Thank you for trying Sticky AMP!!

১৮ বছর ধরে বছরে অন্তত একবার বাংলা চ্যানেল অতিক্রম করছেন লিপটন, কেন জানেন?

শাহপরীর দ্বীপ থেকে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত নৌপথটির নাম এখন ‘বাংলা চ্যানেল’। দূরত্ব ১৬ দশমিক ১ কিলোমিটার। ২০০৬ সালে দুই সহসাঁতারুর সঙ্গে এই পথটা প্রথম সাঁতরে পার হন লিপটন সরকার। এর পর থেকে প্রতিবছর অন্তত একবার করে পাড়ি দিয়ে যাচ্ছেন। গত ২৮ ডিসেম্বর ২০তম বারের মতো পাড়ি দিলেন বাংলা চ্যানেল। নিজে সাঁতার কাটার পাশাপাশি একঝাঁক তরুণকেও লোনাজলে নামতে উদ্বুদ্ধ করেছে লিপটনের প্রতিষ্ঠান ‘ষড়জ অ্যাডভেঞ্চার’। তাঁর জবানিতে বাংলা চ্যানেলে সাঁতার কাটার গল্প শোনালেন সজীব মিয়া

১৮ বছরে ২০ বার বাংলা চ্যানেল অতিক্রম করেছেন লিপটন সরকার

তখন আমি পাহাড়ের প্রেমে মজে আছি। বান্দরবান দিয়ে শুরু করেছিলাম। ধীরে ধীরে পার্বত্য জনপদের আরও গভীরে যেতে থাকি। এমনও মাস গেছে, প্রতি বৃহস্পতিবারই কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। একা একাই বান্দরবান থেকে রুমা, থানচি গেছি। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে একসময় চিম্বুক রেঞ্জের পাহাড়ে চলে যাই। পথে পথে অনেকের সঙ্গে পরিচয়। সীতাকুণ্ডে এমনই এক সফরে সালমান সাঈদের সঙ্গে পরিচয়। বয়সে আমার চেয়ে ছোট সালমানের মাথায় যত অ্যাডভেঞ্চারের পোকা।

সালমানই ২০০৫ সালের একদিন আমাকে নিয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিংপুলে। সেখানে আরেক রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষ ফজলুল কবিরের সঙ্গে পরিচয় হলো। দুজনের মাধ্যমে তারপর অ্যাডভেঞ্চার গুরু কাজী হামিদুল হকের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হলো। তিনি তখন বঙ্গোপসাগরে সাঁতার উপযোগী একটা পথ আবিষ্কার করেছেন। কয়েক বছর ধরে সাগরে একা ঘুরে ঘুরে সেই চ্যানেলটি নিয়ে সার্ভে করেছেন। এখন সাঁতার অভিযান শুরুর পরিকল্পনা করছেন। আমিও সাঁতারু দলে যুক্ত হয়ে গেলাম।

মহা উৎসাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিংপুলে শুরু হলো অনুশীলন। প্রথম দিন পুলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতেই জিব বের হওয়ার দশা! কিন্তু হাল ছাড়ালাম না, সাগরে যে আমাকে নামতেই হবে। এক মাস পর উন্নতিটা নিজেই বুঝলাম এখন। টানা ১১১ পর্যন্ত এমাথা–ওমাথা করতে পারি।

