Thank you for trying Sticky AMP!!

রিকশার যত সাজগোজ

সিনেমার নায়ক নায়িকা। শিল্পী: আলী নূর

রাস্তায় নামানোর আগে একটি রিকশাকে সুন্দর করে সাজানো হয়। রিকশা সজ্জার দুটি ধরন রয়েছে। একটি এর অঙ্গসজ্জা, অন্যটি রিকশাচিত্র। অঙ্গসজ্জা হলো রিকশার কাঠামোর বিভিন্ন অংশকে বিভিন্ন জিনিস দিয়ে দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো। রিকশাচিত্র হচ্ছে পাতলা টিনের পাতের ওপর আঁকা চিত্র, যা পরে রিকশার বডির পেছন দিকে বিশেষভাবে জুড়ে দেওয়া হয়। এটিই রিকশার ছবি ও নকশার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয়।

বিশ শতকের প্রথম ভাগে, মূলত ত্রিশের দশকে, ঢাকাসহ বাংলাদেশের আরও কয়েকটি জায়গায় রিকশা চলতে শুরু করে। তবে সে সময়কার, অর্থাৎ ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে বাংলাদেশের রিকশাচিত্রের তথ্য তেমন জানা যায় না। পঞ্চাশ ও ষাটের দশক থেকে এর ধারাবাহিক ইতিহাস জানা যায়।

বিষয়বস্তু ও রঙের ব্যবহারের ক্ষেত্রে রিকশাচিত্র সরাসরি সিনেমার ব্যানার পেইন্টিংয়ের প্রভাবযুক্ত। রিকশাচিত্রীরা সিনেমার বিভিন্ন বিষয়কে তাঁদের কাজের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেছে মোটামুটি প্রথম দিক থেকে (পঞ্চাশের দশক)। বিভিন্ন সময় যখনই যে সিনেমাটি ব্যবসাসফল ও জনপ্রিয় হয়েছে, তখনই তার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এসেছে রিকশাচিত্রের বিষয় হিসেবে।
স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের নিজস্ব সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি বেগবান হলে অনেক সিনেমার গায়ে ‘হিট’ তকমা লেগে যায়। ফলে দেশের নায়ক-নায়িকারা জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। এসব জনপ্রিয় বা ‘হিট’ নায়ক-নায়িকার ছবি আঁকা শুরু হয় রিকশাচিত্রে। যেমন নিশান, চোর, ডাকু সুলতান, বেদের মেয়ে জোছনা, লাইলি-মজনু ইত্যাদি চলচ্চিত্রেরর নায়ক–নায়িকাদের আঁকা হয়েছে রিকশাচিত্রে। তবে হিন্দি ছবির নায়ক-নায়িকারাও রিকশাচিত্রে কম আসছে না। যেমন, শাহরুখ খান, সঞ্জয় দত্ত, মাধুরী প্রমুখ নায়ক-নায়িকার ছবি এখনো আঁকা হয় রিকশাচিত্রে।

গ্রামীণ দৃশ্য। শিল্পী: আলাউদ্দিন হোসেন

নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলোতে বিদেশি, বিশেষত ইংরেজি ছবি দেদার চলতে থাকে। এ সময় বিদেশি অভিনেতা-অভিনেত্রীর রংবেরঙের পোস্টার বাজারে বেশ সহজলভ্য হয়ে ওঠে। মূলত এই সময় থেকে ব্যাপকভাবে বিদেশি ছবির নায়ক-নায়িকা রিকশাচিত্রের অনুষঙ্গ হিসেবে আসতে থাকে। যেমন র‌্যাম্বো বা ব্রুস লি। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বিখ্যাত বিদেশি সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ছবিও রিকশাচিত্রীরা এঁকেছেন। যেমন ‘টাইটানিক’ সিনেমার টাইটানিক জাহাজ এবং জাহাজের সামনে দাঁড়িয়ে দুই বাহু মেলে দেওয়া নায়ক-নায়িকার জনপ্রিয় দৃশ্য।

