Thank you for trying Sticky AMP!!

ফরিদপুরের যে শতবর্ষী কলেজে জড়িয়ে আছে হাজারো শিক্ষার্থীর ভালোবাসা, আবেগ

এখানেই কাটে অনেকের জীবনের মধুরতম সময়

সুমি খাতুন ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের গণিত বিভাগের ‘ফার্স্ট গার্ল’। এই বিভাগ থেকে স্নাতক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন তিনি। পেয়েছেন এ এফ মজিবুর রহমান ফাউন্ডেশনের স্বর্ণপদক। এখন এই কলেজেই স্নাতকোত্তর করছেন। সুমি বলছিলেন, ‘ছোটবেলা থেকে রাজেন্দ্র কলেজের অনেক নামডাক শুনেছি। সে জন্যই ভর্তি হওয়া। এখানকার গোছানো পরিবেশ, শিক্ষকদের আন্তরিকতা, পড়ালেখার মান, সহপাঠীদের সহমর্মিতা—এসব কারণে ক্যাম্পাসটা আপন হতে সময় লাগেনি। আজ বলতেই পারি, এই প্রাঙ্গণেই জীবনের মধুরতম সময়টা কাটিয়েছি।’

সুমির কথার শেষ অংশের সঙ্গে নিশ্চয়ই কলেজের অনেক শিক্ষার্থীই একমত হবেন। ১০৬ বছর পেরোনো এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারো ছাত্রছাত্রীর ভালোবাসা, আবেগ।

শত বছরে কলেজটিকে অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কখনো মনে হয়েছে কলেজের স্বকীয়তা বুঝি হারিয়ে গেল। আবার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে এই প্রাঙ্গণ। আশপাশের ১০ জেলার শিক্ষার্থীদের কাছে বাতিঘর হয়ে আছে সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ।

হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী লক্ষ্মণ মণ্ডল যেমন ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলা থেকে এই কলেজে পড়তে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে রাজেন্দ্র কলেজে অনার্স-মাস্টার্স করার ইচ্ছা ছিল। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর পছন্দের কলেজ হিসেবে শুধু এই কলেজের নামই দিয়েছিলাম। এখন কলেজের যেকোনো অর্জন আমাকেও গর্বিত করে।’

Also Read: ই-পাসপোর্ট থেকে স্বামী বা স্ত্রীর নাম বাদ পড়ল, আর কী কী সংশোধন এল

শত বছরের ইতিহাস

বিশ শতকের শুরুর দিকেও ফরিদপুর ও আশপাশের অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার জন্য কোনো বিদ্যাপীঠ ছিল না। উচ্চশিক্ষা ছিল মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক। ফলে মাধ্যমিক (মেট্রিক) পাসের পর ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেকে আর্থিক অসচ্ছলতাসহ নানা কারণে উচ্চশিক্ষা নিতে পারত না।

অবশেষে তৎকালীন ফরিদপুরের পরিচিত মুখ, নিখিল ভারত কংগ্রেসের সভাপতি ও খ্যাতিমান আইনজীবী অম্বিকাচরণ মজুমদারের উদ্যোগ ও অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৯১৮ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করে রাজেন্দ্র কলেজ। মানবিক বিভাগে মাত্র ২৯ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হয়েছিল পাঠদান কার্যক্রম।

১০৬ পেরিয়ে এখন রাজেন্দ্র কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি। প্রায় সাড়ে ৫ একর জায়গা নিয়ে যে প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু, সেই প্রতিষ্ঠান এখন ৫৪ একরের বেশি জায়গাজুড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাম্পাস হয়েছে দুটি। একটি শহরে, অন্যটি শহরতলির বায়তুল আমান এলাকায়। কলেজে বিভাগের সংখ্যা ২১টি। শিক্ষক আছেন ১৭৯ জন।

ক্যাম্পাসে আছে নানা খেলাধুলার সুযোগ

সাম্প্রতিক নানা উদ্যোগ

ফাহিমা আফরিন, মানিক কুন্ডু, তন্ময় কুমার নাথ, শিউলি বিশ্বাসসহ আরও কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কলেজ ক্যাম্পাসেই কথা হলো। তাঁরা জানালেন, বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে গত দুই বছরে কলেজে নানা নতুন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভর্তি, নিবন্ধন বা পরীক্ষার ফি প্রদান কিংবা ফরম পূরণ এখন ই-পেমেন্ট অ্যাপের মাধ্যমে করা যায়। ফলে এক দপ্তর থেকে আরেক দপ্তরে ছোটাছুটি কমেছে, ব্যাংকে শিক্ষার্থীদের লম্বা সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে না। আগে শিক্ষার্থীদের তথ্য খুঁজে পাওয়া যেত না। এখন ই-পেমেন্ট সফটওয়্যারের মাধ্যমে এক ক্লিকেই সব তথ্য পাওয়া যায়।

