Thank you for trying Sticky AMP!!

সারাহর দেওয়া গাছটা সেরে উঠলেও সারাহ সেরে উঠল না

সারাহ ইসলাম, ইনসেটে ওর দেওয়া গাছ

বছর চারেক আগের এক দুপুরে সারাহ বলল, ‘জানেন ভাইয়া, স্কুলে আজকে কী হয়েছে!’

পাল্টা প্রশ্ন করার আগেই ও বলল, ‘ক্লাস টিচার জানতে চেয়েছিলেন, “কে কী হতে চাও?” আমি কী লিখে দিয়েছি বলেন তো?’

এবারও পাল্টা প্রশ্ন করার সুযোগ দিল না সারাহ। বলল, ‘লিখে দিয়েছি, সান্তা ক্লজ হতে চাই।’

‘দারুণ তো ব্যাপারটা!’ সমর্থন পেয়ে সারাহ খুশি হলো। আর অবশেষে আমি একটা প্রশ্ন করার অবকাশ পেলাম, ‘তো টিচার কী বললেন?’

‘ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন আমি সান্তা ক্লজ হতে চাই। বললাম, সবাইকে উপহার দিতে আমার ভালো লাগে...এসব আরকি।’

‘কিন্তু সান্তা ক্লজ হতে হলে যে তোমার সাদা দাড়ি–গোঁফ লাগবে!’

সারাহর মুখে দৃঢ়তার হাসি, ‘ভাইয়া, আমি কিন্তু সিরিয়াস।’

সারাহর আত্মপ্রতিকৃতি

সারাহ যে পাঠক হিসেবে সিরিয়াস, এটা বুঝতে সময় লাগেনি। ও তখন কোন ক্লাসে? নাইন? নাকি টেন? যা–ই হোক, ও এসেছিল ‘গোল্লাছুট’ আয়োজিত প্রতিযোগিতার গল্প বাছাইয়ে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে। ওরা এসেছিল ৫–৬ জন। মূলত কিশোর আলোতেই কাজ করত ওরা। উদ্ধারকারী জাহাজ ‘হামজা’ হয়ে এসেছিল আমার কাছে। তখন রমজান মাস। কেউ কোচিং, কেউবা টিচারের কাছে পড়া শেষে চলে আসে প্রথম আলো কার্যালয়ে। চিঠির খাম খুলে গল্প পড়তে শুরু করে। কম বয়সী মানুষেরা যখন খুব সিরিয়াস মুখে কোনো দায়িত্ব পালন করতে থাকে, দেখতে বেশ লাগে। ফলে প্রথম দিন থেকে ওদের সঙ্গে আমার একটা ভাব হয়ে গেল। হাজার দুয়েক গল্প জমা পড়েছিল। তার মধ্যে নকল গল্পও কম নয়। তবে বেশির ভাগ নকল গল্পই দেখি সারাহ ধরে ফেলে! গল্পের রুচিটা ওর উন্নত। কোন গল্পে কী হলে আরও জমত, কোন গল্প কেন ভালো, সেটা ও ব্যাখ্যা করে যুক্তি দিয়ে। বুঝে ফেললাম, মেয়েটা বেশ পড়ুয়া।

মানুষের মনও ভালো পড়তে পারত সারাহ। গল্প বাছাইয়ের প্রাথমিক কাজ যেদিন শেষ, সেদিন আমার দিকে একটা উপহারের বাক্স বাড়িয়ে দিল। বাক্স খুলে দেখি, খুব সুন্দর একটা স্কেচবুক, সঙ্গে টিনটিনের ছবিওয়ালা একটা কার্ড। আমি যে স্কেচবুক পছন্দ করি আর টিনটিনের পাঁড়ভক্ত, এটা ও জানল কী করে!

