Thank you for trying Sticky AMP!!

অন্তরের শিল্প অন্দরের কলা

সৈয়দ শামসুল হকের চিত্রকর্ম
>ডেইলি স্টার-বেঙ্গল আর্টস প্রিসিঙ্কটে ‘চিত্রের দিব্যরথ’ নামে সৈয়দ শামসুল হকের প্রদর্শনীটি শুরু হয়েছে ২৩ মার্চ। চলবে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত


অবশেষে সৈয়দ শামসুল হকের একটি শিল্পপ্রদর্শনী আয়োজিত হতে পারল। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর জীবন সমর্পণ করেছিলেন সাহিত্যে। তাঁর রূপরচনার অপরিমেয় সৃষ্টিশীলতা কবিতাসহ সাহিত্যের নানা মাধ্যমে উপচে পড়েছিল। কিন্তু সাহিত্যের সীমানা তাঁর রূপরচনার কল্পনাপ্রতিভাকে বেঁধে রাখতে পারেনি। এর অবিশ্রান্ত বেগবান স্রোত সাহিত্যের উপকূল থেকে তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। শিল্পের আরও নানা মাধ্যমে রূপরচনার তীব্র আকুতিতে অস্থির করে তুলেছিল তাঁকে। তিনি তাঁর মুক্তির পথ খুঁজেছিলেন গানে, চলচ্চিত্রে, শিল্পকলায়। তবু সাহিত্যসহ অন্যান্য মাধ্যমে সৈয়দ শামসুল হক যতটা চেনা, শিল্পকলায় ততটা নন। যেন আর সব তাঁর সৃষ্টিশীল সত্তার সদরের বিষয়, শিল্পকলা অন্দরের। যাঁরা তাঁর আপনজন তাঁরা জানতেন, চিত্রকলা ছিল তাঁর গোপন ও অন্তরতম শিল্প-অভিসার। তিনি খুব করেই চেয়েছিলেন, তাঁর শিল্পকর্মের একটি প্রদর্শনী হোক। জীবদ্দশায় হয়নি। এখন যখন হচ্ছে, তখন তিনি মৃত্যুকে অতিক্রম করে তাঁর রচনাসম্ভারের মধ্য দিয়ে অতিজীবিত হয়ে উঠেছেন।

ভাষাই ছিল সৈয়দ শামসুল হকের প্রধান অবলম্বন। সাহিত্যই ছিল তাঁর মূল পথ ও গন্তব্য। সাহিত্যের সব চেনা মাধ্যমে—কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, আত্মজীবনীতে, বিচিত্র ধাঁচের গদ্যে—নিজেকে তিনি প্রকাশ করেছিলেন। তবু শুধু এটুকু বললে তাঁর সাহিত্যকল্পনার পরিধির যথাযথ মাপ মেলে না। এই সব চেনা পথে তাঁর তৃষ্ণা মেটেনি। সাহিত্যের নতুন নতুন রূপের সন্ধান তাঁকে আকুল করে তুলেছিল। ঝংকারময় গদ্যকবিতার ধাঁচে অন্তর্গত নামে দীর্ঘ এক আখ্যান লিখেছিলেন তিনি। সেটির নাম দিয়েছিলেন ‘কথাকাব্য’। জলেশ্বরী নামে একটি কল্পিত জনপদের পটভূমিতে রচনা করেছিলেন কিছু মানুষের অনুচ্চ ও আশ্চর্য নৈর্ব্যক্তিক জীবনগাথা। এর নাম দিয়েছিলেন ‘গল্প-প্রবন্ধ’।

সৈয়দ শামসুল হক

তারপরও শেষ বিচারে এসব তো সাহিত্যের একেবারে ভেতরেরই এলাকা। এর ভেতর দিয়ে চলতে চলতেই, মুক্তিযুদ্ধের পর পর, হঠাৎ তিনি চলে এসেছিলেন প্রত্যক্ষ রূপের দিকে। ব্যগ্র হয়ে পড়েছিলেন কবিতার বাহ্যিক শরীরকেই একটি রূপকাঠামো দিতে। ফরাসি কবি গিয়োম আপোলিনেয়ারের ক্যালিগ্রামই হয়তো ছিল তাঁর প্রেরণার উৎস, কিন্তু সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের নিষ্করুণ বাস্তবতা এবং ১৯৭০-এর দশকে দক্ষিণ গোলার্ধজুড়ে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের তীব্রতার চাপ তাঁকে এসব রূপের দিকে নিয়ে এসেছিল। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত প্রতিধ্বনিগণ কাব্যগ্রন্থের ‘গেরিলা’, ‘অদ্ভুত আগন্তুক’ বা ‘বস্তুর আকার’ কবিতাগুলোতে ধরা পড়বে তাঁর মনের সেই অবস্থা। সবগুলো কবিতারই বিষয় যুদ্ধ বা সহিংসতা। ভেতরের উপাদান কবিতার বাইরের রূপকে শাসিত ও রূপান্তরিত করেছে। কবিতা পেয়ে গেছে মাছ বা পিস্তল বা অস্ত্র হাতে গেরিলা যোদ্ধার অবয়বগত চেহারা। তবে কথা এই যে চাক্ষুষ রূপের তৃষ্ণা এবং দৃশ্যরূপ রচনার ওপর অধিকার না থাকলে সৈয়দ শামসুল হকের পক্ষে এ পথ মাড়ানো সম্ভবপর ছিল না।

