Thank you for trying Sticky AMP!!

কখন চিকিৎসকের কাছে যাব

আমাদের শরীর একটা দেহঘড়ি। টিকটিক করে শব্দ করে চলেছে একটি কাঁটা, যাকে আমরা হৃৎপিণ্ড বলি। মানবদেহের সবচেয়ে সক্রিয় অংশ। নিজের হৃৎপিণ্ড সম্পর্কে তাই ভালোভাবে জেনে রাখা জরুরি। এ সম্পর্কে ধারণা পেলে বুঝবেন, ঠিক কখন আপনার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। অনেকে বুকের ব্যথা হলেই হার্টের সমস্যা ভেবে আতঙ্কিত হয়ে ছুটে আসেন হাসপাতালে। অনেকে আবার ঠিক সময়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন না। লিখেছেন অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান
প্রতিদিনের ছুটে চলা জীবনে একটু স্থিরতা আনুন। ছবি: প্রথম আলো

আমাদের দেশে সাধারণত হৃৎপিণ্ডের দুই ধরনের সমস্যা প্রকট। প্রথমটি হৃৎপিণ্ডের জন্মগত ত্রুটি, যা শিশুদের বেশি হয়ে থাকে। ভেন্ট্রিকালার সেপটাল ডিফেক্ট (VSD) ও অ্যাট্রিয়াল সেপটাল ডিফেক্ট (ASD) হৃৎপিণ্ডের দুটি প্রধান জন্মগত ত্রুটি। সহজ কথায়, হৃৎপিণ্ডের মধ্যে চারটি প্রকোষ্ঠ থাকে। দুটি অলিন্দ ও দুটি নিলয়। ডান ও বাম অলিন্দ একটি পর্দা দ্বারা পৃথক থাকে, ডান ও বাম নিলয়ও একটি পর্দা দ্বারা পৃথক। যদি দুই অলিন্দের মাঝখানের পর্দার কোনো ছিদ্র থাকে, তাকে ‘এএমডি’ বলে আর যদি দুটি নিলয়ের মাঝখানে পর্দার মধ্যে কোনো ছিদ্র থাকে, তখন তাকে ‘ডিএসডি’ বলে। এ সমস্যায় অক্সিজেনযুক্ত রক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডযুক্ত রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। সাধারণত শিশুরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে।

দ্বিতীয় সমস্যাটি বড়দের। তবে প্রকারভেদে বড়দের হৃৎপিণ্ডের সমস্যা কয়েক ধরনের। প্রথমটি, হার্ট অ্যাটাক বা চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় ও মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন (Myocardial Infraction) করোনারি আর্টারি নামে হৃৎপিণ্ডের গায়ে তিনটি ধমনি থাকে। এ দুটি ধমনি হৃৎপিণ্ডে পুষ্টির জোগান দেয়। কোনো কারণে এই ধমনিতে যদি ‘ব্লক’ সৃষ্টি হয়, তাহলে হৃৎপিণ্ডের যে এলাকা ওই ধমনির পুষ্টি নিয়ে চলে, সে এলাকার টিস্যুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখনই ‘হার্ট অ্যাটাক’ হয়।
বড়দের ক্ষেত্রেও অ্যানজাইনা (Angina) আরও একটি সমস্যা। হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিলে বুকে যে ব্যথা অনুভূত হয়, সেটাই ‘অ্যানজাইন’। অনেকে এটাকেও হার্ট অ্যাটাক ভেবে ভুল করেন। তৃতীয় সমস্যাটি হয় হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশিতে। এর নাম ‘কার্ডিওমায়োপ্যাথি’ (cardiomyopathy)। এ ক্ষেত্রে হৃৎপিণ্ড একটু বড় হয়ে যায়। রক্ত সঞ্চালন-প্রসারণ ক্ষমতা কমে গিয়ে হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে।
হৃৎপিণ্ডের ভাল্‌ভেও সমস্যা হয়ে থাকে। ছোটবেলায় ‘রিউমেটিক ফিভার’ ঠিকমতো চিকিৎসা করা না হলে বড় হয়ে বাতজ্বরজনিত হৃদ্‌রোগ হয়ে থাকে। গিঁটের ব্যথা থেকে সেটা গড়ায় হৃৎপিণ্ডের টিস্যু অবধি। শৈশবে গড়ে ৫-১৫ বছর বয়সে হৃৎপিণ্ডে আক্রমণ করে। এ ছাড়া হৃৎপিণ্ডের পর্দায় পানি জমে অনেকের। বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত হৃৎপিণ্ডের এসব সমস্যায় বেশি ভুগে থাকে।

