিটিউট। এরপর এক সরকারি আদেশবলে লাইব্রেরিটি যশোর ইনস্টিটিউটের অঙ্গসংগঠনে পরিণত হয়। ১৯৬০ সালে লাইব্রেরির আধুনিকায়ন শুরু হয়। ১৯৬৪ সালে লাইব্রেরির দ্বিতল ভবন গড়ে তোলা হয়। ১৯৭৮ সালে নির্মিত হয় বই ব্যাংক ভবন।

আঞ্চলিক কেন্দ্রীয় বই ব্যাংক ভবন

১৮৫১ সালে যে প্রতিষ্ঠান যশোহর পাবলিক লাইব্রেরি নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৩ সালে সংশোধিত নামকরণ হয় যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি। দুটি বিশ্বযুদ্ধ, সাতচল্লিশের দেশ ভাগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ ইতিহাসের এসব বড় বড় ঘটনায় যশোহর পাবলিক লাইব্রেরি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকবার জায়গা বদল করতে হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ বিমানবাহিনী ঘাঁটি করেছে যশোর ইনস্টিটিউটে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে যশোর যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখে তার পেছনেও এ প্রতিষ্ঠানের অবদান অপরিসীম। ৩৬ বছর ধরে এই লাইব্রেরিতে কাজ করছেন লাইব্রেরিয়ান আবু জাহিদ। তিনি বলেন, লাইব্রেরিতে বর্তমানে পত্রপত্রিকা পড়ার পাঠকের সংখ্যাই বেশি। প্রতিদিন গড়ে ৩০০ পাঠক খবরের কাগজ পড়তে আসেন। বই পড়তে আসেন গড়ে ৫০ জন।