Thank you for trying Sticky AMP!!

প্রকৃতি এ সময় সেজে ওঠে রঙিনভাবে

বনে বনে বসন্তের ফুল

বসন্তের আগমন টের পাওয়া যাচ্ছে গাছের দিকে তাকালেই। নতুন পাতা আর ফুলে ছেঁয়ে যাওয়ার দিন শুরু হলো বলে...

এ এক অপার্থিব সৌন্দর্য! শীতে শীর্ণ গাছগুলো অনেক ঝরিয়েছে পাতা। ফাগুনের ঝিরিঝিরি দখিনা বাতাসে অল্প অল্প উড়ছে ঝরা পাতাগুলো। বনে বনে ধ্বনিত হচ্ছে পাতা ঝরার গান। একটু ওমের পরশ পেতেই গাছের ডালে ডালে উঁকি দিচ্ছে নতুন পাতা, নতুন কুঁড়ি। বসন্তের আগমনে নবপত্রপল্লবে শোভিত হয়ে উঠছে বনরাজি, ফুলের বাগান। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বনরাজির এই বসন্ত রূপকে বলেছেন, ‘এলো বনান্তে পাগল বসন্ত/ বনে বনে মনে মনে রং সে ছড়ায় রে, চঞ্চল তরুণ দুরন্ত।’ এখন যেন শুধুই অপেক্ষা বসন্তের আগমনের।

মাঘের শেষে বিকেলের সূর্যটা হেলে পড়েছে পশ্চিমে। ম্রিয়মাণ আলুথালু সূর্যের আলো এসে পড়েছে খুলনার শহীদ হাদিস পার্কের পুবের একটি গাছে ফোটা ফুলগুলোর গায়ে। রৌদ্রবতী সে ফুলের নাম রুদ্রপলাশ। এ ফুলের রং হয় সাধারণত লাল, পলাশের মতোই। কিন্তু এই দুর্লভ বাসন্তী রঙের রুদ্রপলাশগুলো দেখে শিহরিত হলাম। বসন্তের ফুল পলাশ। এ দেশের অনেক জায়গায় ফোটে এই ফুল। শিমুল-পলাশকে বলা হয় বসন্তের প্রতীক। এই শিমুল ও পলাশের লাল ছাড়া হলুদ ফুলেরও দেখা মেলে এ দেশে।

বাসন্তী রঙের রুদ্রপলাশ

ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বোটানিক্যাল গার্ডেনে রয়েছে হলুদ পলাশের গাছ। সেখানে গেলে দেখা মেলে পাখি ফুল বা লাল ব্রাউনিয়ার। আহা কী লাল থোকায় ঠাসা ফুলের মঞ্জরি! সবুজ পত্রপল্লবের ঘন পাতার মধ্যে যেন বাংলাদেশের পতাকা। সে উদ্যানে রয়েছে কুরচি, অশোক, স্বর্ণঅশোক, পারিজাত। তবে কুরচি ফুলের অভূতপূর্ব স্ফুরণ চোখে পড়ে বান্দরবানের পাহাড়গুলোয়। বরিশাল বা উপকূলীয় অঞ্চলের ডোবাগুলোয় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে পানিয়া মাদারের গাছ।

স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ এদের পছন্দ। বসন্ত ছাড়া আর কখনোই যেন ওদের চোখে পড়ে না। বসন্ত এলেই ডালগুলোর মাথায় থোকা ধরে ফোটে মেরুন লাল রঙের ফুল। গন্ধহীন ফুল, তবু মধুপিয়াসী মৌমাছিরা ভিড় করে সেসব ফুলে। পানিয়া মাদারের মতো পাটকেল মাদারও অনন্য এক বসন্তের বনজ ফুল। এর অভিজাত নাম পারিজাত। ফুল ফুটলে তার টকটকে উজ্জ্বল রং শোভা ছড়ায়, ফুলে আসে বুলবুলি পাখি।

