Thank you for trying Sticky AMP!!

৫৫ বছর পর মুঠোফোনের পর্দায় ভেসে উঠল আমার বন্ধু গৌতমের মুখ

বিশ্ববিদ্যালয়–জীবনের বাংলাদেশি বন্ধু শফি আহমেদকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না ভারতের গৌতম রায়। ৫৫ বছর পর আংশিক নাম আর পেশাগত পরিচয় দিয়ে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের একটি দেশে কাউকে খুঁজে পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা! একসময় ‘হ্যাম’ নামে পরিচিত শৌখিন রেডিও অপারেটরদের শরণাপন্ন হন তিনি। ওই সামান্য তথ্য পুঁজি করেই দুই দেশের বেতারবন্ধুরা ঘটালেন এক মহামিলন। নিজেই সেই গল্প শোনালেন শফি আহমেদ

ছবি দেখে কে বলবে অর্ধশতাব্দী পর দেখা। তিন বন্ধু (বাঁ থেকে)—গৌতম রায়, শফি আহমেদ ও দীপক চৌধুরী

জীবন কেটে গেছে কুড়ি-কুড়ি বছরের পর। তৃতীয় কুড়ি পূর্ণ হতে বাকি আর পাঁচ বছর। না, এ আমার বা আমাদের বয়স নয়, আমাদের অনিচ্ছুক বিচ্ছেদের পর মিলনের দূরত্ব। ১৯৬৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শেষ হওয়ার পর হয়তো প্রথম দিকে পরীক্ষার প্রস্তুতিতে, আর পরে বেকারত্ব ঘোচানোর প্রচেষ্টায় আমাদের তিনজনের বন্ধুত্বের সুতাটা কেমন করে যেন ছিঁড়ে গেল, সে হিসাব মিলাতে আজি মন মোর নহে রাজি। জীবনের সায়াহ্নবেলায় সবাই এখন—আমি, গৌতম (রায়) আর দীপক (চৌধুরী) পেরিয়ে যাচ্ছি ৭৬। ঠিক যেন সিনেমার মতো, পঞ্চাশ বছর পর মুঠোফোনের পর্দায় ভেসে উঠল গৌতমের মুখ, একটুও পাল্টায়নি ও এতগুলো বছর পর। আমার মাথার নজরুলপ্রতিম কেশরাশি উধাও সেই কবে, ছাত্রাবস্থায় দারিদ্র৵জীর্ণ ও শীর্ণ মুখমণ্ডলে বয়সের ক্ষয়িষ্ণু ছাপ। এটা ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩ সালের কথা।

সেদিন আমি খুব ব্যস্ত। আমার লেখা বড় একটা প্রবন্ধের সর্বশেষ প্রুফ দেখছি, ডিজাইনারের সঙ্গে ছবির বিন্যাস নিয়ে কথা বলছি। একটা ফোন এল—‘কথা বলুন, ফোনের ওপারে আপনার কলকাতার বন্ধু।’ ভিডিওর পর্দায় গৌতমকে দেখতে পাচ্ছি। অবিশ্বাস্য এক মুহূর্ত। পরস্পরকে দেখে আমাদের স্তম্ভিত হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু অনর্গল কথা বলছি আমরা। ধুলা পড়া, পোকায় খাওয়া স্মৃতির ঝুড়ি উপুড় করে আমি আর গৌতম ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আবার একত্র করতে চাইছি। কোথা থেকে ফিরে এল ১৯৬৪, যে সালে আমরা ভর্তি হয়েছিলাম ইংরেজি অনার্স ক্লাসে। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে। আহা, সেই সব দিন! আমার নিদারুণ ব্যস্ততার জন্য ফোনালাপ সংক্ষিপ্ত করতে হয়েছিল। যদিও মনের ভেতর অস্থির উত্তাপ।

Also Read: ১৯৬৯ সালে আলাদা হয়ে যাওয়া দুই দেশের দুই বন্ধুর যেভাবে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিলাম

বন্ধুদের সঙ্গে দীপক চৌধুরী (দাঁড়ানো বাঁ থেকে দ্বিতীয়) , শফি আহমেদ (দাঁড়ানো বাঁ থেকে চতুর্থ) ও গৌতম রায় (ডানে নিচে বসা), ১৯৬৪ সাল

