Thank you for trying Sticky AMP!!

পাহাড়ে ট্রেকিং, সাতজনের দলে আমি ছিলাম একা নারী

আলীকদম বউ বাজারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে চারপাশ অন্ধকার হয়ে এল। পাহাড়ি গাছপালার ফাঁকে উঁকি দিল এক খণ্ড মুক্তার মতো উজ্জ্বল একফালি চাঁদ। পূর্ণিমা না হলেও জ্যোৎস্নার অভাব নেই।

নিজস্ব সৌন্দর্যের পাশাপাশি বান্দরবানের আলাদা একটা গন্ধও আছে। বুনো গাছগাছালি, শিশিরে ভেজা পাহাড়ি মাটির গন্ধ। সবুজের, প্রকৃতির যে আলাদা গন্ধ আছে, তা শহরের পেট্রল, ডিজেল ও ড্রেনের গন্ধে চাপা পড়ে থাকে। জিপ থেকে নেমে ট্রেকিং শুরু করার আগে বুকভরে শ্বাস আর শহরের নিজস্ব সেই ঘ্রাণই নিজের ভেতরে নিচ্ছিলাম। আমাদের দলের লোকসংখ্যা সাত। এর ভেতর আমিই একমাত্র নারী।

পাহাড়ে ট্রেকিং বাংলাদেশের ভ্রমণপিপাসুদের মাঝেও খুব জনপ্রিয়

ট্রেকিং আমার খুব পছন্দ। হাইকিং আর ট্রেকিংয়ের সময়ই পথে পথে প্রকৃতির সব পরিবর্তন কাছ থেকে পরখ করা যায়। বোঝা যায়, এসব বিশালতার পাশে আমরা কত ক্ষুদ্র! এই ঝিরি পথ, এই পিচ্ছিল কিংবা ধারালো পাথর, এই হঠাৎ গিরি খাদ—এসব ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা আমাকে খুব আনন্দ দেয়। আমাকে জীবনের কঠিন সময় সাবলীলভাবে পার করতে প্রস্তুত করে। জীবনও তো এমন ভালো, খারাপ, কঠিন ও সহজ বৈচিত্র্যে স্বাভাবিক। নতুন করে পাহাড়সমান আশা বুকে নিয়ে পাহাড় থেকে ফেরা যায়।

তাঁবুর ভেতর থেকে বাইরে এরকমই দেখা যাচ্ছিল

এই প্রথমবার রাতে ট্রেকিংয়ে যাচ্ছি। উদ্দেশ্য মাইতা তৈম পাহাড়ে তাঁবু টানিয়ে রাত্রিযাপন। রাতে ট্রেকিংয়ের সুবিধা এই প্রথম বুঝলাম, দূরে কী আছে দেখা যায় না। মনে অহেতুক আশঙ্কা ভর করে না। শুধু টর্চের আলোয় যতটুকু দেখা যায়, ততটুকু হেঁটে যাওয়া। হাঁটতে হাঁটতে একসময় টের পেলাম, বুকের ভেতর থেকে ফেটে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে আমার হৃৎপিণ্ড।

একটু বিশ্রামের জন্য সমতল যে জায়গাটা ঠিক করলাম, টর্চ মেরে দেখি এর নিচেই খাড়া খাদ। অন্য পাশে বিশাল বাঁশবাগান। সেখান থেকে চাঁদের আলো ঠিকরে এসে শৈশবের ‘কাজলা দিদি’কে মনে করিয়ে দিল। দলের কে যেন গলা ছেড়ে গান গেয়ে উঠল, ‘চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়।’ ওই দিন, ওই সময়, ওই জায়গায় এই গানটারই যেন কেবল অভাব ছিল। মুহূর্তটা যেন পূর্ণতা পেল। ভেবে দেখলাম, আসলেই এমন সব রাতে মরে গেলেও খুব একটা আফসোস থাকবে না জীবন নিয়ে।

Also Read: ভারতের এসব সমুদ্রসৈকতে গিয়ে কেন কক্সবাজারের জন্য মন খারাপ হলো

দুই ঘণ্টার বেশি সময় ট্রেকিং করে ক্লান্ত হৃৎপিণ্ডটাকে আগলে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে মনে হলো, এটাই তো সেই জায়গা, যেখানে দুনিয়ার সব শান্তি পুঞ্জীভূত!


ব্যাগট্যাগ সব ফেলে এক পাহাড়ি মাচাংয়ে চিত হয়ে শুয়ে বুকভরে শ্বাস নিচ্ছিলাম। আকাশে এত তারা। শেষ কবে এমন আকাশভর্তি তারা দেখেছি? শহরে তারা দেখতে পাই আমরা? মনে হচ্ছিল, আমার ওপরে এটি আকাশ নয়, বিশাল এক শিউলিগাছ। আর তারাগুলো যেন শিউলি ফুল। যেন এক্ষুণি ভোরের শিউলির মতো টুপটাপ আমার ওপর পরতে শুরু করবে।

পাহাড়ে ট্রেকিংয়ের মজা হলো পাহাড়সমান আশা বুকে নিয়ে পাহাড় থেকে ফেরা যায়, নতুন করে শুরু করা যায়

সুন্দর এই স্বপ্নের জগৎ থেকে কেউ একজন আমাকে আচমকা ডেকে তুলল। তারপর আমরা রাতের খাবারের ব্যবস্থায় লেগে গেলাম। নিচ থেকে সঙ্গে নিয়ে আসা মুরগির বারবিকিউ হলো, গান বাজনা হলো।

সবশেষে আমরা পরিষ্কারের কাজে লেগে পড়লাম। আমাদের যা কিছু নোংরা, কাল এখান থেকে সব আমাদেরই নিয়ে যেতে হবে। আমাদের একটি ‘অভ্যাস’ হলো, ভ্রমণে গিয়ে সে জায়গাটা আমরা নোংরা করে আসি। প্রকৃতির কাছাকাছি মনকে পরিষ্কার করতে গিয়ে প্রকৃতিকে অপরিষ্কার করে আসি। কী ভয়ানক!

প্রকৃতি যে সব ফিরিয়ে দেয়। তাই প্রকৃতিকেও আমাদের সুন্দর কিছু দিয়ে আসা উচিত। প্রকৃতি ও জীবন তবেই আমাদের সুন্দর কিছু ফেরত দেবে।

Also Read: কেউ মেক্সিকো, কেউ ভুটান, কেউ শহরে–জঙ্গলে–সমুদ্রে