Thank you for trying Sticky AMP!!

'আলোর পাঠশালা' নির্মাণের গল্প

আলোর পাঠশালার শিক্ষকদের রোজ উত্তাল পদ্মা পাড়ি দেওয়ার মুহূর্তটুকু এভাবেই ধারণ করা হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

গন্তব্য রাজশাহীর চরখিদিরপুর। নৌকায় ঘণ্টাখানেকের পথ। যাত্রার শুরুতে পদ্মা নদীকে বেশ শান্তই মনে হচ্ছিল। নৌকা যখন মাঝপথে এসে পৌঁছাল, তখন পদ্মা তার রূপ মেলে ধরতে শুরু করেছে। শুটিং দলের অনেকে তো ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসল। এই মৌসুমেও কী প্রবল স্রোত। নৌকা চালানোয় একটু এদিক-ওদিক হলেই ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। বর্ষা মৌসুমে কী অবস্থা হয়, সেটা ভাবতেই গা শিউরে উঠল। অথচ সঙ্গের আলোর পাঠশালার এই শিক্ষকেরা রোদ–বৃষ্টি আর প্রাণহানির আশঙ্কা মাথায় নিয়ে প্রতিদিন কীভাবে পৌঁছান?

আমরা যাচ্ছিলাম প্রথম আলোর ২০তম প্রতিষ্ঠাবাষির্কী উপলক্ষে প্রথম আলো ট্রাস্ট পরিচালিত স্কুল আলোর পাঠশালার অদম্য এই শিক্ষকদের গল্প তুলে আনতে। সে গল্পই তথ্যচিত্রের মধ্যে আমরা দেখানোর চেষ্টা করেছি। যত ঝুঁকির আশঙ্কাই থাকুক না কেন, তাঁরা প্রতিদিন পাড়ি দেন এই পদ্মা।

ভালোর সাথে আলোর পথে

২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কোন আলোর গল্প নিয়ে নির্মিত হবে তথ্যচিত্র, তাই নিয়ে বিস্তর আলাপ চলছিল প্রথম আলোর কার্যালয়ে। সম্পাদক মতিউর রহমানের নেতৃত্বে ছিলেন ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ, সহযোগী সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমীনসহ অনেকেই। তাঁদের কাছে দুটি অসাধারণ বিজয়ের গল্প থেকে প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে গড়া পদ্মাপাড়ের পাঠশালার গল্প নিয়ে কাজ করার ইচ্ছার কথা বললাম। মিলল সবার সম্মতি। প্রথম আলোর সঙ্গে কাজ করার মজাটা এখানেই, অবাধ ‘ক্রিয়েটিভ ফ্রিডম’ পাওয়া যায়।

ক্যামেরায় ধরা হচ্ছে চরখিদিরপুরের জীবন।

যাত্রা হলো শুরু

আনিস ভাই বললেন, ‘রনি তোমার টিম নিয়ে চলে যাও রাজশাহী, সময় একদম নাই।’ প্রথম আলোর ব্র্যান্ড ম্যানেজার জাবেদ সুলতান ফোন করলেন রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ ভাইকে। আমাদের পপকর্ন টিমের যাত্রা হলো শুরু।

শুরুতে রাজশাহীতে ছোট একটা দল গিয়েছিল পর্যবেক্ষণ করতে। লোকেশন দেখে, সাহসী মানুষদের গল্প সামনাসামনি শুনতে। ২৮ অক্টোবর সকালবেলা আজাদ ভাইয়ের সঙ্গে রাজশাহীর টি-বাঁধে বসে শুরু হলো গল্প শোনা। একটু পরই পাড়ি দেব প্রমত্তা পদ্মা। পৌঁছাব চরখিদিরপুরে। চরের আলোর পাঠশালা নিয়ে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন করেছিলেন আজাদ ভাই, সেটা পড়ে গিয়েছিলাম আগেই। সামনাসামনি শুনতে গিয়ে অজান্তেই আবেগতাড়িত হয়ে পড়ছিলাম বারবার।