পরের দিনই ‘হ্যাম রেডিও’ নামে এক মানবিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য ও ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিও ক্লাবের সম্পাদক অম্বরীশ নাগ এবং বাংলাদেশ অ্যামেচার রেডিও সোসাইটির সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুল হুদা আমার হোয়াটসঅ্যাপে কলকাতার দুটি বাংলা কাগজ—বর্তমান, আজকাল এবং ইংরেজি দৈনিক মিলেনিয়াম পোস্ট-এর কলকাতা সংস্করণের সচিত্র প্রতিবেদন পাঠালেন। পাঁচ কলাম শিরোনাম করেছে দৈনিক বর্তমান—‘কাঁটাতারের ওপারে স্কটিশের বন্ধু, খোঁজ ৫৫ বছর পর’; ফেসবুক থেকে ছবি আর ওয়েবসাইট থেকে তথ্য নিয়ে দৈনিক আজকাল-এর পৃষ্ঠাব্যাপী হেডলাইন, ‘৫৫ বছর পর দুই বন্ধুকে মিলিয়ে দিল হ্যাম, খুশিতে একাকার এপার-ওপার’; আর মিলেনিয়াম পোস্ট তিন কলামের শিরোনামে লিখল: ‘হ্যাম রেডিও ইউনাইটস টু লং লস্ট ফ্রেন্ডস ক্রস বাউন্ডারি ইন বাংলাদেশ’। আমার বিষয়ে বাড়তি খোঁজখবর নিয়ে জানিয়েছে ঢাকায় থিয়েটারের সঙ্গে আমার জড়িত থাকার কথা এবং সেই তথ্যটাকে হাইলাইট করেছে। তিনটা কাগজেই আমার আর গৌতমের ছবি।

রাতে বাড়ি ফিরেও গৌতমকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। পরদিন সকালে দেরিতে উঠে প্রাতরাশ সেরে প্রথম আলোয় কিছুক্ষণ চোখ বোলানোর পর হোয়াটসঅ্যাপে এসব দেখে চোখ ভিজে গেল। সারা দিন অনেক ব্যস্ততা। তবুও স্মৃতি, হারানো সেই দিনের কথা এবং হ্যাম রেডিও, যাদের কথা এক দিন আগেও জানতাম না, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে উঠল। গৌতমকে বার্তা পাঠালাম। আগের দিন ওকে বলেছিলাম, মাঝেমধ্যেই আমি কলকাতায় যাই। এখন ওর কণ্ঠে প্রবল অস্থিরতা, ‘তুই কবে কলকাতা আসবি, এখানকার অনেক সাংবাদিক তোর সাথে কথা বলতে চাইছেন, তুই তাড়াতাড়ি আয়।’ যেন এক পরমাত্মীয়ের আকুতি। কথা হলো, সে দু–এক দিনের মধ্যে আমাদের আরেক বন্ধু দীপকের কাছে যাবে। দীপক হাওড়ায় থাকে। তাকেও ৫৫ বছর পর খুঁজে বের করেছে গৌতম। 

ব্যক্তিগত অনুভব পেরিয়ে মনে হতে লাগল, কলকাতার সাংবাদিকেরা শুধুই দুই বন্ধুর অর্ধশতাধিক বছরের পর কথোপকথনে মিলিত হওয়ার এই নাটকীয় বিষয়টিকে এতটা গুরুত্ব দিলেন! রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অবহেলে, ধর্ম পরিচয়ের হিন্দু-মুসলমানত্ব পাশে সরিয়ে বাঙালির যে ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতি-উৎসারিত একটি সুগভীর শিকড় আছে, তার এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটেছে তাদের প্রতিবেদনে, কাঁটাতার ওপার-এপার তারই প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করে। মনে পড়ে গেল, আমাদের মায়েদের কথা। আহা, তিনজনের কেউ-ই বেঁচে নেই আজ। অন্য বাড়িতে গিয়ে তিনজনই দুজনকে ‘মাসি’ বলে ডাকতাম। কিন্তু এই পড়ন্ত বেলায় অনুভব করি, তিন মায়ের কাছে ছেলে ছিলাম আমরা; সন্তানতুল্য উল্লেখ করলে পুরো সত্যটা ধরা যাবে না। কত সব স্মৃতি উথলে ওঠে, ১৯৬৪ সালের শেক্‌সপিয়ারের ৪০০ বছর উদ্‌যাপন, অপটু নাট্যাভিনয়, কিন্তু অনিরুদ্ধ উৎসাহ, প্রফেসর ঘোষাল জুলিয়াস সিজার পাঠদানের সময় ‘এত তু, ব্রুতে’ সংলাপ বলে স্যুট-টাই পরে মেঝেতে পড়ে  গেলেন, শিক্ষক ও খ্যাতনামা অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তীর শিক্ষকতা জীবনের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলাম আমরা, কী ঘনিষ্ঠ হয়ে মিলতেন, নাটকের প্রতি আমার আলাদা ঝোঁক দেখে কয়েক দিন পরে আমাকে আর অন্য কয়েকজনকে ‘তুই’ বলা শুরু করলেন, কফি হাউসের আড্ডায় একটুও আর মাস্টারনি থাকতেন না। হারিয়ে গেছে সেই সব দিন।

