Thank you for trying Sticky AMP!!

ঢাকা থেকে এ ঘাট–ও ঘাট ঘুরে এই লঞ্চই পৌঁছে যায় কলকাতায়

লঞ্চে কলকাতায় যেতে ভিসায় কোন পোর্ট উল্লেখ করতে হয়

নদীপথে ঢাকা থেকে কলকাতা যাওয়া যাবে। ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখেই মনে হলো, দুই দেশের সুন্দরবন দেখার এই তো দারুণ সুযোগ! লঞ্চ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান এমকে শিপিং লাইনসের দেওয়া নম্বরে কথা বললাম। বিস্তারিত তথ্য নিলাম। জানাল, ২৭ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় তাদের পরবর্তী যাত্রা। দুই রাত-তিন দিনের দীর্ঘ যাত্রার কথা শুনে আমার স্ত্রী-কন্যার আগ্রহ উবে গেল। কী আর করা, সিঙ্গেল কেবিনের টিকিট কনফার্ম করলাম। রিভারভিউ টিকিটের দাম পড়ল ১২ হাজার টাকা। এটা গত বছরের কথা।

পোস্তগোলা ব্রিজ পেরিয়ে বাঁয়ে হাসনাবাদ কার্নিভ্যাল ক্রুজের ফেরিঘাট। যাত্রার নির্দিষ্ট দিন সেখানে পৌঁছে গেলাম ঠিক ৯টায়। টিকিট দেখিয়ে বরাদ্দ করা ৩০৬ নম্বর কেবিনের চাবি বুঝে নিলাম। তিনতলায় কেবিন। লাগেজ রেখে পুরো লঞ্চ ঘুরে দেখলাম। চারতলা লঞ্চে সিঙ্গেল, ডাবল, প্রিমিয়াম ও ভিআইপি মিলিয়ে কেবিন ও বাঙ্কার বেড রয়েছে, যার বেশির ভাগই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। পূর্ণ সক্ষমতায় প্রায় সাড়ে ৩০০ যাত্রীর খাবারের জন্য দুটি রেস্তোরাঁ ও নাশতার জন্য একটি ক্যানটিন রয়েছে। আমি ছিলাম ঢাকা-কলকাতা রুটে লঞ্চটির দ্বিতীয় যাত্রার যাত্রী। তাই যাত্রীর সংখ্যাও ছিল কম। মাত্র ২৫ জন যাত্রী আর ৪০ জন স্টাফ নিয়ে ঠিক ১০টায় ভেঁপু বাজিয়ে নোঙর তোলে এমভি রাজারহাট-সি।

Also Read: ঢাকা থেকে ট্রেনে দার্জিলিং-সিকিম যাওয়ার উপায়

এই লঞ্চ–যাত্রায় সুন্দরবনের অপরূপ প্রকৃতি দেখার সুযোগ মেলে

তিনতলায় রেস্তোরাঁ। ১২০ টাকায় সকালের নাশতা ডিম–খিচুড়ি। খেয়েদেয়ে ডিসেম্বরের রোদ উপভোগ করতে রেস্তোরাঁর সামনের ডেকে চেয়ারে বসি। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে ধলেশ্বরী নদীতে প্রবেশ করে লঞ্চ। ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে নদীপাড়ের দৃশ্য। মেঘনা নদীতে যা মুগ্ধতায় রূপ নিল। এই মুগ্ধতা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করে না। তাই দুপুরের খাবারটাও সেখানেই খেলাম। দেশি মুরগি, সবজি, ডাল আর ভাত খেয়ে মনটা চাঙা হয়ে গেল। দুপুর বা রাতে প্রতিবারে খাবারের খরচ ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। ততক্ষণে চাঁদপুর পার হয়েছে লঞ্চ।

ডেকেই বসে ছিলাম। আসলে প্রকৃতির এই সৌন্দর্য ফেলে কেবিনে কে যায়। সন্ধ্যা নেমে এল। নদীর জলে অপার্থিব সূর্যাস্ত দেখলাম। সূর্য ডোবার পর কীর্তনখোলা নদীতে ঢুকে পড়ল। বরিশাল লঞ্চঘাট অতিক্রম করতে করতে রাত ৯টা বেজে গেল। পূর্ণিমার জ্যোৎস্না উছলে পড়ছে। ডেকে বসে থেকে আর মন ভরছে না। ফাঁকা লঞ্চ কোলাহলহীন। ছাদে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে করতেই একটি ঘাটে লঞ্চ থামল। এটা বিষখালী নদীতে নলছিটি ঘাট। খানিক বিরতি নিল। রাতে চিংড়ি আর পোয়া মাছ দিয়ে ভাত খেলাম।