ব্যায়ামের কোনো বিকল্প নেই। ব্যয়ামকে জীবনের অংশ করে ফেলুন। ছবি: প্রথম আলো

হার্ট অ্যাটাক হলে সাধারণত বুকে ভীষণ চাপ অনুভূত হয়। ঘাম নির্গত হয় শরীর থেকে। শুধু বুক নয়, অনেক সময় চোয়ালেও ব্যথা হয় কিংবা ব্যথাটা ক্রমশ হাতের বাম দিকে চলে আসে। ডায়াবেটিক রোগীরা অবশ্য অনেক সময় বুকের ব্যথা টের পান না। বাংলাদেশে হার্ট অ্যাটাকের ব্যথা নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভোগার পরিমাণ বেশি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কার্ডিওলজি বিভাগের চিকিৎসকদের সংগঠন ও ‘সোসাইটি অব স্টাডি অব চেস্ট পেইন’-এর এক সমীক্ষায় আমরা দেখেছি, বুকের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি হওয়া রোগীদের ৫৫ শতাংশই হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত নন। গ্যাসের সমস্যার কারণে বুকে ব্যথা হওয়া হার্ট অ্যাটাক ভেবে নেন অনেকে। কিংবা এর উল্টোটাও ঘটে থাকে। বুকে ব্যথার সঙ্গে ঘাম ও বমি হলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
আগে সবার ধারণা ছিল, হৃদ্‌রোগ শুধুই বড়লোকের অসুখ। কিন্তু আমরা দেখেছি, কম বিত্তবানদের ক্ষেত্রেও এ সমস্যা প্রকট। দেখা যায়, হৃদ্‌রোগের সমস্যা থাকলেও টাকার অভাব কিংবা হেলাফেলার কারণে চিকিৎসা করা হয়ে ওঠে না। সাধারণত ধূমপান ছাড়লে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যায় শতকরা ৫০ ভাগ। এ ছাড়া অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, পরিশ্রম, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখলে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশ কমে যায়। তবে পারিবারিক, মানে বংশগত কারণেও অনেকে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন। বাংলাদেশে এর হারও কম নয়। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসা করানোই ভালো।
ভৌগোলিক কারণে আমাদের দেশেও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেশি। নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য মেনে এ দেশের মানুষের উচ্চতা কম। এ কারণে আমাদের করোনারি ধমনির ভেতরকার পরিসর বেশ ছোট। করোনারি ধমনির পরিসর ছোট হতে হতে একেবারে বন্ধ হয়ে গেলেই সমস্যাটা হয়। এ দেশে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের সংখ্যাটা বেশি।
২৫-৩০ বছর বয়সীদের সংখ্যাটাও ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। শিশুদের হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে। এর কারণ, কায়িক পরিশ্রমের অভাব এবং জাঙ্ক ফুড খাওয়ার অভ্যাস। শিশুদের এ অভ্যাস পাল্টাতে না পারলে দেশে হৃদ্‌রোগীর সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।
হৃৎপিণ্ড আপনার হৃদয়ও। সেটিতেই যদি গড়বড় হয়, ভালো আর বাসবেন কী করে!

লেখক: হৃদ্‌রোগ, বাতজ্বর, বক্ষব্যাধি, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।