Thank you for trying Sticky AMP!!

সাফজয়ী নারী ফুটবলারদের সঙ্গে নির্মাতা রেদওয়ান রনি

জাতীয় নারী ফুটবলারদের নিয়ে আবার ছবি

২০১৭ সালেই কলসিন্দুরের ফুটবলার মেয়েদের নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিল প্রথম আলো। ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আবারও করল। এবারের তথ্যচিত্রটির নাম সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে। তথ্যচিত্রের বিষয়বস্তু জাতীয় নারী ফুটবল দলের সাফল্যের পেছনের গল্প। দুটি তথ্যচিত্রই নির্মাণ করেছেন রেদওয়ান রনি। তথ্যচিত্রটি বানানোর নেপথ্য গল্প শোনালেন এই নির্মাতা।

শুটিংয়ের ব্যস্ততায় ঘাড়টা পর্যন্ত ঘোরানোর উপায় নেই। পুরোদমে চলছে শুটিং। ঠিক তখনই একগাদা সুখস্মৃতি সামনে নিয়ে এল ফেসবুক-মেমোরি। কয়েকটি ছবি আর লেখা। ‘ছুটির দিনে’তে প্রকাশিত কলসিন্দুরের অদম্য মেয়েদের নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের গল্প ও ছবি। সুখস্মৃতি বরাবরই মানুষকে আবেগপ্রবণ করে। আমি তো এমনিতেই আবেগপ্রবণ, তাই হয়তো আরও বেশি আবেগপ্রবণ করল। ফিরে গেলাম সাত বছর আগে দিনগুলোয়।

যে দিনগুলোতে মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তার, শিউলি আজিম, তহুরা খাতুন, শামসুন্নহার সিনিয়র, শামসুন্নাহার জুনিয়র, সাজেদা খাতুনেরা ছিলেন অনেকটাই ছোট। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা গোল্ডকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে জায়গা পেয়েছেন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ দলে। দারুণ খেলছেন তাঁরা। তখনই তাঁদের নিয়ে, তাঁদের সংগ্রাম ও সাফল্যের গল্প নিয়ে নির্মাণ করেছিলাম অদম্য মেয়েরা।

সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেই অদম্য মেয়েরা আজ জাতীয় বীর। সাত বছর পর তাঁদের নিয়ে আবার তথ্যচিত্র করতে এসে নিজের ভেতর অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করছিল।

ক্যামেরার সামনেও সপ্রতিভ মিডফিল্ডার মারিয়া মান্দা

আগুন ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব

প্রথম আলো কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই বৈঠক হচ্ছে। সেদিনও সম্পাদক মতিউর রহমানের নেতৃত্বে আমরা বসেছি। ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ, সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক, ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমীন, অনলাইন স্পোর্টস এডিটর উৎপল শুভ্র ও হেড অব ডিজিটাল বিজনেস জাবেদ সুলতানের সঙ্গে আলোচনা। কলসিন্দুরের মেয়েদের জন্য আরও কী কী করা যায়, এটাই আলোচনার বিষয়। মেয়েদের ফুটবলের কল্যাণে তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলো। পরে প্রথম আলোর বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত প্রীতিসম্মিলনীতে দেড় কোটি টাকার তহবিল গঠন করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে (বাফুফে) দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সেদিনই ঠিক হলো সোনার মেয়েদের নিয়ে আবার তথ্যচিত্র হবে। আর আমার ওপর পড়ল নির্মাণের দায়িত্ব।

Also Read: সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে

ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকির দায়িত্ব নেওয়ার পর নির্মাণ থেকে স্বেচ্ছাবিরতি নিয়েছি। কিন্তু মেয়েদের ফুটবল নিয়ে সাত বছর পর আবার কাজ করতে হবে, ভাবতেই ভেতরে-ভেতরে আনন্দ অনুভব করলাম। সাত বছর আগের নস্টালজিয়া পেয়ে বসল, সেই সঙ্গে ভয়। অদম্য মেয়েরা বেশ প্রশংসা পেয়েছিল। আবার তেমন হবে তো! সানজিদা মারিয়াদের সঙ্গে সাত বছর পর দেখা হবে, সেই উত্তেজনা অদ্ভুত এক অনুভূতি উসকে দিচ্ছিল।

শুটিং–মুহূর্ত

গল্পের সন্ধানে

এবার গল্পটা কী হবে, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে এই প্রশ্ন। অবশ্যই জাতীয় দলের সাফল্যের গল্প থাকবে। আনিসুল হকের সঙ্গে পরামর্শ করি আর আমার দলের সঙ্গে বারবার বসি। আগের তথ্যচিত্রের থেকে কী কী ব্যবহার করব, ভাবতে শুরু করি। চিত্রনাট্যে সাফল্যের পেছনের কষ্টের গল্প কীভাবে বের করে নিয়ে আসব, চিন্তা করি। মেয়েদের সবারই কোনো না কোনো বাধা পেরোনোর গল্প আছে, এত জনের গল্প ঠিকঠাক উপস্থাপন করতে গেলে পুরো ফিচার ফিল্ম হয়ে যাবে। দৈর্ঘ্যের দিকটিও ভাবতে হচ্ছিল।

নারী ফুটবলারদের সাফল্যের পেছনে রয়েছে কোচ গোলাম রব্বানীর অবদান

এমন সময় অদম্য মেয়েদের নিয়ে বিভিন্ন সময় ছাপা বেশ কিছু ফিচার, প্রতিবেদন ও ছবি পাঠালেন প্রথম আলোর ক্রীড়া প্রতিবেদক বদিউজ্জামান। শুরু হলো গবেষণা আর চিত্রনাট্য তৈরির কাজ। অনেক দিন পর চিত্রনাট্য লিখতে বসলাম। কিছুতেই যেন জুতসই হয় না। সহযোগী পরিচালক (কে এম) কনকের তাড়া, চিত্রনাট্য না পেলে টিম কীভাবে শুটিং পরিকল্পনা করবে! এদিকে মেয়েরা শুটিংয়ের জন্য অনুমতি পেয়েছে মাত্র এক দিন।

