Thank you for trying Sticky AMP!!

শিল্পীর চোখে পুরান ঢাকার ছাদ কালচার

কোথায় হারিয়ে গেল সেই ছাদ–আড্ডা

পঞ্চাশ দশক থেকে শুরু করে নব্বইয়ের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রায় সব শহরেই ছাদ–সামাজিকতা ছিল জমজমাট। এই ছাদ-সামাজিকতার একটি বড় অংশজুড়ে থাকতেন পরিবারের নারী, শিশু ও মুরব্বিরা। সোনার খাঁচায় পোরা সেই সব দিনে ফিরে গেলেন স্থপতি সাজিদ বিন দোজা

বাংলায় বসতবাটির দুটি স্থান সব সময় প্রাণবন্ত থাকত, একটি উঠান আর অন্যটি ছাদ। উঠান অনেক আগেই উধাও হয়েছে আর ছাদ থাকলেও সেই সামাজিকতা আর নেই। তার জায়গা দখল করেছে সমিতি, কো–অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশান বা কিটি পার্টি।

অথচ ঢাকার ছাদগুলো একসময় নানা কর্মকাণ্ডে মুখর থাকত। পুরোনো শহরে গেলে আজও তার কিছু ছিটেফোঁটা নমুনা আমরা পাই। খোলা ছাদ, সুপরিসর বারান্দা—এগুলো ছিল পুরোনো শহরের অলংকার। শহরগুলোর বুননপদ্ধতি ছিল নিবিড়, ভবনের সীমানা বেশ খানিকটা ভাগাভাগি করে নিতেন বাসিন্দারা।

পুরোনো শহরকলার একটা রীতি হলো ঘন সন্নিবেশিত বসত। পাখির চোখে পুরোনো শহরকে দেখলে মনে হতো, বিভিন্ন তলসমৃদ্ধ ছাদের কোলাজ। এসবই আজ প্রায় বিলীন। খুবই প্রসিদ্ধ কিছু এলাকায় শুধু টিকে আছে। স্থাপত্যের এই সাবলীল মেজাজই ছাদ–সামাজিকতাকে প্রভাবিত করেছে। আর পুরান শহরের এসব ছাদকে ঘিরেই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে গড়ে উঠেছিল ছাদ–সামাজিকতার ছোট ছোট কত গল্প। 

জলবায়ু ও আবহাওয়ারও প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। শীতে ছাদ থাকত জমজমাট। শীতের রোদে গা গরম করতে ছাদের বিকল্প তখন আর কীই–বা ছিল। তাই সকাল থেকেই সরগরম থাকত ছাদ। পরিবারের সবাই মিলে শীতের সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত উচ্ছ্বাস, আনন্দ, দুঃখ ও কষ্ট ভাগাভাগি করা ছিল পুরো মহল্লার ছাদ–সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত ধুন।

সকালের নাশতার সঙ্গে পিঠাপুলি খাওয়া আর অন্য ছাদের বাসিন্দাদের সঙ্গে ভাগ–বাঁটোয়ারা করে নেওয়া ছিল আতিথেয়তারই সহজাত অংশ। ছাদে বসেই প্রতিবেশী ছাদের বাসিন্দার সঙ্গে খুনসুটি আর গল্প হতো শীতের শেষ বিকেল পর্যন্ত। শিশু–কিশোরেরাও ছাদ–সামাজিকতার অংশ ছিল। স্কুলের শীতকালীন ছুটিতে শিশু–কিশোরদের দুরন্তপনার একটা বড় অংশের সাক্ষী হতো এই ছাদ। আচার খাওয়া, ক্যারম–লুডু খেলা, ভিউকার্ড লেনদেন—সবই চলত ছাদে। কখনো কখনো আবার দোস্তানা এমন পর্যায়ে পৌঁছাত যে ছাদ টপকে অন্য ছাদে গিয়েও চলত গল্প, আড্ডা।

মহল্লার গৃহিণীরা হেঁশেল আর ঘরকন্নায় সব দিক সামলে ছাদে এসে বসতেন। অলস দুপুরে ছাদে বসে মা–খালাদের কেশচর্চা অনেকেরই হয়তো মনে আছে। ডালের বড়ি শুকানো, আচার তৈরির পদ্ধতি, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার অবস্থা, এলাকার কোথায় নতুন বাসিন্দা এল, কেমন তাদের চালচালন—ছাদ–সংস্কৃতির আখ্যানে সবই থাকত। এ ছাদেই সংসার পাতত শিশুকন্যাদের পুতুলেরা।

এ ছাদকে ঘিরেই বিকশিত হয়েছে কবুতর পোষার সংস্কৃতি। কবুতরের ডিগবাজি আর হাততালিতেও মুখর হয়ে উঠত ছাদ। কাছে কিংবা দূরে থেকেও কয়েকটি ছাদ মিলে জমে উঠত কবুতরের খেলা। তাদের জন্য বাঁশের ডগাতে দেখা যেত ত্রিকোণ মাচা। এর সঙ্গে ছাদে শোভা পেত অ্যালুমিনিয়ামের অ্যানটেনা। টেলিভিশন ঠিকঠাক দেখার জন্য সেই অ্যানটেনা নিয়েও কত কাণ্ড। সেই অ্যানটেনা আজ অতীত। আজকের ছাদে ঠাঁই নিয়েছে স্যাটেলাইটের ছোট গোল থালা।

