Thank you for trying Sticky AMP!!

ঘরের বাইরে সাহ্রি

পুরান ঢাকার আল রাজ্জাক হোটেলে সাহ্‌রির সময়ে ভিড়। ছবিটি ২১ মে রাত ২টা ৩৫ মিনিটে তোলা। ছবি: অধুনা
>দিন বদলে যায়, মানুষ বদলে যায়, অভ্যাস বদলে যায়, ভাবনা বদলে যায়। এই বদলে যাওয়ার হাওয়া এসে লেগেছে এই নগরে সিয়াম সাধনার এই পবিত্র রমজান মাসেও


ছোটবেলায় রোজার মাসে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় আম্মাকে পইপই করে বলে দিতাম যেন ভোররাতে ঘুম থেকে ডেকে দেন। কখনো ডেকে দিতেন আবার কখনো দিতেন না। ভোররাতে তিন ভাইবোন আম্মাকে ঘিরে মাটিতে বসে আছি, আম্মা তাঁর প্লেটে আম দিয়ে বা কলা দিয়ে দুধভাত মাখছেন। তারপর তিন ভাইবোনের প্লেটে সমান ভাগ করে দিচ্ছেন আর আমরা পরম তৃপ্তি নিয়ে দুধভাত খাচ্ছি সাহ্‌রিতে।

এক রাতে আমাকে সাহ্‌রিতে ডাকলেন না আম্মা। সকালে ঘুম থেকে উঠেই কান্নাকাটি শুরু করে দিলাম। তারপর জেদ করে না খেয়েই রোজা রাখা শুরু করলাম। আব্বা এলেন অফিস থেকে। তখনো না খেয়ে আছি শুনে হায় হায় করে উঠলেন। ছোট একটা মানুষ না খেয়ে আছি, এটা তিনি মেনে নিতেই পারছিলেন না। তারপর হলো নানা প্রলোভন। চকলেট, আইসক্রিম, শিশুপার্ক, খেলনা গাড়িতেও যখন কিছু হলো না, তখন প্রয়োগ করলেন ব্রহ্মমন্ত্র, পেপসি। সেই সময়ে আড়াই-তিন টাকা দামের একটা পেপসির বোতল আমাদের মতো ছোট মানুষের জন্য অনেক বড় একটা ব্যাপার। একে উপেক্ষা করা বড় কঠিন। আব্বা পাশে বসে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘বাবা, যতই কষ্টই হোক, সাহ্‌রি করে রোজা রাখিস।’

ফ্রিজ ছিল না বাসায়। ঠান্ডা শরবত খেতে হলে দৌড়ে যেতে হতো রাস্তায়। ছালার ওপর বিশাল আকারের বরফ দিয়ে বিক্রেতার ‘এ্যাই বরফ বরফ’ ডাক এখনো কানে বাজে। হাতুড়ি-বাটাল দিয়ে ভাঙা আট আনার একটু টুকরো বরফ হাতে নিয়ে এক দৌড়ে বাসায় এসে মায়ের হাতে তুলে দেওয়ার আনন্দ আর যেন কিছুতেই ছিল না।