রঙের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সিনেমার ব্যানার পেইন্টিং গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে রিকশাচিত্রকে। উজ্জ্বল রঙে আঁকা সিনেমার ব্যানারগুলো খুব সহজেই আকৃষ্ট করত মানুষকে। এতে এর একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া হতো দর্শকদের মনে। বাংলাদেশের প্রবীণ রিকশাচিত্রীরা এসব ব্যানার দেখে তাঁদের শৈশব ও কৈশোর পার করেছেন। সংগত কারণে সিনেমার উজ্জ্বল রঙের ব্যানার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তাঁদের পরবর্তী জীবনের রিকশাচিত্র আঁকার ক্ষেত্রে। উজ্জ্বল রঙের সিনেমার ব্যানার চিত্রের ব্যাপক প্রচলন, গুরু-শিষ্য পরম্পরা, সিনেমার ব্যানারচিত্রীদের রিকশাচিত্রী হয়ে ওঠা ইত্যাদি কারণে রিকশাচিত্রে সিনেমার ব্যানার চিত্রের প্রভাব পড়েছে।

গ্রামীণ দৃশ্যকল্প, ফুল, লতাপাতা, পাখি ইত্যাদি রিকশাচিত্রের আদি বিষয়। তবে বিভিন্ন সময় নানান কারণে রিকশাচিত্রের বিষয়বস্তুর পরিবর্তন হয়েছে।

উপসাগরীয় যুদ্ধ। শিল্পী: আলাউদ্দিন হোসেন

রিকশাচিত্রী রাজকুমার দাসের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, গ্রামীণ দৃশ্য, ফুল− বিশেষত পদ্ম ও গোলাপ, উর্দু এবং হিন্দি নায়ক-নায়িকাদের ছবি ছিল পঞ্চাশ-ষাটের দশকের রিকশাচিত্রের বিষয়। এ ছাড়া ধর্মীয় কিছু প্রতীকও তখন আঁকা হতো। যেমন বোরাক, কাবা শরিফ, ওম (ঔঁ) চিহ্ন ইত্যাদি। রিকশার পেছনে উজ্জ্বল রঙে আঁকা থাকত আঁকাবাঁকা পথ, নদী, অস্তগামী সূর্য, ধানকাটার দৃশ্য, পাট ধোয়ার দৃশ্য, ধানবোঝাই গরুর গাড়ি ইত্যাদি। এসব ছবি থাকার কারণে বাহন হিসেবে রিকশাটি দৃষ্টিনন্দন হতো। একটি ঝকঝকে ছবিওয়ালা রিকশায় যাত্রীদের ভ্রমণের আগ্রহ থাকে বেশি। এ কারণে এসব দৃশ্যকল্প রিকশার মালিক ও চালকদেরও পছন্দ ছিল। তা ছাড়া শাপলা, পদ্ম, জোড়া ময়ূর, টিয়ে, দোয়েল ইত্যাদি ব্যাপকভাবে আঁকা হতো এবং বর্তমানেও হয়। এ ছাড়া শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, কালো রঙের ওপর সাদা রঙে লেখা ক খ গ, জাতীয় পতাকা ইত্যাদি চিত্র এবং প্রতীকও আঁকা থাকে রিকশাচিত্রে।

এ বিষয়গুলো ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি এসেছে রিকশাচিত্রের বিষয় হিসেবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে উপসাগরীয় এবং আফগান যুদ্ধ, ৯/১১–এর টুইন টাওয়ার ধ্বংস। এসব ঘটনার সূত্র ধরে ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন এবং ওসামা বিন লাদেনের প্রতিকৃতি এসেছে রিকশার পেছনে। টুইন টাওয়ারের একটিতে ধোঁয়ার কুণ্ডলী, অন্যটিতে আঘাত হানতে যাওয়া উড়োজাহাজ—৯/১১–এর স্মৃতিবাহী এই দৃশ্যটিও রিকশাচিত্রে পাওয়া যায়।