মনে হলো কলসিন্দুরে গিয়ে পুরোনো শুটিংয়ের জায়গা দেখলে গল্প পেয়ে যাব। ভোরে শুটিংয়ের অগ্রবর্তী দল মিলে মাইক্রোবাসে কলসিন্দুরের দিকে যাত্রা করলাম। পথে নামতেই মাথায় গল্প উঁকি মারতে শুরু করল। মাইক্রোবাসে বসেই লিখতে শুরু করলাম। লিখতে লিখতে প্রায় গাজীপুর পার হয়ে গেলাম। সবাই সকালের নাশতা করতে নামবে। কিন্তু আমার নামতে ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছিল, নামলেই তাল কেটে যাবে। সবার ডাকে নামতেই হলো। নাশতা খেয়ে আবার যাত্রা। ময়মনসিংহ যেতে যেতেই লেখা শেষ! মাইক্রোবাসের মধ্যে চিত্রনাট্য ব্রিফ করলাম।

তথ্যচিত্রের একটি দৃশ্য

শুটিংয়ের জন্য ফুটবলার মেয়েদের এক দিন পাচ্ছি। কিন্তু আমার চিত্রনাট্যে শামসুন্নাহারের গল্পটা তুলে ধরার জন্য কম করেও দুই দিন লাগবে। আনিসুল হককে জ্বালানো শুরু করলাম। বাকি সব মেয়ের শুটিং এক দিনেই করব, তবে শামসুন্নাহার জুনিয়রকে লাগবে দুই দিন। তাঁর বাড়িতে আমার শুটিং করতেই হবে। আনিসুল হক বাফুফে মহিলা ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ আপাকে বারবার বলতে থাকলেন, আর আমি আনিস ভাইকে।

শুটিং শুরু

৬ নভেম্বর ভোরবেলা ক্যামেরা–লাইট নিয়ে কমলাপুর স্টেডিয়ামে উপস্থিত হলো পপকর্ন টিম। শোভনের চিত্র গ্রহণ দিয়ে শুরু হলো দৃশ্যধারণ। স্টেডিয়াম শেষ করে মেয়েদের সংবর্ধনার শুটিং শুরু হলো রাস্তায় পিকআপের ওপরে। অভিনন্দনের দিনের মতোই রাস্তার চারপাশের মানুষ মেয়েদের দেখে উল্লাস করতে থাকল।

দুপুর পর্যন্ত ভালোভাবেই শুটিং হলো। দুপুরে হঠাৎ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মেয়েদের ডাক এল। কারণ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সম্মাননা দেবেন। মহড়ার জন্য তাঁদের যেতে হবে। এদিকে আমি সবাইকে শুটিংয়ে পেয়েছি মাত্র এক দিন। কী একটা অবস্থা! মেয়েরা যখন ফিরে এল বাফুফেতে, তখন রাতের অন্ধকার। রাতেই দিনের আবহ তৈরি করা হলো। এভাবেই সে দিনের শুটিং শেষ করলাম।

কমলাপুর স্টেডিয়ামে নারী ফুটবল দলের সদস্যরা

রাতে টিম যাবে কলসিন্দুর। সকাল থেকে সেখানে শুটিং। আবার বাধা! শামসুন্নাহার যেতে পারবে না। পরের দিন তাঁর করোনা টেস্ট করতে হবে। আমার মাথায় হাত। এবার আনিসুল হকের সঙ্গে উৎপল শুভ্রের সহযোগিতা নিলাম। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন সিদ্ধান্ত দিলেন পরদিন দুপুরে ছাড়া পাবেন শামসুন্নাহার।

আমরা রাতে চলে গেলাম কলসিন্দুর। সকাল থেকে অন্যান্য শুটিং করলাম। করোনা টেস্ট করে দুপুরে রওনা দিলেন শামসুন্নাহার। কলসিন্দুর পৌঁছাতে রাত ১০টা বাজল। কী আর করা, সারা রাত শুটিং হলো।

বিব্রতকর আনন্দ

হাতে সময় নেই। ঢাকায় ফিরেই মাহবুব টিপুর প্যানেলে এডিটিং শুরু হলো। জাহিদ নীরবের মিউজিক স্টুডিওতে সারা রাত আবহসংগীত। রিপন নাথের নেতৃত্বে সাউন্ড বক্সে ধারাবিবরণী দেয় ঋতু সাত্তার। চিন্ময়ের কালার গ্রেডিং চলে রাতের পর রাত। অবশেষে প্রস্তুত হলো সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে।

১১ নভেম্বর বিকেলে প্রথম আলো কার্যালয়ে প্রাথমিক প্রিভিউ এবং প্রয়োজনীয় সম্পাদনার পর ওই রাতেই ফিল্মটির চূড়ান্ত রূপ তৈরি হলো। ১২ নভেম্বর ছিল প্রথম আলোর ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রীতিসম্মিলনী। রাজধানীর র‌্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন হোটেলের গ্র্যান্ড বলরুমে প্রদর্শিত হলো সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, সাংস্কৃতিজনসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তুমুল করতালিতে মেয়েদের অভিবাদন জানালেন। অদম্য মেয়েদের সেকি উচ্ছ্বাস! বিশাল হলরুমে এত মানুষের সামনে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। সবার সামনে সেটা যে কি বিব্রতকর! আবার আনন্দেরও!