তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৯২স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন।এম এ মান্নান, বীর বিক্রমকমলগঞ্জের যুদ্ধে তিনি গুরুতর আহত হন১৯৭১ সালের আগস্টের মাঝামাঝি এক দিন। নিয়মিত ও গণযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গড়া মুক্তিবাহিনীর একটি দল চিলমারীর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মূল অবস্থানে আক্রমণ করে। এম এ মান্নান ছিলেন একটি দলে। তিনি নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য।ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরে চিলমারী। কুড়িগ্রাম জেলার অন্তর্গত উপজেলা। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩২ বালুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি ও তাদের সহযোগী এক কোম্পানি ইপিসিএএফ (ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স), দুই কোম্পানি রাজাকার ও দুই প্লাটুন পুলিশ মোতায়েন ছিল। এদের মূল অবস্থান ছিল রেলস্টেশন, হাইস্কুল ও ওয়াপদা অফিসে।তখন মুক্তিবাহিনীর কাছে অস্ত্রশস্ত্র ছিল খুবই কম। সীমিত অস্ত্রশস্ত্র নিয়েই তাঁরা সেখানে আক্রমণ করেন। এ যুদ্ধের আগে ভারতীয় সেনাবাহিনী তাঁদের বেশ কটি মেশিনগান, লাইট মেশিনগানসহ অন্যান্য কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়েছিল। কিন্তু সেদিন যুদ্ধক্ষেত্রে এর বেশির ভাগ অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে তাঁরা কিছুটা বিপদেই পড়েন। রেলস্টেশনে পাকিস্তানি সেনাদের মেশিনগান পজিশন বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। সেখান থেকে তাঁদের ওপর ব্যাপক গুলি বর্ষিত হচ্ছিল। তখন এম এ মান্নান ও তাঁর দুই-তিন সহযোদ্ধা সিদ্ধান্ত নিলেন তা ধ্বংস করার। স্টেশনের উত্তর দিকে একটি বাংকারে ছিল সেই মেশিনগান। তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধা আবদুর রহিম (বীর বিক্রম, তাঁর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার খেওড়া গ্রামে) জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্রলিং করে সেদিকে যান। আবদুর রহিম বাংকারে গ্রেনেড ছুড়বেন এমন সময় গুলিবিদ্ধ হন। মান্নানের চোখের সামনেই ঘটল সব। রক্তে ভেসে গেল জায়গাটা। তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। মেশিনগান পজিশনের কাছের আরেকটি বাংকারে থাকা পাকিস্তানিরা তাঁদের দেখে গুলি করে। সেদিন সেখানে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। মান্নান ১৯৭১ সালে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ২৭ মার্চের পর তিনি পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ করেন চট্টগ্রামের কুমিরা এলাকায়। তিনি তখন ছিলেন প্লাটুন কমান্ডার। এরপর তিনি তাঁর প্লাটুন নিয়ে যান হরিণায়, পরে ভারতের তেলঢালায়। এম এ মান্নান জেড ফোর্সের অধীনে ১১ নম্বর সেক্টরের রৌমারী এলাকার ঠাকুরের চর, নকশী বিওপিতে ও বৃহত্তর সিলেট জেলার বড়লেখা, কমলগঞ্জসহ আরও কয়েকটি স্থানে যুদ্ধ করেন। কমলগঞ্জে তিনি গুরুতর আহত হন। তাঁর বুকে গুলি লেগে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। তিনি ছিলেন জেড ফোর্সের একজন সাহসী যোদ্ধা। নকশী, চিলমারী, বড়লেখা ও কমলগঞ্জের যুদ্ধে এম এ মান্নান যথেষ্ট সাহস, বীরত্ব ও রণকৌশল প্রদর্শন করেন। এ জন্য তাঁকে বীর বিক্রম খেতাব দেওয়া হয়।এম এ মান্নানের পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার সিদলাই গ্রামে। বর্তমানে তিনি এখানেই বাস করেন। তবে অতিরিক্ত গেজেটে (মার্চ ১১, ২০০৪) তাঁর ঠিকানা আছে—ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার কুটি ইউনিয়নের জাজিয়ারা গ্রাম। সে সময় তিনি সেখানে বসবাস করতেন। তাঁর বাবার নাম মিন্নত আলী। মা সাহারা বানু। স্ত্রী নূরজাহান আক্তার। তাঁর পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে। এক ছেলে দুই বছর ধরে নিখোঁজ।মান্নান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেই থেকে যান। ১৯৮০ সালে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তখন তাঁর পদমর্যাদা ছিল সুবেদার। তিনি পেনশনের সব সুবিধা পাননি।আলাপকালে এম এ মান্নান বলেন, ‘অনেক ত্যাগ স্বীকার করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। আজ স্বাধীন দেশে বাস করছি। এ জন্য গর্ববোধ করি। আমার নিজের কোনো বাড়ি নেই। ভাড়াবাড়িতে থাকি।’সূত্র: এম এ মান্নান বীর বিক্রমের সাক্ষাৎকার; নিয়েছেন প্রথম আলোর কসবা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি মো. সোহরাব হোসেন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।ঘোষণা: প্রিয় পাঠক, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা সম্পর্কে তথ্য জানা থাকলে তা এবং ধারাবাহিক এই প্রতিবেদন নিয়ে আপনাদের মতামত আমাদের কাছে পাঠান।গ্রন্থনা: তারা রহমানtrrashed@gmail.com