Thank you for trying Sticky AMP!!

মেঘের রাজ্য মেরাই থং

বাংলাদেশের অনেক জায়গায়ই তাঁবু খাটিয়ে রাত পার করেছি, সেই রাতগুলোতে আকাশ ভরা জ্যোৎস্না যেমন ছিল, তেমনি ছিল গা ছমছম করা শেয়ালের হুংকারও। রাতগুলোতে নিকষ আঁধার ভেদ করা অমাবস্যা যেমন ছিল, তেমনি ছিল কলজে পানি করা বুনো হাতির দৌড়ও। গনগনে গরম যেমন ছিল, ঠিক তেমনি ছিল কনকনে ঠান্ডার নির্মম দাপটও...

একটা রাত আর কত রোমাঞ্চই বা দিতে পারে!!!

আমার সব ধারণাকে স্রেফ উড়িয়ে দিল আলীকদম ভ্রমণের এক রাত।

গিয়েছিলাম মেঘ-পাহাড়ের দেশে, আমরা গিয়েছিলাম জলসবুজের বাদলের দেশে।

আমরা হেঁটে ছিলাম হাঁটুপানি, কোমরপানি, গলাপানি পার হয়ে মাথার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পানির মধ্য দিয়ে। বাতাসের হিল্লোল থেকে জলের কল্লোল—কোনোটাই বাদ পড়েনি এই ভ্রমণে। ঢিপঢিপে বুক নিয়ে অন্ধকার সুড়ঙ্গ যেমন হাতড়েছি, তেমনি টিপটিপে বুক নিয়ে ঘন অন্ধকার রাতে টপকেছি মেঘের ওপরের পাহাড়কেও।

আর সকাল দেখেছি দুধসাদা মেঘের ভেতরে জেগে। পায়ের পাতায় মেঘের ছোঁয়া, চোখের পাতায় মেঘলা ধোঁয়া, আর ছাতা মাথায় ভেজা ঘাসে শোয়া—সবকিছু বারবার অপার্থিব সুখের জানানই যেন দিচ্ছিল।

পর্যটনের দিক থেকে বিবেচনা করলে বান্দরবানের সবচেয়ে অবহেলিত উপজেলা আলীকদম। কেউ গোনাতেই ধরে না। এক সুড়ঙ্গ ছাড়া সেখানে তৃষ্ণা মেটানোর মতন আর যে কিছুই নেই!

কয়েক মাস ধরে লিমন বড়ুয়া বলছেন, আলীকদমে এক পাহাড় আছে, নাম তার ‘মেরাইথং জাদি’। বড় কঠিন সে পাহাড়ের রাস্তা, একটানা দুই-আড়াই ঘণ্টা উঠতে হয়। সেখান থেকে নাকি হাত বাড়ালেই চাঁদ ছোঁয়া যায়। জ্যোৎস্নার আলোয় দূরের পাহাড় গোনা যায়—লিলুয়া বাতাসে প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও কম্বল গায়ে ঘুরতে হয়!

আমরাও কম্বল নিয়ে গিয়েছিলাম, বৃষ্টি হবে মনে করে রেইনকোট, ছাতা, পলিথিন কী নিইনি সঙ্গে! হঠাৎ করেই শুনি সাগরে নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে, ৪ নম্বর বিপৎসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। এদিকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ ফুট ওপরের পাহাড় চূড়াতে আমাদের মাথার ওপরে দুনিয়ার সব ঠান্ডা নিয়ে কনকনে এক চাঁদ উঠছে, পূর্ণিমার আলো থইথই করছে কালচে পাহাড়ের কিনারা বেয়ে, সে আলোয় চলছে মেঘের লুকোচুরি! বৈরী আবহাওয়ার কোনো চিহ্নই নেই আমাদের আশপাশে।

এরই মধ্যে পাহাড়ের রাত তার সৌন্দর্য নিয়ে চলে এল আমাদের দেখতে। মুহূর্তেই আমাদের তাঁবু এলাকা মেঘে হারিয়ে গেল, এক তাঁবু থেকে আরেক তাঁবু দেখা যায় না। এ পাহাড়-ও পাহাড়, দূরের পাহাড় থেকে মেঘের দল ছুটে এল। শরীরে ততক্ষণে শীত জেঁকে বসেছে, জগতের কোনো কিছুই বেশি হলে ভালো হয় না। আমাদের বেলায়ও তা-ই হলো—মেঘে মেঘে অনেক ভারী হয়ে গেল কালচে মেঘের দল। ওগুলো আর নড়তে পারে না—অনেক পরিশ্রম করেছে ও পাহাড় থেকে এ পাহাড়ে আসতে, এখন ঘেমে-নেয়ে একাকার, টুপটুপ করে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে আমাদের সদ্য খাটানো বিছানো তাঁবুতে।

