Thank you for trying Sticky AMP!!

২৩ বছর ধরে সেই ‘প্রেসক্রিপশন’ যত্ন করে রেখেছি

সংগ্রহে রাখা স্মৃতিগুলো

আমার সন্তান সম্প্রতি প্রকৌশলী হয়েছে, এই তো সেদিন তার সমাবর্তন হলো। সন্তানের এ সাফল্যের দিনে আমার মন আমাকে ২৩ বছর আগের দিনগুলোয় ফিরিয়ে নিয়ে গেল। পৃথিবীতে আসবে আমার দ্বিতীয় সন্তান। হাসপাতালে পরিবারের অনেকে এসেছেন। আমিও শারীরিকভাবে পুরোপুরি ফিট। নিজে চিকিৎসক হওয়ার সুবাদে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় নারীদের বিভিন্ন জটিলতা সম্বন্ধে আগে থেকেই জ্ঞান রাখি। প্রেগনেন্সির পুরো সময়ে তাই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছি। নির্ধারিত সময়ে হাসপাতালে যাওয়ার পর সন্তান পৃথিবীতে এল। কিন্তু আমার হঠাৎ দেখা দিল জটিলতা। ইউটেরাস কন্ট্রাক্ট করছে না, তাই রক্তপাতও বন্ধ হচ্ছে না। একাধারে রক্তক্ষরণ হওয়ায় একসময় জ্ঞান হারালাম। পুরো একটা দিন আমি অচেতন।

বাইরে তখন পরিবারের সদস্যসহ চিকিৎসক, নার্স আর কর্মকর্তারা বিচলিত। কেউ কেউ আশাও ছেড়ে দিতে শুরু করলেন। কিন্তু চিকিৎসকেরা চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। ৯ ইউনিট রক্ত দেওয়া হলো আমাকে। গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সেবাদানের পর ক্রমে আমার চেতনা ফিরে আসে। একটা সময় সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরে এলাম।

আমি আমার সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে দ্বিতীয় সন্তান জন্মের পরপরই বাঁচা না–বাঁচার দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছিলাম। সে সময় অপারেশন থিয়েটার থেকে পোস্ট–অপারেটিভ কক্ষ পর্যন্ত দু–তিন দিন সর্বোচ্চ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সময় কাটিয়েছেন আমার স্বামী, মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়িসহ ভাইবোন ও আত্মীয়রা। এ জটিলতা এখন অনেক কমেছে, তবে আরও সচেতনতায় সেটা একেবারে কমিয়ে ফেলা সম্ভব।

কয়েক বছর পর সন্তানেরা একটু বড় হলে সেই হাসপাতালের কেবিনটা ঘুরিয়ে এনেছিলাম

নিজের অভিজ্ঞতার কথা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ একজন চিকিৎসক হওয়ায় নিজে বিষয়গুলো জানি। আর তাই মেনেও চলেছি, কিন্তু তারপরও প্রসবপরবর্তী জটিলতায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে বেঁচে ফিরেছি। অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালে সময়টা পৃথিবীর সব প্রান্তের নারীর জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রসবকালীন ও প্রসবপরবর্তী ব্যবস্থাপনাগুলো সঠিক সময়ে ও সঠিকভাবে না হলে সন্তানকে হতে হয় এতিম, গোছানো পরিবারটি হয়ে পড়ে এলোমেলো, অভিভাবকহীন, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। অথচ অন্তঃসত্ত্বা নারী সময়মতো সুচিকিৎসা নিলে এই মাতৃমৃত্যু কমানো সম্ভব। দেশে মাতৃমৃত্যুর হার বর্তমানে লাখে ১৬৫ জন। তিন দশক আগেও যা ছিল ৫৭৪ জন! এটাই সুখের বিষয় যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হলেও দেশে মাতৃমৃত্যুর হার দিন দিন কমছে। এর অর্থ মানুষ সচেতন হচ্ছে এবং দেশে অন্তঃসত্ত্বা নারীরা চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন। তবে প্রসবকালীন স্বাস্থ্যসচেতনতা বিষয়ে আরও বেশি প্রচারণা চালাতে হবে। অনেকে এক থেকে দুবার চিকিৎসকের কাছে গেলেও সব ঠিক আছে ভেবে আর যেতে চান না। তবে এ সময়ে মায়েদের শারীরিক অবস্থা যেকোনো সময় পরিবর্তন হতে পারে। তাই পুরো গর্ভকাল চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে।

মেয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মা

আমি ২৩ বছর আগে আমার প্রসবপরবর্তী স্বাস্থ্যজটিলতার কথা বলছিলাম। যে সময় আমি অচেতন ছিলাম, আমার পরিবার ও হাসপাতালের স্টাফদের কাছে পরে জেনেছি, তাঁরা সবাই সে সময় প্রতিটা মুহূর্ত কী প্রবল দুশ্চিন্তার ভেতর কাটিয়েছেন। সন্তানের বয়স দুই মাস হয়ে গেলে হাসপাতালের অনুমতিক্রমে আমার প্রসবকালীন ফাইলটি হাতে নিয়ে শ্রদ্ধাভরে হাত বুলিয়েছি। পরিবারের মানুষেরা ছাড়াও যাঁরা সে সময় আমার চিকিৎসাসেবার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি। বিশেষ করে যাঁরা সেই সময় আমাকে রক্তদান করেছিলেন, তাঁদের প্রতি আজীবনের কৃতজ্ঞতা। সে ফাইল পরে কপি করে আমার ঘরে রাখি। আমার জীবনের নানা বিশেষ বস্তু সংগ্রহে আছে। যে চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থাপনা আমাকে বাঁচিয়ে তুলেছে, আমাকে আমার প্রিয়তম স্বামীর সঙ্গে, পরিবারের সঙ্গে থাকতে দিয়েছে, সেই চিকিৎসাসেবার ধারাবাহিক লিখিত নোটগুলো আমার জীবনের মহামূল্যবান সম্পদ বলেই আমার মনে হয়েছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ, তিনি আমাকে আমার সন্তানদের বেড়ে ওঠা দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। আমার সেই সন্তানই প্রকৌশলী হয়েছে, সম্প্রতি তার সমাবর্তন অনুষ্ঠানও হয়েছে। সন্তানের এই সাফল্যের দিনেও আমার মন তাই আমাকে ২৩ বছর আগের সেই দিনগুলোয় ফিরিয়ে নিয়ে গেল।

একজন চিকিৎসক হিসেবে নারী দিবসে আমার চাওয়া, পৃথিবীর সব অন্তঃসত্ত্বা নারীর প্রসব ও প্রসবপরবর্তী ব্যবস্থাপনা হোক নিরাপদ।

লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, অ্যানাটমি বিভাগ, এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুর