Thank you for trying Sticky AMP!!

৭ মার্চের ভাষণ, পত্রিকার পাতায়

শেষ ফাল্গুনের দুপুর। সেদিন ছিল না শীত না গরম। আকাশ ছিল পরিষ্কার, কিন্তু চড়া রোদ সেদিন ছিল না। লেখক, প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদ এভাবেই বর্ণনা করেছেন সেদিনের পরিবেশটাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের নির্ধারিত সময় ছিল বেলা দুইটা। কিন্তু বেলা ১১টা বাজতেই জনসমুদ্র সেদিনের রেসকোর্স, আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

৮ মার্চ ১৯৭১-এর দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতা

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের অগ্নিঝরা দিন ৭ মার্চ। ওই দিন বঙ্গবন্ধু দেন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ প্রথম আলোতে এক লেখায় উল্লেখ করেন, ‘তখন রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঝখানে মওলানা ভাসানী রোড এখনকার মতো প্রশস্ত ছিল না। সোহরাওয়ার্দীর দিকেও শতবর্ষী সেগুন ও মেঘশিরীষ ছিল কয়েকটি। উদ্যানটি ফাঁকা। সমাবেশের নির্ধারিত সময় ছিল বেলা দুইটা। বেলা সাড়ে ১১টার সময় কমলাপুর জসীমউদ্দীন রোড থেকে আমি গিয়ে দেখি রেসকোর্স এক জনসমুদ্র। কোনোরকমে আমি ঠাঁই পাই ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের উল্টো দিকে এক গাছের তলায়, যে গাছের ডালেও বসেছিল কয়েকজন। জনতার ভিড়ে ৩২ নম্বর থেকে সভামঞ্চে আসতে বঙ্গবন্ধুর ঘণ্টা খানেক দেরি হয়। প্রথাগত জনসভা নয়, একমাত্র বক্তা বঙ্গবন্ধু। জনতার শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটে। উচ্চারিত হয়: ‘ভায়েরা আমার...।’

৮ মার্চ ১৯৭১-এর দৈনিক ইত্তেফাকের ৬-এর পাতা

৭ মার্চের ভাষণের খবর কেমন গুরুত্ব পেয়েছিল তখনকার সংবাদপত্রে?
পরদিন ৮ মার্চ ২৩ ফাল্গুন সোমবার তখনকার অন্যতম প্রধান দৈনিক ইত্তেফাক খবরটি ছাপে ৮ কলাম ব্যানারে। শিরোনাম ছিল, ‘পরিষদে যাওয়ার প্রশ্ন বিবেচনা করিতে পারি, যদি-’। যদি চারটি দাবি মেনে নেওয়া হয়। শিরোনামের নিচে উল্লেখ করা হয় সেই চার দাবি। ক. অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হয় খ. সমস্ত সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয় গ. নিরস্ত্র গণহত্যার তদন্ত করা হয় ঘ. নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।

শিরোনামের নিচে দেওয়া হয় গর্জে ওঠা বঙ্গবন্ধুর ছবি। এই ছবির ক্যাপশনটা ছিল, ‘....সামরিক বাহিনীকে অবিলম্বে ব্যারাকে ফিরাইয়া লও’।

খবরের পেটে আরেকটি শিরোনাম: ‘আজ থেকে আমার নির্দেশ’। খবরের নিচে আট কলামজুড়ে সমাবেশে উপস্থিত হর্ষোৎফুল্ল লাখো জনতার ছবি। ছবির ওপরে ক্যাপশন, ‘এবার বন্দী বুঝেছে মধুর প্রাণের চাইতে ত্রাণ, জয় নিপীড়িত জনগণ জয়, জয় নব উত্থান’।

৮ মার্চ ১৯৭১-এর দৈনিক সংবাদের প্রথম পাতা

এই সমাবেশের এক পৃষ্ঠা আলোকচিত্র ছাপা হয় ৬-এর পৃষ্ঠায়। ‘চিত্রে রবিবারের রেসকোর্স’ নামে এ পাতায় ছবি ছিল সাতটি। প্রথম ছবিটি ছিল তখন স্বাধিকার আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতির প্রতি দোয়া কামনা বিষয়ে। একটি ছবিতে বঙ্গবন্ধুসহ অন্য নেতারা দুই হাত তুলে জনতার অভিবাদন গ্রহণ করছেন। একটি ছবি শুধু নারীদের। হাতে তাঁদের লাঠি ও বাঁশি। এতে ক্যাপশন লেখা হয়, ‘মা-বোনেরাও আসিয়াছিলেন হাজারে, হাজারে’। একটি ছবি বাসের সারির। ভেতরে, ছাদে উৎফুল্ল জনতা।

৮ মার্চ ১৯৭১-এর দৈনিক সংবাদের ভেতরের পাতা

এদিনের পত্রিকায় সাবহেড দিয়ে ভাষণের পূর্ণ বিবরণ ছাপা হয়। এ ছাড়া একাধিক পার্শ্বপ্রতিবেদন ছাপায় পত্রিকাটি।
তখনকার দিনের আরেকটি প্রধান দৈনিক সংবাদ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সংগত কারণে এ দৈনিকেও আট কলামজুড়ে ছাপা হয়। রিভার্স টাইপে শিরোনাম ছিল: ‘এবার স্বাধীনতার সংগ্রামঃ মুজিব’। খবরটিতে দুই লাইনের শোল্ডার ছিল: ‘সামরিক আইন প্রত্যাহার ও গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিলেই পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিব কি না ঠিক করিব’। ‘নিজস্ব বার্তা পরিবেশক’ পরিবেশিত খবরটির সূচনা ছিল বড় পয়েন্টে। মূল শিরোনামের নিচে বঙ্গবন্ধুর ট্রেডমার্ক ভার্টিকাল ছবি। ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশনা দেন, তা ‘মুজিবের নির্দেশ’ নামে পৃথক আরেকটি শিরোনামে ছাপা হয়। ভেতরে ছাপে ‘শেখ মুজিবের বিবৃতির পূর্ণ বিবরণ’। এই পাতাতেই জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ছবি।

সংবাদে ‘গতকালের রেসকোর্স ময়দান’ শিরোনামে এক কলাম একটি খবর ছাপা হয়। খবরের প্রথম দুটো অনুচ্ছেদ ছিল এ রকম: ‘গতকাল রেসকোর্স ময়দান ছিল পূর্ব বাংলার বিভিন্ন শ্রেণির মুক্তিকামী মানুষের বিচিত্রময় সমাবেশে পূর্ণ।’

‘ধানের দেশ, গানের দেশ, পানির দেশ, এই পূর্ব বাংলার ছাত্র, শ্রমিক-কৃষক, মাঝি-মাল্লা, কামার-কুমার, কেরানি-পিয়ন, সকল স্তরের সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী, মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত, নারী-পুরুষের সেই সমাবেশে ধন-ধান্যে পুষ্পে ভরা, সুজলা-সুফলা পূর্ব বাংলা যেন কালবৈশাখীর রুদ্ররূপে ফাটিয়া পড়ে রেসকোর্স ময়দানে। কণ্ঠে তাহাদের মুক্তির গান, বক্ষে তাহাদের স্বাধিকারের অগ্নি শপথ। রেসকোর্সে বিক্ষুব্ধরূপে যেন গোটা পূর্ব বাংলা উপস্থিত।’