অনেক দিনের আমাদের এসব গান সুদীর্ঘ বিরতিতে জলছাপের অস্পষ্টতা ছাড়িয়ে পুনর্জন্ম লাভ করেছিল গত ২০ জানুয়ারি কলকাতা বইমেলা প্রাঙ্গণে, ওই হ্যাম রেডিওর সৌজন্যে। আমার সঙ্গে একই উড়ালে ছিলেন ঢাকার শামসুল হুদা। কুয়াশার জন্য উড়ালে সাড়ে তিন ঘণ্টার বিলম্ব। ঢাকা বিমানবন্দর লাউঞ্জ থেকেই গৌতমের সঙ্গে কথা হলো। বেলা তিনটায় মেলার মাঠে ঢুকব, তার অনেক আগেই ওরা অপেক্ষমাণ। কলকাতার অনেক সাংবাদিক। সঙ্গে ঢাকার নিউজ চ্যানেলের কয়েকজন। ঢাকা থেকে আমিই স্থান নির্বাচন করে দিয়েছিলাম। মূল মিলনায়তনের ঠিক পেছনে। কী সুন্দর কাকতালীয় যোগ। উল্টো দিকের একটি প্যাভিলিয়নের দেয়ালে লেখা—‘ভালোবাসা নিয়ো কলকাতা’। শিশুদের মতো দৌড় দিয়ে পরস্পরের আলিঙ্গন ও প্রায় উদ্দাম নৃত্য। এই বার্তা রটে গেছে মেলার চারদিকে। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে উত্তেজিত আমরা।

দীপক চৌধুরীর বাড়িতে তিন বন্ধু, সঙ্গে আছে দীপক চৌধুরীর বোন ও নাতনি

কম বয়সের ভালোবাসার বোধ করি মৃত্যু নেই। হইচই চলল অনেকক্ষণ। বার্ধক্যের বাধা মানতেই হলো। তারপরও কিন্তু ক্ষান্ত দেয়নি হ্যাম রেডিও। গৌতম আর দীপকের বাড়িতে কখন পৌঁছাচ্ছি, খাবারের মেনুতে কী আছে, ভিডিও হচ্ছে কি না, প্রতিদিন নানা প্রশ্ন। আমাদের এই পুনর্মিলনী যে কতটা সম্প্রচারিত হয়েছে, তার প্রথম প্রতিক্রিয়া পেলাম ফিনল্যান্ডের এক বন্ধুর কাছ থেকে, তারপর যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালি বন্ধুরা ভাইরাল হওয়া ভিডিও পাঠাচ্ছেন। রাস্তা পার হওয়ার পর একজন ট্রাক ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে আমাকে বলছেন, ‘ও কাকু, আপনার ভিডিও দেখেছি, দারুণ।’ কলকাতার পথেঘাটে এমনকি মেট্রোতে মানুষ জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আপনি তো ওই তিন মূর্তির একজন।’ হয়তো আধুনিক প্রযুক্তির জন্য সবকিছু হয়েছে। কিন্তু শামসুল, অম্বরীশ, অলকাভ, সম্বৃতা—ওরাই সব। আর মানতেই হবে, সত্যিকার বন্ধুত্বের শক্তি।