Thank you for trying Sticky AMP!!

অনন্য সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ৮৫তম জন্মবার্ষিকীর ঠিক এক সপ্তাহ পরই তাঁর প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পূর্ণ করছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তিনি, শিক্ষক তিনি; শুধু তা–ই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রকৃত উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র করে তোলার জন্য তাঁর ভাবনা ও কর্মে কখনো কোনো বিরতি ছিল না। আমরা জানি, একাধিকবার ‘উপাচার্য’ হওয়ার সুযোগ তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন; মনোযোগী হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত মর্ম জ্ঞানান্বেষু সুধীর কাছে পৌঁছে দিতে। দুই খণ্ডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বক্তৃতা সংকলন ও সম্পাদনার কৃতিত্ব তাঁর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা, উচ্চতর মানববিদ্যা কেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত মানসম্পন্ন বাংলা-ইংরেজি সাময়িকপত্র; বহু কিছুতেই আছে তাঁর উদ্যম ও উদ্যোগের ছাপ। ক্যানসারে অকালপ্রয়াত জীবনসঙ্গীর স্মৃতিকে স্থায়ী করতেও তিনি বেছে নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়কে। আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে চালু করেছেন ‘নাজমা জেসমিন চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের কৃতী এই ছাত্র যুক্তরাজ্যের লিডস ও লেস্টারে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করে স্বদেশকেই গন্তব্য জ্ঞান করেছেন। জোসেফ কনরাড, ই এম ফরস্টার ও ডি এইচ লরেন্সের উপন্যাসের অশুভের উপস্থিতিকে পিএইচডির বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তিনি; সাহিত্যের সীমানা থেকে ক্রমশ তিনি এই অশুভের সন্ধান করেছেন সমাজ ও রাষ্ট্রের বিস্তৃত পরিসরে।

শুরুটা কথাসাহিত্য দিয়ে আর পরিণতি প্রবন্ধ-গবেষণাতে। এখনো অনেকে ভোলেননি তাঁর গল্পগ্রন্থ ভালমানুষের জগৎ বা শিশু–কিশোরদের জন্য লেখা দরজাটা খোলো বইয়ের কথা।

অবিরাম পথ খোঁজা, পিতার হুকুম।

প্রায় ছয় দশক আগে ১৯৬৪-তে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ অন্বেষণ। এরপর সম্প্রতি প্রকাশিত বিদ্যাসাগর ও কয়েকটি প্রসঙ্গ পর্যন্ত তাঁর যে প্রাবন্ধিক অভিযাত্রা, তাতে বাংলা ও বিশ্বসাহিত্য বিষয়ে নতুন আবিষ্কার-উন্মোচনের পাশাপাশি আছে সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি-অর্থনীতি বিষয়ে নিজস্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। কুমুর বন্ধন, শরৎচন্দ্র ও সামন্তবাদ, বঙ্কিমচন্দ্রের জমিদার ও কৃষক, নজরুল ইসলামের সাহিত্যজীবন, উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ-এর সমান্তরালে তাঁর হাতেই লেখা হয়েছে শেকস্‌পীয়রের মেয়েরা, ধ্রুপদী নায়িকাদের কয়েকজন, ইংরেজি সাহিত্যে ন্যায়-অন্যায়, প্রতিক্রিয়াশীলতা: আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যে–এর মতো জিজ্ঞাসাবাহী বই। মার্ক্সীয় আদর্শে অবিচল আস্থা তাঁর। গবেষণাগদ্য থেকে সাময়িক প্রসঙ্গে লেখা কলাম; সবকিছুতেই তাঁর এই কাঠামোর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। তবে জ্ঞানবিশ্বের সমসাময়িক অন্যান্য চর্চা নিয়ে তাঁর আগ্রহের অন্ত নেই। তাই উপমহাদেশের নিম্নবর্গীয় ইতিহাসবিদদের চিন্তাকাঠামো নিয়ে ‘ঔপনিবেশিক ভারতে ইতিহাসের গতিবিধি’ আর প্রাচ্যবাদী ভাবনাবলয় নিয়ে ‘এডওয়ার্ড সাঈদ কেন গুরুত্বপূর্ণ’ শীর্ষক সুদীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেন। নীরদ সি চৌধুরীর ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তি নিয়ে লিখতে ভোলেননি ‘কৃষ্ণসাহেবের ক্ষোভ’‘লড়াই’ নামের প্রবন্ধ। রবীন্দ্রনাথের মতোই উদার আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাস তাঁর আর জাতীয়তাবাদ বিষয়ে অসাধারণ দুটো বই বাঙালীর জাতীয়তাবাদ এবং জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তিও তাঁরই লেখা।

ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন হোমারের অডিসি, এ্যারিস্টটলের কাব্যতত্ত্ব, ইবসেনের বুনোহাঁস, হাউসম্যানের কাব্যের স্বভাব। সম্পাদনা করেছেন একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশার রচনাবলি।

কখনো কখনো তীব্র প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সদা শাণিত কলম।

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’-এর আয়োজনে ‘ভবিষ্যতের বাংলা’ শীর্ষক সেমিনারে আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ, আহমদ শরীফ, মমতাজুর রহমান তরফদার প্রমুখের সঙ্গে অন্যতম বক্তা ছিলেন তিনি। লিখিত বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘মানুষের স্বাধীন বিকাশের জন্যে স্বাধীন বাংলা চাই’।

‘গাছপাথর’ ছদ্মনামে একসময় দৈনিক সংবাদ–এ এক জনপ্রিয় কলামের লেখক ছিলেন তিনি। ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ছাদ ধসে বহু ছাত্র হতাহতের ঘটনার কালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের ছোটখাটো স্বাস্থ্যসমস্যা নিয়ে পত্রপত্রিকার কৌতূহল আর জগন্নাথ হলের অবকাঠামো সমস্যা নিয়ে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে ব্যঙ্গ করে তিনি লেখেন:

‘রিগ্যানের নাকের খবর নিয়ে আমরা কৌতূহলী কিন্তু আমাদের নাকের ডগায় জগন্নাথ হলের ছাত্ররা যে আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে বসবাস করে আসছিল, তা নিয়ে আমাদের কোনো বিকার ছিল না।’

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সমষ্টি-মানুষের উত্থান চান। তিনি জানেন, মানুষের মাঝে আছে ‘স্বাধীনতার স্পৃহা, সাম্যের ভয়’। দায়বদ্ধ বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি মানুষের মনোজাগতিক উন্নতির মাধ্যমে মানবিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে তাঁর দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এ জন্য বিভিন্ন সময় সাহিত্যপত্র, সময়-এর মতো রুচিশীল কাগজ সম্পাদনা করেছেন। গত দুই দশক বিরতিহীনভাবে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়ে চলেছে সাহিত্য-সংস্কৃতির ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত। পত্রিকার মধ্য দিয়ে নতুন লেখকদের প্রকাশ-বিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুতের পাশাপাশি তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘সমাজ রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্র’-এর উদ্যোগে সমসাময়িক বিষয়ে আয়োজিত হয়ে চলেছে ‘আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ স্মারক বক্তৃতা’। লেখার টেবিল থেকে মিছিলের রাজপথ—সর্বত্রই তিনি ছিলেন ও আছেন। বাংলা বানানে অন্যায় হস্তক্ষেপ কিংবা নির্বিচার বৃক্ষনিধনের বিরুদ্ধে তিনি সদা সোচ্চার এক নাম।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাম্প্রতিক দুটো বই অবিরাম পথ খোঁজা (প্রথমা প্রকাশন, তৃতীয় মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০১৯) এবং পিতার হুকুম (প্রথমা প্রকাশন, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০১৮)। শেষোক্ত বইয়ে বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সমাজের পিতৃতান্ত্রিক পরিসরকে তিনি চিহ্নিত করেছেন এবং নারী–পুরুষের সমতামূলক আগামীর পথ খুঁজেছেন। এই অন্বেষণে অনিবার্যভাবে এসেছে তাঁর মায়ের কথা:

‘সারাক্ষণ তিনি চলাচল করতেন। ঘরের ভেতরেই, এ ঘর থেকে ও ঘরে অসংখ্যবার তাঁর হাঁটাচলা ঘটত। আমি নিজে যে হাঁটতে খুব পছন্দ করি, সেটা মনে হয় মায়ের কাছ থেকেই পাওয়া।’

শুভ জন্মদিন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।