Thank you for trying Sticky AMP!!

ঈদের ছুটিতে ঘুরে আসুন প্রাচীন বাংলায়

এবার ঈদের ছুটিতেই ঘুরে আসতে পারেন প্রাচীন বাংলায়! দেখে নিতে পারেন হাজার বছর আগের মহাবিহারগুলোর ধ্বংসস্তূপ (প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়)। এ পথে আসলে একই সঙ্গে দেখা মিলবে বাংলায় কৈবর্ত বিদ্রোহের স্মারক, গড়ুর স্তম্ভ, যাতে একখানি প্রস্তরখন্ডে হাজার বছর আগের খোদাই করা রয়েছে বাংলার ইতিহাসের কিছু অংশ। দেখা যাবে মুঘল আমলে দুর্গ শহর খ্যাত মাহীসন্তোষ। আরও দেখতে পারবেন বুড়িদহের পিতলের রথ, আলাউদ্দিন হোসেন শাহর আমলে নির্মিত কুসুম্বা মসজিদ। 

ট্রেনে এলে বগুড়ার সান্তাহার স্টেশনে নামতে হবে। আর বাসে এলে সরাসরি নওগাঁ সদরে নামতে হবে। এখান থেকেই যাত্রা শুরু করা যেতে পারে।

পাহাড়পুর বিহার বা সোমপুর বিহারের ধ্বংসাবশেষ। ছবি: অণু তারেক

পাহাড়পুর বিহার বা সোমপুর বিহার

প্রথমেই পাহাড়পুর বিহার। এটার প্রকৃত নাম সোমপুর বিহার। এটি বাংলাদেশসহ নওগাঁ জেলার আন্তর্জাতিক পরিচিতি বহন করে। জায়গাটি নওগাঁ সদর থেকে ৩৪ কিলোমিটার উত্তর দিকে বদলগাছি উপজেলায় পড়েছে। আবার জয়পুর হাটের জামালগঞ্জ স্টেশন থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিম দিকে এই বিহার। এটি জঙ্গলাকীর্ণ অবস্থায় পড়েছিল। ১৯২৩ সালে এর উৎখনন শুরু হয়। ১৯৩৪ সালে শেষ হয়। জানা যায়, পাল বংশের শাসনামলে দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল অষ্টম শতকে পিতৃভূমি বরেন্দ্র এক বিশাল বৌদ্ধ মন্দির স্থাপনের লক্ষ্যে পাহাড়পুরে সোমপুর বিহার স্থাপন করেন। খননকালে প্রাপ্ত একটি মাটির সিল থেকে জানা যায়, এটি সোমপুর বিহার। ২৭ একর জমির ওপরে এটি স্থাপিত। এটি এশিয়ার বৃহত্তম বিহার। এর চতুর্দিকে সারিবদ্ধভাবে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য ১৭৭টি কক্ষ রয়েছে।

সমগ্র বিহারটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। উত্তর দিকে প্রবেশপথ ছিল। মূল দালানে ওঠার সিঁড়িও ছিল। এটি দুর্গের মতো করে তৈরি করা হয়েছিল। এর প্রধান মন্দিরের ভিত্তিমূল সংলগ্ন দেওয়ালে ৩৬টি পাথরের মূর্তি রয়েছে। ভেতরের মন্দিরের গায়ে ২ হাজার পোড়ামাটির চিত্রফলক রয়েছে। খননকালে প্রায় ৮০০ পোড়ামাটির চিত্রফলক বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকা অবস্থা পাওয়া যায়।
এই বিহার জ্ঞান-বিজ্ঞান, মীমাংসা ও ধর্মশাস্ত্র চর্চার জন্য একটি উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদমর্যাদা লাভ করেছিল। পৃথিবীর নান দেশে থেকে এখানে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান লাভের জন্য আসতেন। আচার্য অতীশ দীপঙ্কর সোমপুর বিহারে কিছুকাল বাস করেছেন। তাঁর গুরু রত্মকর শান্তি সোমপুর বিহারের মহাস্থবির ছিলেন। এখানে আরও অবস্থান করতেন প্রাচীন চর্যাপদের গীতিকার কাহ্নপা ও তাঁর গুরু জলন্ধরী পা ওরফে হাড়ী পা।
এখানকার উদ্ধারকৃত প্রত্নবস্তু নিয়ে একটি জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে। অতিথিদের থাকার জন্য বাংলো রয়েছে।