প্রথম সাঁতার

১৪ জানুয়ারি ২০০৬। অথই সাগরের দিকে তাকিয়ে একটু ভয়ই পেয়ে গেলাম। কক্সবাজারের সৈকতে পা ভেজানোর ‘অভিজ্ঞতা’ পুঁজি করে সাগরে সাঁতার কাটতে এসেছি। পরনে সুইমিং স্যুট। হাতে গ্লাভস। স্নরকেলিং মাস্কটা ঠিকঠাকমতো লাগিয়ে নেমে পড়লাম পানিতে। সাঁতারসঙ্গী ফজলুল কবির সাংঘাতিক সাহসী মানুষ। তরতর করে সামনে এগিয়ে গেলেন তিনি। আমি আর সালমান সাঈদ তাঁকে অনুসরণ করছি। সঙ্গে দুটি নৌকা। ছোটটায় খাবারদাবার নিয়ে আমাদের কাছাকাছি থেকে চালাচ্ছেন শাহপরীর দ্বীপের এক জেলে। অভিযানে এসেই তাঁর সঙ্গে পরিচয়। আর ট্রলারটা সামনে সামনে পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ট্রলারে আছেন অভিযানের অন্য কান্ডারিরা।

কাজী হামিদুল হকের সঙ্গে প্রথম বাংলা চ্যানেল অভিযানে অংশগ্রহণকারী দলের সদস্যরা—দুই পাশে বসা ফজলুল কবির (বাঁয়ে) ও লিপটন সরকার, পেছনে দাঁড়ানো (বাঁ থেকে) রফিকুল ইসলাম, কামাল আনোয়ার ও সালমান সাঈদ

Also Read: সব বয়সীদের ব্যায়াম সাঁতার

সাঁতরাই আর পেছনে দেখি। ধীরে ধীরে শাহপরীর দ্বীপ ছোট হতে থাকে। একটা সময় রেখার মতো দেখা গেল, তারপর হঠাৎ যেন কোথায় মিলিয়ে গেল। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। তিনজন একসঙ্গেই সাঁতার কাটছি। সাঁতার শুরুর সময় বলেছিলাম, আমরা কিন্তু দলছুট হব না (আসলে আমিই ভয় পাচ্ছিলাম। সঙ্গে কেউ না থাকলে একা সাঁতার কাটা খুবই কঠিন)! কিন্তু এখন আর ভয় করছে না।

এরই মধ্যে সিনা ভাইয়ের (ফজলুল কবিরের ডাকনাম) পায়ের পেশিতে ক্র্যাম্প (খিঁচুনি) হলো। তাঁকে নৌকায় তুলে নেওয়া হলো। স্নরকেলিং মাস্ক পরা বলে নির্ভার সাঁতার কাটছি। টানা সাঁতার কেটে একটা সময় মাথা তুলে দেখি আশপাশে কোনো নৌকা নেই। ভয় পেয়ে গেলাম। যদি ক্র্যাম্প হয়, যদি ডুবে যাই! ওপরে পানি ছিটিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। পথ দেখানো ট্রলারটা হয়তো দেখেছিল, একটু পরই ছুটে এল। সিনা ভাইকে তুলতে গিয়ে পেছনে পড়ে গিয়েছিল তারা।

সিনা ভাই আবার নেমে পড়েছেন। সালমানও ছুটছেন। পৌনে চার ঘণ্টা পর আবছায়ার মতো সেন্ট মার্টিন দেখতে পেলাম। তারপর দূরে একটা রেখার মতো। আচমকা মনের মধ্যে ভীষণ জোর পেয়ে গেলাম। ৩৭ বছরের শরীরে কী যেন ভর করল, এরপর আমার গতি রোখে কে! যত আগাই, তত দৃশ্যমান হয় সেন্ট মার্টিন। চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। আনন্দে-উত্তেজনায় শুধু মনে হতে থাকে, যে মানুষ সাগরের গলা পানিতেও কোনো দিন যায়নি, সাগরের ওপারে কী আছে জানে না, সেই মানুষটা সাঁতরাচ্ছে।

একটা সময় গিয়ে সেন্ট মার্টিনের বালু ছুঁলাম। পাড়ে উঠেই কাজী হামিদুল হককে কল করলাম।

প্রথম ‘বাংলা চ্যানেল’ সাঁতার অভিযানে অংশগ্রহণকারী তিন সাঁতারুসহ দলের অন্য সদস্যরা