 আমাদের ‘বেদিশা ট্যুরিস্টের দল...’ ততক্ষণে বুঝতে শুরু করেছে ভালোবাসার অত্যাচার। হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে যে যার তাঁবুতে ঢুকেই চেইন লাগিয়ে চাঁদের গন্ধ নিতে চাইল।

রাত তখন সাড়ে তিনটা। হঠাৎ করে সব জল্পনা-কল্পনা ছাপিয়ে হাজারটা ক্রুদ্ধ হাতির মতন বুনো আক্রোশ নিয়ে আমাদের ১২টা তাঁবুর ওপর আছড়ে পড়ল সাগরের ওই নিম্নচাপটা। আমাদের পাহাড়ের অ্যাডভেঞ্চার মুহূর্তেই পরিণত হলো ‘ম্যাডভেঞ্চারে’!

লন্ডভন্ড হয়ে গেল আমাদের সাজানো সংসার, কয়েকটা তাঁবুর লোহার পিন খুলে উড়ে গেল প্রায় ১ হাজার ৮০০ ফুট নিচের কোনো টিনের চালে—তাঁবুর ভেতরে যারা ছিল, কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা নিজেদের আবিষ্কার করল কোমরপানির ভেতরে, প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে তাঁবু উড়ে যায় যায় দশা, যে যেভাবে পারছে তাঁবু ধরে বসে আছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না—মটমট করে তাঁবুর লোহার শিক ভাঙা শুরু হলো। সেই ভয়ংকর বিজলি রাতে আমাদের ২৮ জন ছেলেমেয়ে অসহায়ের মতন বের হয়ে গেল তাঁবু থেকে, কেউ কাউকে দেখছে না মেঘের জন্য—আশপাশে সব ধবধবে সাদা, থেকে থেকে সেখানে চমকাচ্ছে বিজলির আলো!!

ছুটতে শুরু করা সবার গন্তব্য কিছুটা দূরের জুমখেতের ভেতরে ছোট্ট একটা শণের ঘর। সেই ঘূর্ণিঝড়ের রাতে বিজলির দেখানো রাস্তায় অচেনা ধানখেতের ভেতর দিয়ে জীবন বাঁচানো দৌড়ের মধ্যে যে অ্যাডভেঞ্চার লুকিয়ে আছে, সেটা হাজার চেষ্টায়ও আর কোথাও কোনো দিন পাওয়া যাবে না।

সেই কুঁড়েঘরে ভেজা কাপড় নিয়ে কনকনে ঠান্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবার একটাই চাওয়া ছিল, কখন ফুটবে ভোরের আলো, কখন থামবে এই মাতাল ঘূর্ণিঝড়। কারও কাছেই ব্যাগ নেই, সব ব্যাগ পানি ভর্তি তাঁবুর মাঝে ফেলে রেখে এসেছে।

অবশেষে পুব আকাশ আলো করে এল সেই মহা কাঙ্ক্ষিত সকাল, ভোরের আলো ফুটতেই ঝড় তার সব ছানাপোনাকে নিয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেল দূরের এক পাহাড়ের আড়ালে! এ যেন এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য! পায়ের নিচ থেকে ঘাসের গা বেয়ে বেয়ে উঠছে সাদা সাদা ফেনিল মেঘ, তুলোর মতন লতানো সাদাটে আঁশ ধরে ধরে সে সামনে এগোচ্ছে, মুহূর্তেই আমাদের ক্যাম্পসাইট ঢেকে দিল, ঢেকে দিল রাতের সব লন্ডভন্ড করা স্মৃতি। আমরা ছাতা নিয়ে বের হলাম পায়ের তলার মেঘ দেখার জন্য। একবার মেঘ আমাদের সবাইকে ভিজিয়ে দেয়, আরেকবার আমরা সবাই মেঘকে ধাওয়া করে চলে যাই একেবারে পাহাড়ের শেষ কিনারা পর্যন্ত!

এ এক অদ্ভুত মন ভালো করা খেলা...এ খেলায় ক্লান্তি নেই।

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে চকরিয়া বাসস্ট্যান্ডে নেমে চান্দের গাড়ি দিয়ে আলীকদম যাওয়ার পথে আবাসিকে নেমে যাবেন, ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৬০ টাকা করে। আবাসিকে নেমে ডান পাশের রাস্তাটা ধরে প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন আলীকদমের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় মেরাই থংয়ে। সেখানে খাবার ও পানির কোনো ব্যবস্থা নেই, কাজেই শুকনো খাবার ও পানি সমতল থেকেই নিয়ে যেতে হবে।