Thank you for trying Sticky AMP!!

সাকিনার হাতে নতুন ধান

কৃষিবিজ্ঞানী ড. সাকিনা খানমের হাত দিয়ে ২০২২ সালে উদ্ভাবিত হয় ‘বিনা ধান২৫’।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারতেই ‘বিনা ধান২৫’ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য পেলাম। ধানটির বৈশিষ্ট্য, চাষ উপযোগী জমি ও মাটি, বপনের সময়, বালাই ব্যবস্থাপনা—সবই আছে। এসব খুঁটিনাটি জানার পরও মনে যদি কোনো প্রশ্ন জাগে, উত্তর দেওয়ার জন্য আছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ। আর এই বিশেষজ্ঞ হলেন কৃষিবিজ্ঞানী ড. সাকিনা খানম। তাঁর হাত দিয়েই ২০২২ সালে উদ্ভাবিত হয় ‘বিনা ধান২৫’।

সাকিনা খানম বিনার যোগাযোগ উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। এই নতুন জাত উদ্ভাবন থেকে শুরু করে কৃষক পর্যায়ে নিতে সাকিনা খানমকে ধাপে ধাপে বেশ কিছু পরীক্ষায় পাস করতে হয়েছে। কীভাবে এই জাত উদ্ভাবনের সঙ্গে যুক্ত হলেন সেই গল্প তাঁর মুখ থেকেই শুনলাম।

২০২০ সালে ‘বিনা ধান২৫’-এর গবেষণায় যুক্ত হন সাকিনা খানম। এর কয়েক বছর আগে জাপানের সঙ্গে একটি যৌথ প্রকল্পের আওতায় জাতটি নিয়ে কাজ শুরু হয়। সে সময় জাপান থেকে ব্রি২৯ ধানের বীজে রেডিয়েশন দিয়ে এনে বিনার ক্যাম্পাস মাঠে শুরু হয় গবেষণা। তবে নিরবচ্ছিন্ন গবেষণার কাজটা এত দিন সেভাবে এগোয়নি। বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ডিইউএস (ডিসটিঙ্কটনেস, ইউনিফরমিটি অ্যান্ড স্ট্যাবিলিটি) পরীক্ষা এবং মাঠ মূল্যায়নে গবেষণার ফলাফল সন্তোষজনক ছিল না। এই পর্যায়ে কাজটি এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব পান সাকিনা খানম ও তাঁর দল।

সাকিনা খানম বিনার যোগাযোগ উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা

সাকিনা খানম যখন কাজ শুরু করেন, তখনো মাঠে জাতটি নিয়ে বিভিন্ন জটিলতা ছিল। এর মধ্যে ছিল ফলনের তারতম্য, বিভিন্ন মাঠের ফলনে একই সময়ে ফুল না আসা ইত্যাদি। তিনি ভাবলেন, তাড়াহুড়া করলে কৃষক প্রতারিত হবেন। তাই ১০টি এলাকায় মাঠ মূল্যায়নের কাজ শুরু করলেন সাকিনা খানম। তার মধ্যে ৮টি এলাকায় গড়ে ১৯ শতাংশের বেশি ফলন পাওয়া গেল। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিবের সভাপতিত্বে জাতীয় বীজ বোর্ড ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভায় চূড়ান্ত অনুমোদন পায় সাকিনা খানমের ধান। এরপরই এই ধান চাষের অনুমতি পান কৃষকেরা।

সাকিনা খানম জানান, বোরোর উন্নত একটি নতুন জাত ‘বিনা ধান২৫’। দেশে উদ্ভাবিত ধানের মধ্যে এই জাতের ধান থেকে পাওয়া চালের আকার সবচেয়ে লম্বা ও সরু। বিদেশ থেকে আমদানি করা বাসমতী চালের বিকল্প হতে পারে এই চাল। এর উৎপাদন ব্যয় অন্য ধানের মতোই। রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ প্রচলিত জাতের তুলনায় অনেক কম। জাতটি লবণাক্ত এলাকা ছাড়া দেশের সব উঁচু ও মধ্যম উঁচু (যেখানে দীর্ঘদিন পানি জমে থাকে না) জমিতে চাষ উপযোগী।