হলুদ বিহারের ধ্বংসাবশেষ। ছবি: অণু তারেক


হলুদ বিহার
পাহাড়পুরের ঠিক এক কিলোমিটার আগে পড়বে আরেকটি বিহার। বদলগাছি উপজেলার বিলাসবাড়ি ইউনিয়নের দ্বীপগঞ্জ গ্রামে অবস্থিত। এটি পাহাড়পুরের সমসাময়িক একটি বৌদ্ধ বিহার। এটিও অন্তত হাজার বছরের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমান হলুদ বিহার তথা দ্বীপগঞ্জ গ্রাম পুরোটাই প্রাচীন জনপদের ধ্বংসাবশেষের ওপর অবস্থিত বলে অনুমান করা যায়। এই গ্রামের সবখানেই প্রাচীন ইট, নকশা করা ইট, পোড়া মাটির চিত্রফলকের টুকরা, কোনো কোনো স্থানে প্রাচীন দালানের ভিত্তি চিহ্ন চোখে পরবে আপনার।

বটগোহালী বিহারের ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া ইট। ছবি: অণু তারেক


বটগোহালী বিহার
পাহাড়পুর বিহার থেকে তিন কিলোমিটার উত্তর পশ্চিম দিকে একটি প্রাচীন গ্রাম আছে। নাম বটগোহালী। এখানে একটি প্রাচীন জৈন বিহার ছিল। পাহাড়পুর বিহার খননকালে একটি পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। এই লিপি থেকে জানা যায় যে, এক ব্রাহ্মণ দম্পতি কর্তৃক বটগোহালীতে অবস্থিত একটি জৈন বিহারের ‘অইত’ পূজা ও একটি বিশ্রামাগারের জন্য কিছু রাষ্ট্রীয় ভূমি ক্রয় ও দান করা হয়েছিল। এই জৈন বিহারের প্রধান ছিলেন বিখ্যাত জৈন গুরু গুহ নন্দী এবং তাঁর বহু শিষ্য-প্রশিষ্য ছিলেন বলে জানা যায়। খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে জৈন বিহারটি যে একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ছিল পাণ্ডুলিপিটি তা প্রমাণ করে। এখানে এখনো যে কোনো জায়গার মাটি খুঁড়লে প্রাচীন ইটের প্রাচুর্য পাওয়া।
এখান থেকে প্রায় ১৫/২০ কিলোমিটার পশ্চিমে ধামুইরহাট উপজেলা। এখানে আরও কয়েকটি প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে।

ভিমের পান্টি বা গড়ুর স্তম্ভ
ধামুইরহাট থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে মঙ্গলবাড়ি। এখানে রয়েছে ভিমের পান্টি (স্থানীয় জনপ্রবাদ মতে)। আসলে এটি গড়ুর স্তম্ভ। একখণ্ড পাথরের স্তম্ভে শিলালেখ রয়েছে। এর শীর্ষদেশে একটি গড়ুর মূর্তি ছিল। বজ্রপাতে মূর্তিসহ ওপরের অংশটি ভেঙে গেছে। স্তম্ভটি একটু হেলে গেছে। এই স্তম্ভে সংস্কৃত ভাষায় ২৮ লাইনের একটি লিপি খোদাই করা আছে। স্তম্ভটি নিয়ে কিংবদন্তি হচ্ছে, মহাভারত খ্যাত ভীম রাতে হাল চাষ করতেন। সকাল হওয়ার আগেই তার ফিরে যাওয়ার নিয়ম ছিল। এক রাতে বিলম্ব হওয়ায় তাড়াহুড়া করে যাওয়ার সময় হাতের পান্টিটি ফেলে যান। সেটি বর্তমান স্তম্ভ।
তবে স্তম্ভটি পাঠোদ্ধার করা হয়েছে। এ থেকে জানা যায়, নবম-দশম শতকে পাল রাজা নারায়ণ পালের ব্রাহ্মণ মন্ত্রী মিশ্র বংশীয় ভট্টগুরব মিশ্র বিষ্ণুর উদ্দেশে এই স্তম্ভটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। লিপিতে মিশ্র বংশের বিশদ পরিচয় ও তাদের সঙ্গে পাল রাজাদের সম্পর্কের কথা উল্লেখ আছে।