দেবকাঞ্চন

‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত’—কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো কাব্য করে কে আর এর চেয়ে ভালো বসন্ত ফুলের কথা বলতে পারে? তবে শূন্য পাতার পূর্ণ ফুলে উচ্ছ্বসিত দেবকাঞ্চনের গোলাপি লাজুক রূপ যে না দেখেছে, সে আসলে কখনোই বুঝবে না পুষ্প-পাগলপারা বসন্তকে। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু পেরোতেই দেবকাঞ্চনের এই উচ্ছ্বাস চোখ এড়ায় না।

কাঁচা সোনারঙের কনকচাঁপা

কয়েক বছর আগে এই বসন্তেই দেখেছিলাম, রাঙামাটির রাজবাড়ি রোডের এক স্থানে সুরভিত কাঁচা সোনারঙের কনকচাঁপার থোকা ধরা ফুল। এই ফুল নিসর্গী দ্বিজেন শর্মারও খুব প্রিয় ছিল। তিনি একে লালন করেছিলেন কন্যার মতো, কন্যাদানের মতো সে গাছটিকে একদিন দান করেছিলেন ঢাকার রমনা উদ্যানে। বাংলাদেশ সচিবালয়ের ৪ নম্বর ভবনের প্রবেশমুখের দুই পাশেও রয়েছে দুটি কনকচাঁপা ফুলের ঝোপাল গাছ। বসন্তে সে গাছ দুটিতে ফুল ফুটে মুগ্ধতা ছড়ায়। ফুলগাছ না হয়েও তার ফুলগুলো যেন ‘স্বর্গভোলা পারিজাতের গন্ধখানি এসে/ খ্যাপা হাওয়ায় বুকের ভিতর ফিরবে ভেসে ভেসে।’

সুমধুর সুগন্ধ ভেসে আসে বসন্তের আরেক দুর্লভ ফুল মাধবীলতা থেকে। এই মাধবীলতা কিন্তু আমাদের সচরাচর দেখা মাধবীলতা যাকে বলি, সে নয়। মাধবীলতার ফুল ছোট আর ঘিয়ে রঙের। অত্যন্ত সুগন্ধময় ও দুর্লভ গাছ। একসময় রমনা উদ্যানে এ গাছের একটি বড় ঝোপ ছিল। যশোরের বেনাপোল সীমান্তের কোলে পাঠবাড়ি আশ্রমেও মাধবীলতার একটি পুরোনো গাছ দেখেছিলাম। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই এর নাম রেখেছিলেন। তাঁর কথায় ‘বসন্তের মাধবী মঞ্জরী মিলনের স্বর্ণপাত্রে সুধা দিল ভরি।’ বসন্ত সাজে মেয়েদের খোঁপায় দেওয়ার ফুল করবী প্রচুর ফোটে এ সময়।

পাঁথরকুচি অপরূপ রূপ

বনপথে বসন্তের বনফুল—সেও এক অপরূপ বাংলার রূপ। এ সময় জীবনানন্দ দাশের ভাঁটফুলকে যে না দেখেছে, সে কখনো বুঝবে না যে জঙ্গল-ঝোপ আলো করার কী শক্তি রয়েছে বাংলার বনফুলগুলোর। বুনো টগর, দাঁতরঙা বা লুটকি, সজিনা, আষাঢ়ি লতা, বরুণ, মুচকুন্দ—কত যে বুনো ফুল ফোটে এই বসন্তে। ফাল্গুন আর চৈত্র মিলে এ দেশের বসন্তকাল হলেও প্রথম মাসেই জাগে যত ফুলের শিহরণ, চৈত্রের দাবদাহে সেগুলো হয়ে যায় খানিকটা ম্রিয়মাণ। বসন্ত ফুরাতেই মনে হবে ‘ফাগুন পুরাবে যবে—/ উঠিবে দীরঘ শ্বাস চম্পার বনে/কোয়েলা নীরব হবে।’