অ্যানিমেল সিটি। শিল্পী: সৈয়দ আহমদ হোসাইন

জানা যায়, পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে (১৯৬৫ সালের পরে কোনো একসময়) প্রথম রিকশাচিত্রে মানুষের ছবি আঁকার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় সরকারিভাবে। এ সময় মানুষের বদলে জীবজন্তুর ছবি আঁকার প্রবণতা দেখা দেয় রিকশাচিত্রীদের মধ্যে। এ সময় রিকশাচিত্রের বিষয়বস্তু প্রবেশ করে ফ্যান্টাসির জগতে। এ সময় শিল্পীরা পশুপাখি, জন্তুজানোয়ারকে মানুষের ভূমিকায় নিয়ে এসে ছবি আঁকা শুরু করেন। এই ছবিগুলোতে দেখা যায়, পশুপাখি মানুষের মতো আচরণ করছে। যেমন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে সিংহ, তার পাশে ছোট্ট খরগোশ বই নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে, রিকশার চালকের আসনে বসা বানর, সেলাই মেশিনে কাজে ব্যস্ত বাঘ, চায়ের কেটলি হাতে শেয়াল, মহাজনের ভূমিকায় সিংহ, পশুপাখিদের বনভোজন ইত্যাদি।
পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৬–৭৭ সালের দিকে দ্বিতীয়বার সরকারি আদেশে রিকশাচিত্রের বিষয় হিসেবে মানুষের দেহাবয়ব আঁকার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলে রিকশাচিত্রের ফ্যান্টাসির আগের ধারাই চলতে থাকে।
ফ্যান্টাসি চিত্রের এই ধারার ক্ষেত্রে একজন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী সৈয়দ আহমেদ হোসাইন। তিনি ‘অ্যানিমেল সিটি’ শিরোনামে পাঁচটি ছবির একটি সিরিজ আঁকেন। এই ছবিগুলোর বিষয়বস্তু ছিল এক মহাজনের রিকশা ক্রয়সংক্রান্ত একটি গল্প। তবে এই গল্পের চরিত্র হিসেবে তিনি সিংহ, বাঘ, বানর, শিয়ালের প্রতিকৃতি আঁকেন।

কার হাত ধরে রিকশাচিত্রের জগতে এই পরিবর্তনটি আসে, তা নিশ্চিত করে বলার জো নেই। রাজকুমার দাসের দাবি, তিনি বাঘ ও শিয়ালের গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রথম বাঘ এবং শিয়ালের ছবি আঁকা শুরু করেন। আবার শিল্পী সৈয়দ আহমেদ হোসাইনও দাবি করেন, তিনিই প্রথম বাঘ ও শিয়ালের ছবি আঁকেন। অন্যদিকে চলচ্চিত্রের অ্যাকশন দৃশ্যকে জন্তুজানোয়ারের মাধ্যমে উপস্থাপন করার কৃতিত্ব আলাউদ্দিন হোসেন নামের একজন শিল্পীর। তাঁর মেয়ে রুমা পশুপাখির বনভোজনের দৃশ্য প্রথম চিত্রায়ণ করেন।

বনভোজন। শিল্পী: রুমা

স্বাধীনতাযুদ্ধের পর ঢাকা শহরকে যখন নতুন করে গড়ে তোলা শুরু হয়, মানুষের মনে যখন নতুন দিনের স্বপ্ন, তখন রিকশাচিত্রে কল্পিত নগরের ছবি আঁকা শুরু হয়। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার ছবিও এঁকেছেন রিকশাচিত্রীরা।
এই ছবিগুলোতে দেখা যায়, কোমরপানিতে তলিয়ে গেছে বাড়িঘর, আতঙ্কিত মানুষজন সাধ্যমতো জিনিসপত্র নিয়ে চলে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ে। সরকারের পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি প্রকল্পের ছোঁয়াও লাগে রিকশাচিত্রে। নারী নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, ছিনতাই, মাদকদ্রব্য গ্রহণের কুফল, বৃক্ষনিধন—এসব বিষয় বেশ গুরুত্ব দিয়ে আঁকা হয়েছে। এইডস বিষয়ে সচেতনতার ছবিও আমরা প্রতিনিয়ত দেখি রিকশার পেছনে। মূলত শিল্পীদের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ছিল এসব ছবি আঁকার পেছনের কথা।