সারাহর উপহার দেওয়া গাছটি

তারপর দিন গড়াল আর আবিষ্কার করলাম, সারাহ যেন কেমন কেমন করে সবার মন পড়ে ফেলে। প্রায়ই দেখি, আজ একে বই উপহার দিচ্ছে, কাল ওকে ছবি এঁকে দিচ্ছে, পরশু তাকে রক্ত জোগাড় করে দিচ্ছে। এসব দেখে দেখে ভাবতাম, সারাহ দেখি সান্তা ক্লজ না হয়ে ছাড়বে না! রীতিমতো বারোমাসি সান্তা ক্লজ! একদিন ও শুনল, আমি ডাকটিকিট জমাই। ব্যস, অমনি নেমে পড়ল চিরুনি অভিযানে। যেখানে ডাকটিকিট পায়, আমার জন্য রেখে দেয়। দেখা হলেই ব্যাগ থেকে একগুচ্ছ ডাকটিকিট বের করে দিয়ে বলে, ‘এই যে ধরেন, ভাইয়া, এগুলা অনেক দিন ধরে বয়ে বেড়াচ্ছি।’

সারাহ যে একটা বিরল রোগসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতা বয়ে বেড়াচ্ছিল, তা জেনেছি আরও পরে। একবার তো ভীষণ আতঙ্কগ্রস্তই হয়ে পড়লাম। ওর শরীর তখন বেশ নাজুক, বাসা–হাসপাতাল–বাসা অবস্থা। এর মধ্যে একদিন ফোন করল, ‘ভাইয়া, আপনার সঙ্গে দেখা করব।’ গাঁইগুঁই করলাম। লাভ হলো না। ঠিকই দুপুরবেলা চলে এল। হাতে আমার জন্য একটা ছোট্ট সুন্দর গাছ। ওকে নিয়ে গেলাম ক্যানটিনে। ব্যাগে পানির বোতল দেখিয়ে বলল, ‘দেখেন না, পানিটাও বাসার; বাইরের কোনো খাবার খাওয়া যাবে না।’

অগত্যা ওকে সামনে বসিয়েই খেতে বসলাম। এ কথা–সে কথার মধ্যে হঠাৎ বিরতি নিয়ে সারাহ বলল, ‘আচ্ছা ভাইয়া, আমি কি সত্যিই সান্তা ক্লজ হতে পারব?’

প্লেট থেকে নজর সরিয়ে ওর দিকে তাকালাম, ‘সারাহ, তুমি তো সান্তা ক্লজ হয়েই আছ! আশপাশের সবাইকে তুমি উপহার দিচ্ছ, আনন্দ বিলাচ্ছ; সান্তা ক্লজও তো এত করে না!’

সারাহকে সেদিন একটা বই উপহার দিলাম। খুশি মনে বিদায় নিল। ঠিক তার পরদিনই প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে একটা ছবি দেখে আঁতকে উঠলাম। সারা দেশে ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের প্রতিবাদে মশাল হাতে পদযাত্রায় শামিল হয়েছে সারাহ! আঁতকে উঠলেও বিশ্বাসটা আরও পোক্ত হলো, সাহস আছে মেয়েটার!

একদিন দেখি, ওর দেওয়া গাছটা কীভাবে যেন ভেঙে গেছে! খুব মন খারাপ হলো। গাছটাতে কাঠির অবলম্বন দিয়ে রেখে দিলাম জানালার পাশে, রোদের দিকে। রোজ ভয়ে ভয়ে উঁকি মেরে দেখি। নিয়ম করে পানি দিই। দেখতে দেখতে গাছটা সেরে উঠল। সারাহ যখন হাসপাতালে, তখন আশায় বুক বাঁধলাম; গাছটার মতো ও–ও নিশ্চয় সেরে উঠবে। কিন্তু সারাহ সেরে উঠল না। ওর সাহস আর উপহারই শুধু থেকে গেল। মৃত্যুর আগে সাহসী সারাহ দিয়ে গেল অমূল্য উপহার।

সান্তা ক্লজ হতে চেয়েছিল সারাহ। আদতে ও ছিল সত্যিকারের সান্তা ক্লজ, কিংবা তার চেয়ে বড় কিছু...!