আলোর পাঠশালার শিক্ষকেরা প্রতিদিন শহর থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই পদ্মা পাড়ি দিয়ে চরে পৌঁছান। প্রতিদিন জীবনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে আলো ছড়াতে যান ওই প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলের ছেলেমেয়েদের কাছে। কীভাবে সেটার চিত্রধারণ করলে সত্যিকারের বিজয়গাথা ফুটে উঠবে, তাই নিয়ে শুরু হলো আমার মধ্যে বোঝাপড়া। গল্প শুনতে শুনতে নিজেকে মনে মনে বললাম, এই অকুতোভয় শিক্ষকেরা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে পড়াতে যান, সেই প্রতিদিনের ঝুঁকিপূর্ণ নৌকাযাত্রায় যে আবেগ-ভালোবাসা আর শক্তি লুকিয়ে আছে সেটাকে ধারণ করতে।

চিত্রগ্রাহক নাজমুল হাসানকে বললাম, আমাদের এবারের দৃশ্যায়নের মূল লক্ষ্য থাকবে সহজ উপস্থাপন, দৃশ্যায়নে বাড়তি চাপ লাগে, এ রকম দৃশ্য ধারণ করব না, একদম সরলভাবে বিজয়ের গল্প বলব।

তিনি যেন আমার মা

শুটিং শুরুর আগেই তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় আর ভালোবাসায় আবেগতাড়িত হতে থাকলাম। চরখিদিরপুর যখন পৌঁছালাম তখন প্রায় দুপুর। নদীর ঘাটে নৌকা পৌঁছাতেই পাড়ে দাঁড়িয়ে প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে গড়া আলোর পাঠশালার সাইনবোর্ড আমাদের স্বাগত জানাল। গেলাম স্কুলে। কী সুন্দর যত্নে গড়া স্কুল। ছেলেমেয়েরা হাস্যোজ্জ্বল লেখাপড়া করছে। শিক্ষকেরা আমাদের খুব আন্তরিকতার সঙ্গে অভ্যর্থনা জানালেন। প্রধান শিক্ষিকা রেজিনা খাতুনের সঙ্গে কথা বলেই মনটা বড় হয়ে গেল, এত সাধারণ একজন মানুষ অথচ কী অসাধারণ সফলতার সঙ্গে পরিচালনা করছেন স্কুলটাকে। আমার মা একজন শিক্ষক, এই কারণেই কিনা জানি না তাঁকে আমার মায়ের মতো মনে হতে থাকল।

স্কুল পরিদর্শন শেষে আমরা ঘুরতে বের হলাম গ্রামটা। সহজ সাধারণ জীবনযাপন, বিদ্যুৎ নেই, বেশির ভাগ মানুষ খেতে কাজ করছে। মাত্র কয়েক মিনিট হেঁটেই পৌঁছে গেলাম গ্রামের শেষ সীমান্তে। ওই তো দেখা যায় ভারত। গ্রামটার তিন দিকে ভারত সীমান্ত, শুধু এক দিকেই মানুষ চলাচল করতে পারে। সেটাও নৌপথে।

লোকেশন দেখে শহরে ফিরে এসে পরের দিন পুরোটা সময় আমরা কাটালাম চিত্রনাট্যের কাজে। শুধু হোটেল থেকে রাতে একবার বের হলাম রাজশাহী শহরের তালাইমারীর বিখ্যাত বট–পরোটা খেতে।

শুটিং আটকাল মহাসড়কের জটে!

শুটিংয়ের সময় আগের রাতেই ঠিকঠাক। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে শুনলাম হতাশার কথা। নির্বাহী প্রযোজক সাগর জানাল, ঢাকা থেকে যে কারিগরি দল ক্যামেরা, আলোকসজ্জার সরঞ্জাম নিয়ে পৌঁছানোর কথা ছিল, তারা আটকে আছে মহাসড়কের জটে।

কী করব তখন? সকালের ম্যাজিক আওয়ার লাইটটা মিস করব। মন খারাপ হতে থাকল। শুটিং পরিকল্পনায় পরিবর্তন করতে হলো। পরদিন যা শুটিং করার কথা ছিল, তা এগিয়ে নিয়ে এলাম। সহকারী পরিচালক কনক রাজশাহীর ছেলে বলে দ্রুতই সব ব্যবস্থা করে ফেলল।