কবিরা ছবি আঁকেননি, এমন নয়। ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্লেক বা লেবানিজ কবি কহলিল জিবরান থেকে বাঙালির রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা এখনো সক্রিয় সিরীয় কবি আদোনিস পর্যন্ত অনেক কবিই ছবি এঁকেছেন। তাঁদের কারও কারও চিত্ররচনা কবিতা-নিরপেক্ষভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। কারও কারও ছবি তাঁদের কবিতার রহস্যময় অন্তঃপুরে ঢোকার চাবির কাজটিও করে বটে। চিত্রকরদের মধ্যেও কেউ কেউ লিখেছেন। লেওনার্দো দা ভিঞ্চির ডায়েরিতে পাওয়া গেছে প্যারাবল, মিকেলাঞ্জেলো লিখেছেন পাতার পর পাতা সনেট, মুর্তজা বশীর তো কবিতা-গল্প-উপন্যাসে কিছুদিনের জন্য নিবিষ্টই হয়েছিলেন। ১৯৩৫ সালে পাবলো পিকাসো হঠাৎ শিল্পরচনায় ইস্তফা দিয়ে লেখালেখিতে মন দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন শতেকখানি কবিতা এবং যথেষ্ট হইচই ফেলা নাটক ডিজায়ার কট বাই দ্য টেইল। আলব্যের কামুর পরিচালনায় সেই নাটকের মঞ্চপঠনে পিকাসোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন জাঁ পল সার্ত্র আর সিমন দো ব্যুভোয়া। পিকাসোর চিত্রকলার রঙের জগৎ আক্ষরিক অর্থেই ছলকে পড়েছিল তাঁর কবিতায়। সেসব কবিতার ওপর ভর করে বহু গবেষক পিকাসোর ছবির রঙের অনুভবের খোঁজ করেন।

সৈয়দ শামসুল হকের গড়া ভাস্কর্য


সৈয়দ শামসুল হকের শিল্পরচনায়ও কি খুঁজে পাওয়া যাবে না তাঁর রূপভাবনার পেছনের মনটিকে? যে মানুষটি সাহিত্য রচনা করেছেন, ছবিগুলো তো তিনিই লিখেছেন বটে। বাংলা ভাষার নিজেরই এ এক অনন্য প্রতিভা যে ভাষা আর ছবি, দুইয়েরই সূচনা এতে বর্ণ থেকে। ভাষার ভেতর দিয়ে যে সৈয়দ শামসুল হক বর্ণময় কল্পনার জগৎ সৃষ্টি করেছেন, তিনিই চিত্রপটে বর্ণযোজনা করেছেন। চিত্রকলার প্রতি তাঁর আকর্ষণ গড়ে উঠেছিল সাহিত্যজীবনের সূচনা থেকেই। ১৯৫০-এর দশকে তরুণ বয়সেই তাই তাঁর বন্ধুবলয়ে ভিড় জমে উঠেছিল চিত্রকরদের। আরও পরে এই আকর্ষণের তীব্রতা তাঁকে নিয়ে এসেছিল মিকেলাঞ্জেলোর কাছে। দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী মগ্ন হয়ে ছিলেন মিকেলাঞ্জেলোর কবিতার অনুবাদে। সেসব নিয়ে বেরোল পাথর ও শূন্যপটে স্বর্গের দীপন নামের বইটি (প্রথমা প্রকাশন ২০১৪)। আর এর মাঝখানে সেই যে কলমের ফাঁকে ফাঁকে হাতে তুলে নিতে শুরু করলেন রংতুলি। আঙুল থেকে তা আর কখনো খসে পড়েনি। তরুণ বয়সেই তাঁর মন ও মনে প্রতিফলিত পৃথিবীর আরেকটি পর্দা এই প্রদর্শনী উন্মোচন করল।

দৃশ্যরূপ রচনার তাগিদ থেকে সৈয়দ শামসুল হক চিত্রকলার নানা কৌশল আয়ত্ত করার চেষ্টায় কিছুদিনের জন্য নিবিষ্ট হয়েছিলেন। এ কাজে তাঁর সহায় হয়েছিলেন বন্ধু-চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। গল্প করার সময় হাতে কাগজ-কলম থাকলে আনমনে মগ্ন হয়ে যেতেন আঁকিবুঁকিতে। আড্ডা আর গল্পের ফাঁকে অনেক দিনই কাগজে ফুটে উঠতে দেখেছি রেখায় বাঁধা স্বতঃস্ফূর্ত রূপবন্ধ। সৈয়দ শামসুল হক কিছুদিনের জন্য মেতে উঠেছিলেন শৌখিন ভাস্কর্য রচনায়। ১৯৮০-র দশকে তাঁর বাড়ির উঠানের প্রক্ষিপ্ত বাগানে কাঠে গড়া সেসব ভাস্কর্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। সেগুলোর ধাঁচ ছিল অনেকটা অবনীন্দ্রনাথের কাটাম-কুটুমের মতো। ঝাকড়া গাছপালার মধ্যে প্রায় প্রাকৃতিক সেসব ভাস্কর্য একাকার হয়ে মিশে থাকত।

প্রকৃতপক্ষে সৈয়দ শামসুল হকের মধ্যে সৃষ্টিশীলতার যে তৃষ্ণা জেগে উঠেছিল, সেটি ছিল রেনেসাঁ-মানবদের মতো। বৈশিষ্ট্যে তিনি ছিলেন পলিম্যাথ। তাঁর শিল্পরচনা সেই পলিম্যাথ স্বভাবেরই আরেকটি মাত্রা। এই প্রদর্শনী আমাদের কাছে সৈয়দ শামসুল হকের পরিচয় পূর্ণতর করল।