রিকশাচিত্রের ভুবন সত্যিই বিশাল। বিচিত্র তার বিষয়বস্তু। একসময় শিল্পীরা মনের মাধুরী মিশিয়ে ছবি আঁকতেন রিকশার জন্য। এখন আর তেমনটা হয় না। অল্প সময়ে অধিক ছবি উৎপাদনের জন্য স্ক্রিনপ্রিন্টের দ্বারস্থ হওয়ার কারণে মননশীল শিল্পমাধ্যম এবং শিল্পীদের অবস্থা খুব একটা ভালো নেই। হাতে আঁকা রিকশাচিত্র এখন আর আপনি খুঁজে না–ও পেতে পারেন। আপনার আশপাশের সব রিকশার পেছনে তাকান, দেখতে পাবেন এক মৃতপ্রায় শিল্পের ভান্ডার।

রিকশা নিয়ে দশটি তথ্য:
১. উনিশ শতকের শেষের দিকে ১৮৭০ সালে জাপানে হাতে টানা রিকশার উদ্ভব ঘটে।
২. রিকশা শব্দটির মূলে রয়েছে দুটি জাপানিজ শব্দ ‘jin riki sha’—যার বাংলা অর্থ করা যায় ‘মানুষে টানা যান।’ স্থানীয়ভাবে জাপানে এটি ‘Rintaku’ নামে পরিচিত ছিল।
৩. রিকশা প্রথমে বিত্তবানদের যানবাহন ছিল। জাপানের সম্রাট মেইজি (১৮৫২-১৯১২) রাজধানী পরিদর্শনের জন্য রিকশা ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়।
৪. রিকশা দুই ধরনের—হাতে টানা ও প্যাডল বা সাইকেল রিকশা। ১৮৮০ জাপানে হাতে টানা রিকশার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৬০ হাজারের মতো।
৫. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানে যখন তেলচালিত মোটর বাহনের স্বল্পতা দেখা দেয়, তখন সেখানে সাইকেল রিকশার প্রচলন বৃদ্ধি পায়। ১৯২০ সালের দিকে জাপানের টোকিও শহরে সাইকেল রিকশা ছিল ১.২ মিলিয়ন, ১৯৩০ সালে ৫.৮ মিলিয়ন, ১৯৪০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮.২ মিলিয়নে।
৬. ১৯৫০ সালের দিকে সাইকেল রিকশা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে।
৭. অবিভক্ত বাংলায় প্রথম রিকশার প্রচলন ঘটে কলকাতায় বিশ শতকের প্রথম ভাগে—১৯৩০ সালের দিকে। কাছাকাছি সময়ে বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রিকশার প্রচলন হয় প্রথমে ময়মনসিংহ ও নারায়ণগঞ্জে এবং পরে ঢাকায়—১৯৩৮ সালে। তৎকালীন পূর্ব বাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশে রিকশার আগমন ঘটেছিল কলকাতা থেকে।
৮. একটি রিকশা তৈরি থেকে রাস্তায় নামা পর্যন্ত ছয় শ্রেণির পেশাজীবীর হাত ঘুরে আসে। এঁরা হলেন হুডমিস্ত্রি, বডিমিস্ত্রি, বাতা কারিগর, পেইন্টার, রংমিস্ত্রি, ফিটিং মিস্ত্রি।
৯. রিকশার পেছনে ঝুলবোর্ডে টিনের শিটের ওপর যে ছবি আঁকা থাকে, সেসব ছবিই মূলত রিকশাচিত্র। বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের ইতিহাসে রিকশাচিত্রকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে অভিহিত করে থাকেন।
১০. জাপানের ফুকুওয়াকা জাদুঘরসহ পৃথিবীর বেশ কিছু জাদুঘরে বাংলাদেশের রিকশাচিত্রীদের চিত্রকর্ম রয়েছে।