Thank you for trying Sticky AMP!!

বাবা হওয়াও সহজ নয়

কন্যা মেহার সঙ্গে বাবা ইরেশ যাকের

কিছুদিন আগের কথা। আমরা নেপালে বেড়াতে গেছি। সকালে আমি আর আমার মেয়ে মেহা আমাদের ঘর থেকে হোটেলের রেস্তোরাঁয় নাশতা খেতে যাচ্ছি। যাওয়ার পথে এক জায়গায় ছাদটা একটু নিচু। আমি মেহার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটছি। তাই কিছুটা অন্যমনস্ক। মাথায় খেলাম একটা বাড়ি। ফেরার পথে আবারও অন্যমনস্ক। এবার বাড়ি খাওয়ার আগেই মেহা বলল, ‘বাবা সাবধান। তুমি আবার বাড়ি খাবে।’ ওর বয়স তিন বছর। এরই মধ্যে অন্যমনস্ক বাবার যত্ন নেওয়া শুরু করেছে।

বাবা হওয়ার আগে মায়া–ভালোবাসা এসব নিয়ে অনেক কথা বলতাম। অনেকভাবে ভাবতাম। বাবা হওয়ার পর মনে হয়, মায়া–ভালোবাসা যে কী জিনিস, আগে হয়ত ঠিক বুঝতে পারিনি। কখনো কখনো দুঃস্বপ্ন দেখে যখন মেহার ঘুম ভেঙে যায়, সে বলে ‘বাবা নিচে ঘুম পাড়িয়ে দাও।’ মানে হলো বিছানা থেকে নামিয়ে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাকে ঘুম পাড়াও। কোলে ওঠার মিনিটখানেকের মধ্যেই গালে চুমা খেয়ে ‘আই লাভ ইউ বাবা’ বলে ঘুমিয়ে পড়ে মেহা। এসব দেখে শুনে আমার মনে হয় আমি কেন, পৃথিবীর কারও হৃৎপিণ্ডে এই ভালোবাসা ধারণ করার শক্তি নেই।

বাবা হওয়ার আনন্দ অসীম। তবে এটাও সত্যি যে বাবা হওয়ার পর মাঝেমধ্যেই নিজেকে বেশ অসহায় মনে হয়। মনে হয় আমি মেয়ের জন্য যাই করি, যথেষ্ট হবে না। পৃথিবীতে এত বিপদ, জীবনে এত সংকট। সবকিছু থেকে ওকে আগলে রাখতে ইচ্ছা করে। কিন্তু আমি জানি সেটা সম্ভব নয়। তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়।

এই অসহায়ত্ব একধরনের ফাঁদ তৈরি করে বৈকি। মেয়েকে সবকিছু দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সেটা কোনো বাবার পক্ষেই কখনো সম্ভব নয়। সন্তানের জন্য নিজের আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে একসময় সারাক্ষণই নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়। এই ব্যর্থতার অনুভূতি থেকে হীনম্মন্যতা জন্মায়। আমি দুর্বল হয়ে পড়ি। মা–বাবাকে সারাক্ষণ দুর্বল দেখা, যেকোনো সন্তানের জন্য খুবই বেদনাদায়ক। তাই বাবা হিসেবে নিজেকে অসহায়ত্বের গোলকধাঁধার বাইরে যতটা রাখা যায়, ততটা রাখার চেষ্টা করি। এ ক্ষেত্রে আমার নিজের বাবার উদাহরণ আমাকে উৎসাহ দেয়।

বাবা আলী যাকেরের সঙ্গে ছেলে ইরেশ যাকের

বাবা (অভিনেতা আলী যাকের) আমাদের অনেক কিছু দিয়েছিলেন। কিন্তু একজন বাবা হিসেবে এখন বুঝি যে উনি যতটা দিতে চেয়েছিলেন, ততটা হয়তো দিতে পারেননি। কিন্তু এই কারণে উনি যদি কোনো ধরনের অসহায়ত্ব অনুভব করে থাকেন, আমাদের সেটা বোঝাতে পারেননি। ছেলেমেয়ের জন্য করছি, এই অজুহাতে উনি কখনো জীবনের সঙ্গে আপস করেননি। সেটা ওনার ব্যক্তিগত জীবনে হোক, পেশাগত জীবনে হোক বা শৈল্পিক জীবনে হোক। সেই কারণে ওনার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমাদের জন্য একটা শক্তির উৎস হয়ে ছিলেন। বাবার শরীর খুব খারাপ হয়ে যাওয়ার পরও বাবা আছে, এটা আমাদের জন্য একটা বড় স্বস্তির জায়গা ছিল। বাবা চলে যাওয়ার পরও বাবার স্মৃতি আমাকে শক্তি জোগায়।

বাবা হিসেবে আমার নিজেকে যখনই ব্যর্থ মনে হয়, বাবাকে স্মরণ করি। যদিও আমি বাবার মতো শক্তিশালী নই। প্রতিদিন বিভিন্ন ব্যাপারে বাবার চেয়ে অনেক বেশি আপস করি। তবুও অন্তত মেহার জন্য নিজেকে যতটা শক্ত রাখা সম্ভব, ততটা শক্ত থাকার চেষ্টা করি। দুই–এক দিন আগের ঘটনা বলি।

মেহাকে সকালে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছি। আমাদের কথোপকথন।

মেহা: বাবা। দাদাভাইয়া আর বম্মা (আমার নানি যিনি সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন) কি আকাশে ঘুমায়?

আমি: হ্যাঁ বাবা।

মেহা: ওরা যে আকাশে ঘুমায় ওদের গডজিলা বিরক্ত করে না? (সিনেমার দৈত্য গডজিলাকে মেহা অনেক ভয় পায়। তাকে কল্পনায় একবার স্কুল, একবার মার্কেট, একবার বাসা এরকম অনেক জায়গায় পাঠানোর চেষ্টা করে সে। এখন আকাশে পাঠিয়ে দিয়েছে)।

আমি: না বাবা। গডজিলা, দাদাভাইয়া, বম্মা—ওরা সবাই তো বন্ধু।

মেহা: ওহ আচ্ছা। দাদাভাইয়া বম্মাকে আকাশে কেউ ডিস্টার্ব করে না?

আমি: না বাবা। আকাশে সবাই দাদাভাইয়া আর বম্মার বন্ধু।

কিছুক্ষণের নীরবতার পর।

মেহা: বাবা আমি বড় হয়ে গেছি। আমি এখন সব কিছু বুঝতে পারি।

এই কথা বলতে বলতে আমরা স্কুলে পৌঁছে গেলাম। মেহা ‘বাবা আই লাভ ইউ’ বলে স্কুলে ঢুকে পড়ল।

আমার মেয়ে এখন সব বোঝে। ওর হাত শক্ত করে ধরে রাখার জন্য, আমার নিজেকে আরও অনেক শক্ত হতে হবে।