চরের পথ ধরে হেঁটে চলা আলোর পাঠশালার শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত

শুরু হলো শুটিং

রেজিনা খাতুনের বাসা থেকে শুরু হলো শুটিং। এরপর পদ্মাপাড়ের লাইফ জ্যাকেট পরার দৃশ্য। কেউ কখনো ক্যামেরার সামনে কোনো দিন দাঁড়াননি অথচ কী নিষ্ঠার সঙ্গে যা বলছি তাই শুনে যাচ্ছেন। তাঁদের কর্মনিষ্ঠার প্রতি শ্রদ্ধা বাড়তে থাকল। পদ্মার যাত্রাপথে দৃশ্যধারণ করতে থাকলাম আমরা। মোট তিনটি নৌকা, একটিতে ক্যামেরা ও লাইট, অন্যটিতে অন্য সরঞ্জাম, আর যে নৌকাটিতে প্রতিদিন পদ্মা পাড়ি দেন শিক্ষকেরা সেটি। নদীতে দৃশ্যধারণে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শুরু হলো, নৌকার অবস্থান ঠিক রাখা। রীতিমতো হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলাম। ওদিকে দ্রুত সময় চলে যাচ্ছিল। চরখিদিরপুরে পৌঁছানোর পর আমাদের নৌকার ড্রোন শট নেওয়ার কথা। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল ড্রোন চলছে না। একটার পর একটা শুটিংয়ের এই ঝামেলা প্রথম দিনই আমাদের চ্যালেঞ্জটা আরও কঠিন করে তুলল।

পরদিনই শেষ শুটিং, যা করার করে ফেলতে হব দ্রুত। শেষ দিনে আমরা কল টাইম দিলাম ভোর চারটায়। ভোরের সূর্যকে আজ ধরে ফেললাম আকাশে উঁকি দেওয়ার আগেই। সূর্যোদয়ের দৃশ্য শুটিং করে মনটা ভরে গেল। চিত্রগ্রাহক নাজমুল বেশ নির্ভার হলো। শুরু হলো আমাদের দুজনের একটার পর একটা দৃশ্য ধারণ।

কোনো কোনো শট আমাদের বেশ শান্তি দিতে থাকল। স্কুলের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীদের ও চরখিদিরপুরের গ্রামবাসীর সহযোগিতায় আমাদের উৎসাহ যেন বেড়েই চলল। রাতের মধ্যে শুটিং শেষ করে ইউনিট ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলো।

পর্দায় ভাসল আলোর পাঠশালা

সম্পাদনা টেবিলের চ্যালেঞ্জটাও কম ছিল না। কোনটা ফেলে দেব আর কোনটা  রাখব—এই দ্বিধা ক্রমেই বাড়ছিল। তবে সম্পাদক টিপুর অক্লান্ত পরিশ্রমে আমরা তৈরি করলাম ‘ফার্স্ট কাট’। চিরকুটের নীরব সারা রাত ধরে তৈরি করল গান। রোহিতের কণ্ঠ, রিপন নাথ সাউন্ড-ডিজাইন করার পর পুরো আলোর পাঠশালা আলোর মুখ দেখল।

চ্যালেঞ্জের অপেক্ষায়

প্রতিবছর যখন প্রথম সংস্করণ দেখাতে প্রথম আলো কার্যালয়ের দিকে যাই, তখন নার্ভাস লাগতে থাকে। এবারও পছন্দ হবে তো সবার? সম্পাদক মতিউর রহমানের ঘরে যখন সবাই মিলে প্রিভিউ শেষ হওয়ার পর হাততালি দিয়ে উঠলেন, তখন আমার মনে হলো, হয়তো আলোর পাঠশালার অকুতোভয় শিক্ষকদের কথা কিছুটা হলেও তুলে ধরতে পেরেছি।

তারপর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রশংসিত হওয়ার পর অনলাইনে সবাই যখন আলোর পাঠশালা দেখার পর সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করতে থাকেন আমি তখন অনুপ্রাণিত হতে থাকি, অপেক্ষা করি আবার অক্টোবর কবে আসবে। আবার কোনো সাহসী বিজয়ীদের গল্প বলতে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ব, প্রবল উৎসাহে।