Also Read: প্রথমবার সেন্ট মার্টিনে, তা–ও সাঁতার কেটে

নাম হলো ‘বাংলা চ্যানেল’

কাজী হামিদুল হক আমাদের অভিযান নিয়ে ভীষণ উত্তেজিত। জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করবেন তিনি। তার আগে এই পথের একটা নাম দেওয়া দরকার। ইংলিশ চ্যানেলের কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশের দূরপাল্লার সাঁতার উপযোগী নৌপথটির নাম দিলেন তিনি ‘বাংলা চ্যানেল’। আমাদের মধ্যে সালমান সাঈদ বয়সে সবার ছোট। তখন তাঁর বয়স সবে ১৯। সংবাদ সম্মেলনে সালমানই ‘বাংলা চ্যানেল’ নামটি সবাইকে জানাল।

সংবাদ সম্মেলনের পর আমাদের অভিযানের গল্প সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হলো। স্বাভাবিকভাবেই ২০০৭ সালের আয়োজনে ভালো স্পনসর পাওয়া গেল। কিন্তু জন্ডিসের কারণে আমার অংশগ্রহণই অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। বিলিরুবিন বেড়ে যা-তা অবস্থা। সাঁতারের দুদিন আগে বিলিরুবিন ১.৫ হলো। ডাক্তার বললেন, ‘এখন যেহেতু কমতে শুরু করেছে, কমতে থাকবে। আশার বাণী শুনে আমি চলে গেলাম টেকনাফ। ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুশীলন করে পরদিন মূল সাঁতারে অংশ নিলাম। দ্বিতীয়বারের মতো পাড়ি দিলাম বাংলা চ্যানেল।

আরও দুই বছর আয়োজনের পর ২০১০ সালে একটু দোলাচলে পড়ে গেলাম। তত দিনে ঢাকায় ব্যবসাপাতি গুটিয়ে আমি নেপালে চলে গেছি। সেখানেও ইন্টেরিয়রের কাজই করি। পাশাপাশি নেপালের পর্বতে পর্বতে ঘুরে বেড়াই। আমি ঢাকায় নেই বলে বাংলা চ্যানেলে সাঁতার আয়োজনের কাজটা ভালোভাবে হলো না। কিন্তু আয়োজন বন্ধ থাক, এটা তো হতে পারে না। সিদ্ধান্ত নিলাম মার্চে করব। তত দিনে সালমান সাঈদ পেশাগত কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কোনো অভিযান সফল হওয়ার পর ফজলুল কবিরও ওই ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, নতুন কোনো রোমাঞ্চের সন্ধান করেন। তাই কোনো সাঁতারুও পাওয়া গেল না। একাই সাগরে নামার সিদ্ধান্ত নিলাম। সস্ত্রীক সেই অভিযানে গেলেন কাজী হামিদুল হক।

লিপটন সরকার

মার্চে উত্তাল হতে থাকে সাগর। বায়ুপ্রবাহ পরিবর্তনের কারণে এবার অভিযান সেন্ট মার্টিন থেকে শাহপরীর দ্বীপে শেষ করতে হবে। সেভাবেই পানিতে নামলাম। দুইটা নৌকার একটা সামনে, আরেকটা আমার পেছনে। সেন্ট মার্টিন থেকে তিন ঘণ্টা সাঁতার কেটে শাহপরীর দ্বীপের কাছাকাছি বদর মোকামে আসার পর শুরু হয় উথালপাতাল ঢেউ। এই জায়গায় নৌকা সোজা পথে বাইতে গেলে ঢেউয়ের তোড়ে ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ট্রলার থেকে জানানো হলো, সোজা সাঁতার কেটে যেতে চাইলে আমাকে একা যেতে হবে, ট্রলার একটু ঘুরপথে যাবে।