কলেজের ওয়েবসাইট আরও কার্যকর হয়েছে। ফল প্রকাশ, প্রবেশপত্র ও নম্বরপত্র প্রদান ইত্যাদি কাজে ওয়েবসাইট ব্যবহৃত হচ্ছে। ই-নোটিশ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিভাগে এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে নোটিশ পাঠানো সহজ হয়েছে। ‘পুশ নোটিফিকেশন’ ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মোবাইল বিভিন্ন বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে। হাজিরা নিশ্চিত করতেও রাখা হয়েছে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি। কোনো শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকলে খবর পৌঁছে যাচ্ছে অভিভাবকের কাছে।

Also Read: নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, এখন বিসিএস ক্যাডার

শৃঙ্খলা বজায় রাখতেও নানা উদ্যোগ নিয়েছে রাজেন্দ্র কলেজ। মাঠের সামনে সীমানা দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল আর টেরাকোটায় ফুটিয়ে তোলা তাঁর জীবনপটও শিক্ষার্থীদের অন্য রকম অনুভূতি দিচ্ছে। হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নামে মুক্তিযুদ্ধ কর্নার স্থাপন করা হয়েছে। মাঠের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে মুক্তমঞ্চ এবং শহীদ মিনারের পাশের চত্বরকে রাজেন্দ্র কলেজ ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে সাংস্কৃতিক চর্চার পথ হয়েছে আরও সুগম।

ক্যারিয়ার ক্লাব গঠন করা হয়েছে। কলেজের জরাজীর্ণ সাইকেল গ্যারেজটি সংস্কার করে গড়ে তোলা হয়েছে পত্রিকা পাঠকক্ষ। রাজেন্দ্র কলেজ সংগ্রহশালা নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শতবর্ষের ঐতিহ্যকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নবনির্মিত ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাসেও তৈরি হয়েছে দুটি অত্যাধুনিক পাঠকক্ষ। কলেজের শতাব্দী ভবনের দশম তলায় গড়ে তোলা হয়েছে বিজ্ঞান ক্লাব। আর অষ্টম তলায় গেলে আপনার দেখা হয়ে যাবে ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে।

শিক্ষকেরা জানালেন, ‘গ্রিন ক্যাম্পাস’ স্লোগানে গত বর্ষা মৌসুমের শেষে কলেজের দুই ক্যাম্পাসে ফলদ ও ভেষজ গাছের চার হাজারের বেশি চারা লাগানো হয়েছে। নামকরণ করা হয়েছে মুজিব শতবর্ষী আম্রকানন ও স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী সফেদাবাগান। চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। প্রাক্তন ছাত্র শহীদ মেজবাউদ্দিন নওফেলকে নিয়ে কলেজের শহর শাখার পূর্ব দিকে শহীদ মেজবাউদ্দিন নওফেল নামে একটি ফটক নির্মাণ করা হয়েছে কলেজের উদ্যোগে।

জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলোর পাশাপাশি সারা বছরই কুইজ প্রতিযোগিতা, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্ক উৎসবের মতো নানা অনুষ্ঠানে সরব থাকে রাজেন্দ্র কলেজ।

ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের মতো ঐতিহাসিক সংগ্রামগুলোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে শতবর্ষী কলেজটি। আজকের শিক্ষার্থীরাও দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে ভূমিকা রাখবে, এমনটাই সবার প্রত্যাশা।

Also Read: পাবনার এই একটি কলেজ থেকেই ৫০ জন সুযোগ পেয়েছেন মেডিকেলে

আমিও এই কলেজের ছাত্র ছিলাম

২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে এ কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। একসময় এই কলেজের ছাত্র ছিলাম বলেই হয়তো রাজেন্দ্র কলেজের প্রতি আমার শ্রদ্ধা, ভালোবাসাটা অন্য রকম। আমি কলেজের জন্য নিবেদিত প্রাণ। যা কিছুই করি না কেন, কলেজের স্বার্থেই করি—এ কথা শিক্ষার্থী, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের বোঝাতে পেরেছি। এ কারণেই অসহযোগিতার চেয়ে সহযোগিতাই পেয়েছি বেশি। গত আড়াই বছরের অধ্যক্ষ–জীবনে আমার মনে হয়েছে, সদিচ্ছা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলে অনেক কিছুই করা যায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এটা আমার প্রতিষ্ঠান, ফরিদপুরের প্রতিষ্ঠান, দেশের প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তোলার অর্থ নিজেকেই মেলে ধরা।
অসীম কুমার সাহা, অধ্যক্ষ, রাজেন্দ্র কলেজ