সাকিনা খানম

দলনেতা হিসেবে এককভাবে ‘বিনা ধান২৫’-এর কৃতিত্ব নিতে চান না সাকিনা খানম। তাই তো জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সামিউল হক, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহমুদ আল নূরসহ অনেকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন। সেই সঙ্গে ২০০৯ সাল থেকে এই ধানের জাত নিয়ে কাজ করা বিনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আলী আজম এবং ড. আবুল কালাম আজাদের কথাও স্মরণ করলেন। বললেন, করোনার সময় মাঠ মূল্যায়ন হয়। কয়েকটি এলাকায় সরাসরি যেতে পেরেছেন সাকিনা, আর অন্যগুলোয় গেছেন তাঁর দলের সদস্যরা।

দ্বিতীয়বারের মতো এবার এ ধানের চারা রোপণ করেছেন কৃষকেরা। এপ্রিলের দিকে ধান ঘরে ওঠার কথা। সাকিনা খানম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, কৃষকেরা এ ধান ফলিয়ে লাভবান হবেন।

মেয়েকে পড়িয়ে কী লাভ

সাকিনা খানমের জন্ম গাইবান্ধায়। কলেজ পর্যন্ত এই শহরেই পড়াশোনা করেছেন। এরপর ভর্তি হন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এলাকা ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যখন আসেন, তখন অনেকেই তাঁর মা-বাবাকে বলেছিলেন, মেয়েকে পড়িয়ে কী লাভ! তবে তাঁর পরিবার এসব কথায় পাত্তা দেয়নি। সাকিনার বাবা এ কে এম শামছুল আনোয়ার খান সব সময় চাইতেন মেয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশের সুনাম বয়ে আনুক। সাকিনা খানমও প্রয়াত বাবার স্বপ্ন পূরণ করে চলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে লবণ, খরা ও ঠান্ডা-সহিষ্ণু গমের জাত নিয়ে জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। এরপর কোরিয়ায় ধান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে খেজুর নিয়ে পোস্ট ডক্টরাল করেছেন।

সাকিনা খানমের স্বামী লুৎফর রহমান প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। এক ছেলে আন্দালিব রহমান টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ছেন। সাকিনা খানম জানান, তাঁর যাত্রাপথে বাবার বাড়ি এবং স্বামী ও ছেলের কাছ থেকে সব সময় সহায়তা পেয়েছেন। ছেলের যখন মাত্র দুই বছর বয়স, তখন তাকে মা ও ছোট বোনের কাছে রেখে পিএইচডি করতে বিদেশে গেছেন সাকিনা। পোস্ট ডক্টরাল করেছেন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। মাকে কাছে না পাওয়ার অনুযোগ ছেলে কখনোই তেমন একটা করেননি। বরং চারপাশে মায়ের নামডাক শুনে ছেলে এখন মজা করে বলেন, মায়ের সুনাম তাঁর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মায়ের ছেলে হিসেবে তাঁকেও জীবনে কিছু করে দেখাতে হবে।

‘বিনা ধান২৫’-কে কীভাবে সুগন্ধি করা যায়, এখন এ নিয়ে গবেষণা করছেন সাকিনা খানম। এর বাইরে হাওর উপযোগী ও খরা–সহিষ্ণু অঞ্চলের জন্য ধান উদ্ভাবন, গম, পাটের নতুন জাত উদ্ভাবনসহ বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, মেয়েরা কাজ করতে চাইলে, যোগ্যতা থাকলে এবং পারিবারিক

পর্যায় থেকে শুরু করে চাকরির ক্ষেত্রে সহযোগিতা পেলে এখন আর তেমন একটা বাধার সম্মুখীন হতে হয় না।