এক সময় বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত শহরে বিনোদনের অন্যতম আসর বসত ভবনের ছাদে

গ্রীষ্মে দিনমান প্রখর তাপে ভাজা ভাজা হয়ে সন্ধ্যায় সবাই ছাদে এসে ঠাঁই নিত। এক বা একাধিক খাটলার ব্যবস্থা করা হতো। সন্ধ্যার পর থেকে নৈশভোজ অবধি সময়টা হারিকেনের আলোয় ছিমছাম ছাদবিছানাতেই কাটত। কখনো কখনো রাতের ঘুমটাও এখানেই হতো। নতুন দিনের রোদের ছটায় ভাঙত সেই ঘুম। বিশেষ করে রাজশাহীর পুরোনো শহরে ছাদে খাটিয়ার ব্যবহার দেখা যায়। লোডশেডিংয়ে সেই সময় ছাদেই শান্তির আস্তানা খুঁজে পেত বাসিন্দারা। হারিকেন অথবা কুপির হলুদ আলোতে ছাদে বসে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভূতের গল্পের শিহরণ ভাগাভাগির সাক্ষী আমিও।

সেই সময়ে লোডশেডিং মানে যেন চাঁদ হাতে পাওয়া! কুপির আলোতে খানিকক্ষণ পড়াশোনা করার পর দৌড়ে ছাদে গিয়ে বাকি বন্ধুদের ডেকে সমাগম করা একটি বিশেষ কাজ ছিল। কারণ, প্রতিটি বসতের ছাদ তখন দেড় থেকে দোতলা অথবা বিশেষ ক্ষেত্রে তিনতলা। ছাদ–বারান্দাগুলো অনেক কাছে থাকার কারণে চাইলেই এক ছাদ টপকে পাশের বাড়ির ছাদে চলে যাওয়া যেত। ছাদের সন্নিবেশনগুলোও যেন নিজের ছাদ থেকে পাশের বাড়ির ছাদে যাওয়া–আসাটাকে প্রশ্রয় দিত।

চৈত্রসংক্রান্তির ঘুড়ি ওড়ানো পুরোনো শহরের আবহমান রূপ। বছরের বিশেষ দিনে ছাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আজও অনেকেই ঘুড়ি ওড়ায়, মাঞ্জা কাটে। কিন্তু এ সময়ের ছাদে সেই আবেগ–উচ্ছ্বাস কি থাকে? যেখানে একটি বাড়ি ৪ তলা তো আরেকটি ১০ তলা।

Also Read: জমবে সাকরাইন 'মাঞ্জা' দেওয়া ঘুড়িতে

আজ আমরা পুরান ঢাকায় ঘুড়ি ওড়ানোর নামে যা দেখি, সেটা অতিরঞ্জিত। লেজার রশ্মির ছড়াছড়ি, বলিউডের বুলি, ডিজে পার্টি দখল করেছে ছাদের সেই ঘুড়ি ঐতিহ্য।

বাগানবিলাসী গৃহিণীরা ছাদে রীতিমতো প্রতিযোগিতা করতেন। কে কার চেয়ে আগে কোন ফুলটি ফোটাবেন, তা নিয়েই কেটে যেত বেলা। আজও ছাদবাগান আছে, কিন্তু যূথবদ্ধতা কই। বিকেলবেলা ছাদের কার্নিশে লুকিয়ে গল্পের বই পড়া, লুকিয়ে চিঠি চালাচালি, কাপড় শুকানোর অসিলা করে ও বাড়ির ছাদে কাঙ্ক্ষিত কোনো মুখের দেখা পাওয়া—সবটাই তো অদ্ভুত ভালো লাগায় গ্রাস করে নিত একসময়।

একসময় বাঙালির ছাদ গৃহস্থালির সামাজিকতা তার নিজের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। নগরায়ণের প্রভাবে আজ তা নাই হতে বসেছে। তারপরও বাংলাদেশের বেশ কিছু মফস্‌সল শহরে আজও ছাদ-সামাজিকতা বিদ্যমান। এই সামাজিকতায় তারা বিশ্বাসী।

বাঙালির এই ছাদ–সংস্কৃতি চাইলে বেশ জোরেশোরে ফিরিয়ে আনা যায়। দরকার শুধু আমার আর আপনার ইচ্ছা। তার আগে আমাদের কাজ হবে প্রতিবেশীর সঙ্গে সাবলীল হওয়া, বিপদে–আপদে একজন আরেকজনকে সাহায্য করা, বিশ্বাস স্থাপন করা। কারণ, আমরা তো নিজেই জানি না আমার বাসার সামনের দরজায় কোন প্রতিবেশী থাকেন। তাঁর সঙ্গে কি আমি মাসে একবারও কুশল বিনিময় করি? প্রতিবেশীর সঙ্গে হৃদ্যতার মাধ্যমেই তো ফিরে আসবে ছাদ–আড্ডা।

লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, স্থাপত্য অনুষদ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ঢাকা