Thank you for trying Sticky AMP!!

দেশি মোরগের ঝুনুর পোলাও

নারিন্দার ঝুনুর পোলাও। ছবি: প্রথম আলো

বলধা গার্ডেন থেকে নারিন্দার দিকে হাঁটতে থাকলে প্রথমেই বাঁয়ে পড়বে খ্রিষ্টান কবরস্থান। সেটা ছাড়িয়ে নারিন্দা মোড়ে এলে দেখা যাবে ‘ঝুনু পোলাও ঘর’। ছোট্ট একটা দোকান। সাধারণত ঢাকায় বিরিয়ানির দোকানগুলো যেমন হয়, তেমনই এখানেও দোকানের মুখে বিশাল হাঁড়ি। পাশে ম্যানেজারের বসার জায়গা। এরপর দুই সারিতে বেশ কিছু চেয়ার–টেবিল। একদম পেছনে হাতা ধোয়ার ব্যবস্থা, আর তার পাশেই কোমল পানীয়র জন্য ফ্রিজ।

পুরান ঢাকা মানেই ঐতিহ্যের সমাহার। এখানে রাস্তার পর রাস্তা পেরিয়ে যাওয়ার সময় পোলাও, বিরিয়ানি আর ভুনা খিচুড়ির খুশবুতে ভরে ওঠে নাক, আর সে পথেই তৃপ্ত করে মন। চাল আর মাংসের নানা পদ যেন পুরান ঢাকার মানুষের নিত্যসঙ্গী। ঝুনু পোলাও ঘরের একটি বড় পাতিলে পোলাও, একটা ছোট হাঁড়িতে মুরগির মাংস আর আরও ছোট এক হাঁড়িতে গিলা-কলিজা-মাথা। এই নিয়েই আয়োজন। ঝুনুর পোলাওয়ের মূল বৈশিষ্ট্যই হলো এরা রান্নায় ব্যবহার করে দেশি মোরগ। হাফ প্লেট মোরগ পোলাওয়ের দাম ১২০ টাকা। এই পরিবেশনায় থাকে এক টুকরো মাংস (খুব বড় নয়), একটা ডিম, কিছু গিলা-কলিজা-মাথা আর একটা আলাদা ছোট প্লেটে পেঁয়াজ, লেবু, মরিচের সালাদ। ব্যস! হাত ডুবিয়ে রসনা পরিতৃপ্ত করতে কতক্ষণ?

খাওয়ার আগেই একটু বাৎচিত করে নিই যিনি ক্যাশে বসে আছেন, তাঁর সঙ্গে। দুপুরের ব্যস্ততার সময় তাঁকে জ্বালাতন করছি ভেবে একটু বিরক্ত হলেন কি তিনি? কিন্তু দেখলাম, এই হালকা বিরক্তির মাঝে আছে একটা উৎসুক মনও। কেন, কী জানতে চাইছি, সেসব প্রশ্ন করার পর আমাদের প্রশ্নের তোড়ে বিভ্রান্ত হয়ে বললেন, ‘এত কথা একলগে জিগাইলে কী জবাব দিমু?’

তখন আবার আলাদা করে প্রশ্ন করতে হয়। ‘কবে থেকে এই পোলাও ঘর?’

‘কত সনে বলতে পারি না। ৪৭-৪৮ বছর আগে। তখন তো আমি ছিলাম না।’

‘আপনার নাম কী? আপনি কি ম্যানেজার?’

‘আমার নাম মো. শামীম। মালিকও না, ম্যানেজারও না। এইখানে বসি।’

‘এখানে কি খুব ভিড় হয়?’

‘লাঞ্চ টাইমে দুই–চাইরজন আসে। তারপর এক এক করে আসে। আমগো এইখানে মুরগি হইল অরিজিনাল দেশি। পাকিস্তানি কক না।’

দেখা গেছে, আমাদের দেশে একজনের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলে পাশের মানুষটাও কথা বলার জন্য উসখুস করতে থাকেন। এখানেও ব্যতিক্রম হলো না। মো. শামীম একটু থামতেই দোকানের হাঁড়ির খবর দিতে শুরু করলেন বেয়ারা দুদু মিয়া। ‘আমগো দোকান রোজ দেড়টা থিকা রাত ১১টা পর্যন্ত খোলা। গিলা–কলিজা ওই অরিজিনাল দেশি মুরগিরই। চাবাইয়া খাইবেন।’ তাঁর কাছ থেকেই জানা যায়, ১৯৭০ সালে মো. নুর মোহাম্মদ দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই ছোট পরিসরেই তিনি শুরু করেছিলেন পোলাও বিক্রির কাজ। আস্তে আস্তে মানুষ ভালোবেসে ফেলেছে অল্প তেল দিয়ে তৈরি এই পোলাও। নুর মোহাম্মদ মারা গেছেন। এখন ব্যবসা দেখেন পরিবারের লোকজন।

এরই মধ্যে ভরে গেছে কয়েকটি টেবিল। তরিকুল ইসলাম এসেছেন সাতক্ষীরা থেকে। গ্রামের পরিচিত ভাইয়ের কাছে কাজে এসেছেন। সেই ভাই–ই এখানে নিয়ে এসেছেন তরিকুলকে। সেই ভাইকেই জিজ্ঞেস করি, ‘আপনার নাম?’

‘আমার নাম তুহীন রহমান। আমি প্রিন্টিং প্রেসে মেকানিকের কাজ করি।’

‘এখানে তো অনেক খাবারের দোকান। তরিকুল সাহেবকে ঝুনুর পোলাও ঘরে নিয়ে এলেন কেন?’

‘আরে কয় কী! এই রকম সুস্বাদু পোলাও কই পাইবেন?’ সাতক্ষীরা থেকে আসা তুহীন রহমানের উচ্চারণে ঢাকাইয়া ছাপ পরিষ্কার। আমি যেন তাঁর কথা হৃদয়ঙ্গম করতে পারি, তাই তিনি যোগ করেন, ‘পুরোনো ঐতিহ্য, ভাই! খাওয়ার মান ভালো। পরিষ্কার হোটেল। আমরা এখানেই খাওয়া দাওয়া করি।’

খেয়েদেয়ে আমরা যখন বের হচ্ছি দোকান থেকে, তখন মোটরসাইকেলে একজন সেখানে এসে হাজির হন। ভালো করে সাইনবোর্ড দেখেন। তারপর মো. শামীমকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এটাই কি অরিজিনাল ঝুনুর পোলাও?’

শামীম মাথা নাড়েন।

ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে এটাই ‘অরিজিনাল’ কি না, তা নিশ্চিন্ত হয়ে নেন। তারপর বলেন, ‘ধানমন্ডি থেকে এসেছি। আপনাদের দোকানের পোলাও নিতে বলেছে। অনেকগুলো প্যাকেট নেব। পর্যাপ্ত আছে তো?’

মো. শামীমের ঠোঁটে দেখা গেল এক মনোমুগ্ধকর হাসি।

‘৪০ কেজি পোলাও খায়া শেষ করা পারবেন না!’ গর্ব করে বললেন তিনি।

ততক্ষণে পাতিলের ঢাকনা সরিয়ে একসঙ্গে নয়টা প্যাকেট খোলা হয়ে গেছে। সেখানে একটু পোলাও, একটা ডিম আর একটা করে মুরগির টুকরো ঢুকে পড়ছে অনায়াসেই।