আহা, কী সুন্দর নিষ্পাপ শৈশবের দিনগুলো। আমাদের সাদাকালো টেলিভিশনের দিনগুলো। আহা, আমাদের মাটির চুলোর দিনগুলো। আহা, আমাদের চার আনা-আট আনার দিনগুলো।
দিন বদলে যায়, মানুষ বদলে যায়, অভ্যাস বদলে যায়, ভাবনা বদলে যায়। এই বদলে যাওয়ার হাওয়া এসে লেগেছে এই নগরে সিয়াম সাধনার এই পবিত্র রমজান মাসেও। যেখানে একসময় পাড়ায় পাড়ায় মানুষজন গান গেয়ে, মাইকিং করে মানুষজনকে সাহ্‌রি করার জন্য ঘুম থেকে জাগাত, সুনসান শহরে গভীর রাতে ‘ওঠেন, আর ঘুমাবেন না, ঘুম থেকে রোজা ভালো, নামাজ ভালো, ঘুমতে ভালো না, ওঠেএএএন’ বলে সুর করে ডাকত, সেই শহরে রাতের নীরবতা খানখান করে দেয় গাড়ির হর্ন, মানুষজনের হইহুল্লুড়। এই নগরীতে চালু হয়েছে এক নতুন সংস্কৃতি, মধ্যরাতে হোটেলে গিয়ে সাহ্‌রি করার সংস্কৃতি। হালের ট্রেন্ড এটা। পাঁচ-সাত বছর আগে থেকে স্বল্প পরিসরে শুরু হয়েছিল এই দল বেঁধে হোটেলে গিয়ে সাহ্‌রি করার বিষয়টা। ধীরে ধীরে সেটা ছড়িয়ে পড়েছে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। পাঁচ তারকা হোটেল থেকে শুরু করে মধ্যম সারির হোটেলগুলোতে তিল ধারণের জায়গা পাওয়া যায় না মধ্যরাতের পর থেকে। এক দল হাপুসহুপুস করে খাচ্ছে আর এক দল চেয়ার ধরে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে টেবিল দখলের জন্য। ওয়েটাররাও ভাত-তরকারির প্লেট নিয়ে ছুটোছুটি করেন হোটেলজুড়ে। গত বছর পুরান ঢাকার এক হোটেলের এক ওয়েটার আমার এক বন্ধুর গায়ের ওপর এক বড় বাটি খাসির রেজালা ফেলে দেন। সে কী কাণ্ড। তাই বন্ধু এবার ঠিক করেছে, রাত ১০-১১টার দিকেই হোটেলে গিয়ে খেয়ে নেবে, তারপর ভোর তিনটায় ফেসবুকে পোস্ট দেবে। হোটেলে খাওয়াও হলো, আবার ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ট্রেন্ডের সঙ্গেও থাকা গেল। এ এক আজব কাণ্ড।

বিভিন্ন করপোরেট হাউসও শামিল হয়েছে এই সাহ্‌রি উৎসবে। কাস্টমার নাইট করার জন্য বেছে নিচ্ছে এই মাসটাকে। ক্রেডিট কার্ডে চলছে অফারের ছড়াছড়ি। ‘বাই ওয়ান গেট ওয়ান সাহ্‌রি ফ্রি’ অফারের মেসেজে মোবাইল ভরে যাচ্ছে। এসবের মাঝ দিয়ে বিশাল বিশাল হলরুম ভাড়া নিয়ে ‘সাহ্‌রি ফেস্ট’ও চালু করে দিয়েছে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলো। বিশাল হলঘরের চারপাশে দেশের নামকরা সব হোটেল-রেস্তোরাঁ স্টল সাজিয়ে বসে থাকে। সঙ্গে তাদের হরেক রকমের বাহারি খাবার। কাবাব পোড়ার গন্ধ আর বিরিয়ানির সুঘ্রাণ মিলেমিশে একাকার। হাজারো ভোজনরসিক মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে হাজির সেই ফেস্টিভ্যালে। এক স্টল থেকে কাবাব খেয়েই সটকে অন্য স্টলে তেহারি খেতে। তারপর কোনো জুসবারে।

গত বছর এক বন্ধুর বাসায় সাহ্‌রির দাওয়াত ছিল। এ পর্যন্ত দুই বন্ধুর বাসায় দাওয়াত পেয়েছি। তবে এখন পর্যন্ত কোনো করপোরেট দাওয়াত পাইনি। আশা করি পেয়ে যাব। এভাবেই নগরীতে স্থান করে নিয়েছে সাহ্‌রি কালচার। দিনে দিনে আরও শক্ত অবস্থান নেবে সেটা বলে দেওয়া যায়। যদিও অনেকের কাছেই বিষয়টা ভালো লাগবে না বা লাগছে না। তারপরও এভাবেই আমাদের গল্পগুলো বদলে যায়, শহরের গল্পগুলো বদলে যায়।