জগদ্দল বিহারের ধ্বংসাবশেষ। ছবি: অণু তারেক


জগদ্দল বিহার
গড়ুর স্তম্ভ দেখে সেখান থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার উত্তরে গেলেই জগদ্দল বিহার। ধামুইরহাট উপজেলার জগদ্দল মৌজায় এটি অবস্থিত। এটিও হাজার বছরের প্রাচীন স্থাপনা। স্থানীয়ভাবে এটা রাজবাড়ি নামে পরিচিত। পাল রাজা রামপালের সময়ে এটি সমৃদ্ধির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। জানা যায়, এই বিদ্যানিকেতনে রচিত হয়েছিল ‘সুবাসিত রত্নকোষ’ নামক বাংলার প্রাচীন গ্রন্থ। এ ছাড়া পাল রাজাদের রাজকবি সন্ধ্যাকর নন্দী এখানে বসেই রচনা করেছিলেন বিখ্যাত ‘রামচরিতম’ কাব্যগ্রন্থ। ধারণা করা হয়, আর একটি বিখ্যাত প্রাচীন গ্রন্থ ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ এই বিহারেই রচিত হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এখানে উৎখনন শুরু করে। এখনো তা শেষ হয়নি। উন্মোচিত হয়েছে সিতা কোটের অনুরূপ চতুর্ভুজ আকৃতির মঠ। এর পূর্ব দেওয়ালের মাঝামাঝি স্থানে একটি প্রবেশ পথ আবিষ্কৃত হয়েছে। উৎখননে এখানে অনেক প্রত্নবস্তুরও সন্ধান মিলেছে। প্রায় এক হাজার বছরের প্রাচীন জগদ্দল বিহার বাংলাদেশের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন গুলির অন্যতম।

আলতা দিঘি
জগদ্দল বিহারের চার কিলোমিটারের মধ্যেই ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট সীমান্তে রয়েছে আরেক প্রাচীন ঐতিহ্য বহনকারী আলতা দিঘি। দিঘি সংলগ্ন শালবন এবং দিঘির সৌন্দর্যের আকর্ষণে পর্যটকেরা দলে দলে এখানে ভিড় করছেন। দিঘির পাশে শালবনে রয়েছে অজগর, তক্ষক ও বনমোরগ। ঘুরতে ঘুরতে এদের কারও সঙ্গে দেখাও হয়ে যেতে পারে।

প্রাচীন শহর মাহীসন্তোষ
এখান থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে পাল রাজা মহিপাল স্থাপিত বাংলার প্রাচীন শহর মাহীসন্তোষ। মুঘল আমলে এটি এ অঞ্চলের একটি দুর্গ শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। এরও আগে সুলতানি আমলে এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় সমমানের মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেখানে ভারতবর্ষসহ মধ্যপ্রাচ্যের ছাত্ররাও এসে অধ্যয়ন করেছেন। এখানে রয়েছে বখতিয়ার খলজির অন্যতম সেনাপতি শিরন খলজির মাজার। শহরটি বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত। মাটি খুঁড়লে প্রাচীন আমলের প্রচুর ইট পাথর পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকজন সেই ইট তুলে বাড়িঘর বানিয়েছেন।