বাকি আর মাত্র দেড়-দুই কিলোমিটার। আমি একাই সাঁতার কাটতে থাকি। নিঃসঙ্গতা ভর করে। ঢেউ দেখে ভয় পেয়ে যাই। একা পুকুরে নামতেও আমি ভয় পাই। আবার সঙ্গে যদি একটা ছোট বাচ্চাও থাকে, পাড়ি দিতে পারি বাংলা চ্যানেল। ভয়ের মধ্যেই একটা ঢেউ আমাকে অনেক ওপরে তুলে দিল। ঢেউয়ের মাথা ভেঙে গেলে নিচে নেমে নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলাম। মনে হচ্ছিল এবারই বুঝি শেষ, আমি হয়তো আর বেঁচে ফিরতে পারব না। তারপরও সাঁতার কেটে ঢেউয়ের উথালপাতাল জায়গাটা ঠিকই পার হলাম। একসময় শাহপরীর দ্বীপে উঠে পড়লাম।

শাহপরীর দ্বীপ থেকে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত নৌপথটির নাম এখন ‘বাংলা চ্যানেল’

‘বাংলা চ্যানেল’ পরিচিত পাক

প্রথম অভিযানের সময়ই মনে মনে সংকল্প করেছিলাম—যত দিন সুস্থ থাকব, বছরে অন্তত একবার হলেও বাংলা চ্যানেলে সাঁতার কাটব। সেই সংকল্পে আজও অটুট আছি। বাংলা চ্যানেলে ১৮তম সাঁতার আয়োজন ছিল গত ডিসেম্বর। মাঝে দুই বছর দুবার করে সাঁতার কেটেছি বলে আমার অবশ্য ২০ বার হলো। নিজে সাঁতার কাটার পাশাপাশি আমার প্রতিষ্ঠান ষড়জ অ্যাডভেঞ্চার থেকে প্রতিবছর সাঁতারের আয়োজনও করছি। অনেক তরুণ এখন সাঁতারে আগ্রহী হয়েছেন। ৮০ জন সাঁতারু নিয়েও আমরা সাগরে নেমেছি। তরুণদের দলে ভেড়ানোর কাজটা অবশ্য সহজ করেছে আয়রনম্যান খ্যাত সামছুজ্জামান আরাফাত।

আমাদের কাছে ইংলিশ চ্যানেল তো অনেক দূরের ব্যাপার। সেই অভিযানে যেতে অনেক অর্থেরও প্রয়োজন। নদীমাতৃক দেশের মানুষ হয়েও অলিম্পিকে আমরা সাঁতারে ভালো করতে পারি না। আমরা তাই সাঁতারকে ছড়িয়ে দিতে, তরুণদের উৎসাহিত করতে চাই। বিদেশি যাঁরা বাংলা চ্যানেলে সাঁতার কেটেছেন, তাঁরাও এই পথের খুব প্রশংসা করেছেন। এই চ্যানেল খুবই নিরাপদ, কোনো ভয়ংকর সামুদ্রিক প্রাণীর আনাগোনা নেই। আমরা এই বিষয়টি বিদেশিদের কাছেও প্রচার করতে চাই।

২০২১ সালে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিতে সাঁতারে অংশ নেন ৮০ জন সাঁতারু

এখন আমার বয়স ৫৪ বছর। তিন-চার বছর আগে সাগরের মাঝপথে গেলে মনে হতো হয়তো আর সাঁতার কাটতে পারব না। কিন্তু সাঁতার শেষ হলে উদ্যম ফিরে পেতাম। তবে সর্বশেষ আয়োজনে খুব স্বচ্ছন্দে সাঁতার কাটতে পেরেছি। একটা কারণ হতে পারে, ঢাকা ছেড়ে আমি এখন গ্রামে ফিরে গেছি। গ্রামে খামার দিয়েছি। নিজে সব কাজ করি। নিয়মিত পরিশ্রম করায় শারীরিক সক্ষমতা ফিরে পেয়েছি। এই সুস্থতা নিয়েই আরও পথ এগিয়ে যেতে চাই।