Also Read: ভিসা ছাড়াই যে ৪২ দেশে যেতে পারবেন বাংলাদেশিরা

লঞ্চে রয়েছে বিভিন্ন মানের কেবিন

রাতে কেবিনে এসে ঘুমিয়ে ছিলাম। ভোর হলো রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সামনে। সূর্যের আলো ফোটার সময় পশুর নদ থেকে সুন্দরবনের দেখা পেলাম। মনে হচ্ছিল, উদীয়মান সূর্যের রোদের তাপে নদীর পানি থেকে ধোঁয়া উঠছে। বনের খালেও দেখা গেল একই দৃশ্য। মাঝেমধ্যে ঘন কুয়াশা চারদিকের সবকিছু অদৃশ্য করে দিচ্ছে, আবার আচমকা পরিষ্কার চারপাশ। পৌষের হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় আঙুল জমে যাচ্ছিল। কিন্তু প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য ধরে রাখার চেষ্টায় ক্যামেরার বাটন চলছিল অবিরাম। যাত্রাপথে কয়েকবার ইরাবতী ডলফিনের ভেসে ওঠা দেখলেও ঠিকমতো লেন্সে নিতে পারিনি। শীতের কুয়াশামাখা নরম আলোয় আরও চার ঘণ্টা সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করে সকাল ১০টায় আমরা ইমিগ্রেশনের জন্য খুলনার কয়রার আংটিহারা নৌ পুলিশ ফাঁড়ির সামনে থামি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজন পুলিশ কর্মকর্তা জাহাজে উঠে এলেন। লঞ্চে যাত্রী কম। মাত্র আধঘণ্টায় আমাদের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হলো। এরপর আবার চলতে শুরু করল লঞ্চ। ঘণ্টাখানেক চলার পর বাংলাদেশের সীমানায় সর্বশেষ বিজিবি ক্যাম্পের সামনে থামে লঞ্চ। বিজিবি সদস্যরা জাহাজে উঠে নিয়মিত তল্লাশি করেন। তারপর আবার চলতে থাকা। বিকেলের দিকে ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ দেখে বুঝলাম, ভারতীয় জলসীমায় প্রবেশ করেছি। আরও কিছুক্ষণ পর ইন্ডিয়ান কাস্টমসের বোট এসে আমাদের লঞ্চের পাশে চলতে থাকে। লঞ্চ থামালে তাঁরা উঠে আসেন চেক করতে। ডেকে বসে যাত্রী ও স্টাফদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখেন। তাঁরা কার্যক্রম সম্পন্ন করে চলে যেতেই সন্ধ্যা নামে।

Also Read: ই-পাসপোর্ট থেকে স্বামী বা স্ত্রীর নাম বাদ পড়ল, আর কী কী সংশোধন এল

লঞ্চের একটি কেবিন

রাতে ঘুমানোর আগে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের খাল আর ছোট ছোট নদীতে চলেছে লঞ্চ। আশপাশের দৃশ্য আমাদের দেশের মতোই। আগের রাতে জেগেছি বলে খেয়েদেয়ে দ্রুত ঘুমাতে চলে গেলাম।

ভোরের আলো ফোটার সময় ঘুম ভাঙে। বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারি না কোথায় আছি। ভারতীয় সিম সঙ্গেই ছিল। ইন্টারনেট–সংযোগ পেয়ে গুগল করে দেখি, ‘নামখানা’ নামক জায়গার কাছে প্রশস্ত হুগলি নদীতে প্রবেশ করেছি। তারপর ডায়মন্ড হারবার ও রায়চক হয়ে কলকাতা শহরতলির রূপ দেখতে দেখতে দুপুরে বিদ্যাসাগর ব্রিজের কাছে কলকাতা পুলিশ জেটিতে নামি। নৌপথের যাত্রীদের জন্য এখানে নতুন ইমিগ্রেশন ডেস্ক করা হয়েছে। ১০ মিনিটেই পাসপোর্টে সিল মেরে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হলো। আরও মিনিট দশেক হেঁটে বন্দর কর্তৃপক্ষের চত্বর পেরিয়ে বেরিয়ে পড়ি। উবার করে আধা ঘণ্টার মধ্যে চলে আসি কলকাতা নিউমার্কেট এলাকায়।

ঢাকা থেকে কলকাতা পর্যন্ত লঞ্চযাত্রার নির্ধারিত সময় ৪৮ ঘণ্টা। আমরা কলকাতায় পৌঁছাই ৫৩ ঘণ্টায়। বিলম্বের মূল কারণ, শুকনা মৌসুম ও জোয়ার–ভাটা। তবে সময় যতই বেশি লাগুক, দুই বাংলার সুন্দরবন, জেলেদের মাছধরা আর নদীকেন্দ্রিক গ্রাম্য জীবনযাপনের দৃশ্য উপভোগের এমন সুযোগ আর কোথায় পাব।

এই সুযোগে বলে রাখা দরকার, নৌপথে ভ্রমণের জন্য আলাদা করে ভারতীয় ভিসার দরকার হয় না। যেকোনো পোর্ট উল্লেখ থাকলেই নদীপথে এমভি রাজারহাট–সি লঞ্চে কলকাতায় যাওয়া যায়। আর ভাড়া ছাড়া চা–কফিসহ খাবারের খরচ হাজার দুয়েক টাকার মধ্যে হয়ে যায়।