অগ্রপুরী বিহারের ধ্বংসাবশেষ। ছবি: অণু তারেক


অগ্রপুরী বিহার
ধামুইরহাট থানা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে কাশিপুর মৌজায় আগ্রাদ্বিগুন বাজারের পশ্চিম পাশে পাহাড়ের মতো উঁচু বিরাট ঢিবি রয়েছে। এর ওপরের অংশ প্রায় সমতল। তিব্বতীয় সাহিত্যে এটাকে অগ্রপুরী বিহার বলা হয়েছে। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের আমলে নির্মিত এককালে এটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ছিল। এখানকার চার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে অসংখ্য প্রাচীন ইমারতের ধ্বংসস্তূপ রয়েছে। এলাকাজুড়ে অসংখ্য প্রাচীন জলাশয়েরও অস্তিত্ব দেখা যায়। এটি এখনো পুরোপুরি খনন সম্পন্ন হয়নি। এর ইতিহাস এখনো আমাদের অজানা রয়েছে।
ধামুইরহাটে রাত্রি যাপন করার জন্য জেলা পরিষদের বাংলো রয়েছে। এখানে থেকে পরের দিন ফের যাত্রা শুরু করা যায়।

নাথ সম্প্রদায়ের স্থাপনা
ধামুইরহাট থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দক্ষিণে পত্নীতলা উপজেলায় বাংলার নাথ সম্প্রদায়ের অন্যতম তীর্থস্থান রয়েছে। পত্নীতলা উপজেলার আমইর ইউনিয়নে প্রাচীন ইছামতী নদীর পশ্চিম পাশে যোগীঘোপা বা যোগীগোফা নামক স্থানে এই তীর্থস্থান। এখানে নাথ সম্প্রদায়ের কিছু প্রাচীন স্থাপনা রয়েছে। ধারণা করা হয়, এই জায়গাটির কাছেই আমইর নামক স্থানে পাল রাজা রামপাল প্রতিষ্ঠিত রামাবতী নগরী ছিল।

দিবরদিঘি। ছবি: অণু তারেক


দিবরদিঘি
নাথ সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে পত্নীতলা উপজেলায় রয়েছে দিবরদিঘি। এর মাঝখানে একটি ৩০ ফুট উঁচু স্তম্ভ রয়েছে। এর নাম দিব্য স্তম্ভ। এটা কৈবর্ত বিদ্রোহের স্মারক। বলা হয়, এটি প্রথম সফল বাঙালি বিদ্রোহের প্রতীক। রাজা দ্বিতীয় মহিপাল ১০৭০ খ্রিষ্টাব্দে গৌড় বরেন্দ্রের সিংহাসনে বসেন বলে অনুমান করা হয়। তার সময় কৈবর্ত্য প্রজারা বিদ্রোহ শুরু করেন। এ যুদ্ধে মহিপাল পরাজিত ও নিহত হন। কৈবর্ত প্রজাদের পক্ষে বরেন্দ্রী রাজা দিব্য সিংহাসনে বসেন। দিব্য তার বিজয় চিহ্ন হিসেবে দিবর নামক স্থানে একটি জলাশয় খনন করেন এবং স্তম্ভ নির্মাণ করেন। আজও কালের সাক্ষী অনেক স্মৃতি বুকে নিয়ে দিঘির মাঝখানে স্তম্ভটি দাঁড়িয়ে রয়েছে।

এখান থেকে সড়কপথে রাজশাহী ফিরতে চাইলে দেখা যাবে আরও কয়েকটি প্রাচীন নিদর্শন।
মান্দা ফেরিঘাট থেকে সাড়ে ৬ কিলোমিটার পূর্ব দিকে বুড়িদহ নামের একটা জায়গায় পিতলের রথ আছে। অনেক আগে থেকে সেখানে রথের মেলা হয়। সেখান থেকে রাজশাহী ফেরার পথে দেখা যাবে কুসুম্বা মসজিদ। এটি আলাউদ্দিন হোসেন শাহর আমলে নির্মিত। এটিই বাংলাদেশে পাথরের তৈরি একমাত্র মসজিদ। সামনে সুবিশাল দিঘি রয়েছে। দিঘিতে নৌকা রয়েছে একটু ঘোরাও যায়।

এই ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশের এই ঐতিহাসিক জায়গাগুলি ঘুরে দেখতে পারেন পরিবারসহ। হতে পারেন ইতিহাসের অংশ।