Thank you for trying Sticky AMP!!

সম্পূর্ণ নতুন এক জগতে নিজেকে প্রবেশ করানোর লড়াইয়ে জয়ী হয়েছেন মোহসিনা

থিয়েটারের মধ্য দিয়ে জীবনটা উপলব্ধি করতে চান মোহসিনা

মোহসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন শেষরক্ষা, ওয়েটিং ফর লেফটিজ, ইন্দুর–বিলাই খেলা প্রভৃতি নাটকে। এর বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটার বিষয়ে পড়ান মোহসিনা

মেয়েটি কখনো অভিনয় করবে, মঞ্চে দাঁড়িয়ে অভিনয়ের নিপুণ সুষমায় ক্ষণে ক্ষণে দর্শককে বিস্মিত করতে করতে বলবে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সেই লাইন, ‘মাথার ওপর শূন্যতা কেবলমাত্র শূন্য নয়’, এতটা সে নিজেও ভাবেনি। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পড়ালেখায় ছিল ‘গুড ফর নাথিং’, ‘পাঠে আমার মন বসে না কাঁঠালচাপার গন্ধে’ টাইপ। তখন টাঙ্গাইল শহরের সাবালিয়া গ্রামে তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে বড় হওয়া মেয়েটি কেবল বিলের ধারে হেসেখেলেই পার করে দিতে পারত সকাল-বিকেল।

‘একবার না পারিলে দেখো শতবার—বরাবর এই মন্ত্র জপতে জপতেই পথ চলেন মোহসিনা

কিন্তু তাঁর নিয়তি যে অন্যত্র বাঁধা। তাই স্কুল-কলেজে ‘ফাঁকিবাজ’ খ্যাতি পাওয়া মোহসিনা আক্তার নামের এই মেয়ে যখন মাধ্যমিক–উচ্চমাধ্যমিকের পাট চুকিয়ে ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো, অন্য কোনো বিভাগেই তাঁর ঠাঁই মিলল না। অগত্যা থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স বিভাগেই ভর্তি হতে হলো। যে মেয়ে অভিনয়ের ‘অ’ জানে না, কেবল ছেলে সেজে কমেডি করে লোক হাসাতে পারে, পড়তে শুরু করল নাট্যকলা। আর তাঁর আত্মীয়স্বজনেরা নাক সিঁটকাল, ‘মেয়ে নাটকে পড়ছে! নষ্ট হলো বলে।’

প্রথম আলো অফিসে বসে মোহসিনা আক্তার সেদিন যখন আমাদের সামনে জীবনের খেরোখাতা মেলে ধরলেন, আমরা দেখলাম এস এম সোলায়মান প্রণোদনাপ্রাপ্ত এ অভিনয়শিল্পীর চলার পথে কেবল সাফল্যের ফুল নয়, কাঁটাও কম ছিল না। নাটক বিষয়ে পড়ার জন্য আত্মীয়স্বজনের গঞ্জনা, মধ্যবিত্ত পরিবারের সাদামাটা একটি মেয়ের ঢাকা শহরে মানিয়ে নেওয়া, এসবের পাশাপাশি ছিল, তাঁর ভাষায় ‘সম্পূর্ণ নতুন এক জগতে’ নিজেকে প্রবেশ করানোর লড়াই।

বলতেই হবে, সেই লড়াইয়ে জয়ী হয়েছেন মোহসিনা আক্তার। তবে তাঁর এই বিজয়ের পেছনে রয়েছে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার গল্প। ‘একবার না পারিলে দেখো শতবার—বরাবর এই মন্ত্র জপতে জপতেই আমি পথ চলি,’ মোহসিনা বললেন। ‘পারি না–পারি নিষ্ঠা আর আন্তরিকতা দিয়ে শুধু থিয়েটারটাই করতে চাই।’

বোধ করি এই ‘নিষ্ঠা আর আন্তরিকতা’র কারণে পড়ালেখায় ‘গুড ফর নাথিং’ মোহসিনা, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে কেবল ‘গুড’ই নন, স্নাতকে রীতিমতো প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং স্নাতকোত্তর পর্বে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম হয়ে গেলেন। এরপর সরকারি বৃত্তি নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব থিয়েটার আর্টসে (গিতিস) নির্দেশনা বিষয়ে পড়তে গেলেন রাশিয়ায়। অবশ্য তার আগেই শিক্ষাজীবনের শেষ প্রান্তে নির্দেশনায় তাঁর হাতেখড়ি হয়ে গেছে। নির্দেশনা দিয়েছেন শেষরক্ষা, ওয়েটিং ফর লেফটিজ, ইন্দুর–বিলাই খেলা প্রভৃতি নাটকে।

২০১৭ সালে জামিল আহমেদের আলোচিত প্রযোজনা রিজওয়ান নাটকে মূল চরিত্র ‘ফাতিমা’ করেছিলেন মোহসিনা

দিনভর ক্লাসে তত্ত্বীয় পড়ালেখার পর কোনোমতে মুখে দুটো গুঁজেই সন্ধ্যায় আবার নাটকের মহড়ায় এ কাজ–সে কাজ, তথা ব্যবহারিক পড়ালেখা—এভাবেই কেটেছে তাঁর পুরো শিক্ষাজীবন। মোহসিনা বলেন, ‘একবার বাবা আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য টাঙ্গাইল থেকে এসে আমার হলের অতিথিকক্ষে দিনভর বসে ছিলেন। আমি নাটকের মহড়ায় ছিলাম, তাই আসতে পারিনি। সেদিন আব্বার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। এ ঘটনায় পরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম।’ এমন কান্না এই অভিনয়শিল্পী অনেকবারই কেঁদেছেন। থিয়েটারের প্রতি একাগ্রতার গুণেই শিক্ষাজীবনেই খ্যাতনামা নাট্যনির্দেশক সৈয়দ জামিল আহমেদের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।

২০১৭ সালে জামিল আহমেদ যখন তাঁর আলোচিত প্রযোজনা রিজওয়ান-এর নির্দেশনা দেন, সে নাটকে মূল চরিত্র ‘ফাতিমা’ করেছিলেন মোহসিনা। একই নির্দেশকের নির্দেশনায় এরপর একে একে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, মন্ত্রাস ৪.৪৮ এবং শেষ সবকিছু বিস্ময়কর নামের ব্যতিক্রমী প্রযোজনায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বারবারই নিজেকে ভেঙেছেন মোহসিনা, গড়েছেনও।

সৈয়দ জামিল আহমেদের নেতৃত্বে এখন তাঁরা গড়ে তুলেছেন স্পর্ধা: ইনডিপেনডেন্ট থিয়েটার কালেকটিভ নামের নাট্যদল। এই সংগঠন থেকে প্রযোজনার পাশাপাশি নিয়মিত নাট্যনির্দেশনা, অভিনয় ও নাট্যরচনার ওপর প্রশিক্ষণ দেন তাঁরা। এর বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটার বিষয়ে পড়ান মোহসিনা। তাঁর কথায়, ‘কেবল থিয়েটার করব বলেই আর কোনো পথে পা বাড়াইনি। আসলে জীবন তো একটাই আর খুব ছোট। তাই যা সব থেকে প্রিয়, তা–ই করতে চাই। থিয়েটারের মধ্য দিয়ে জীবনটা উপলব্ধি করতে চাই...।’