Thank you for trying Sticky AMP!!

অবিশ্বাস্য হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ

গত মাসে ভারত যাওয়ার জন্য প্লেনে বসে আছি। বেঙ্গালুরুতে একটা কনফারেন্সে অংশ নেব। আমাদের সিট পড়েছে প্লেনের পেছন দিকে। আশপাশে সবাই চেনামুখ। প্লেন আকাশে উড়তেই জমে ওঠে আড্ডা।

আমাদের সঙ্গীদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকনেতা। একসময় তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সদস্য। সেই সুবাদে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে একটা গল্প ফেঁদে বসেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদ নিজেও তখন সিন্ডিকেট সদস্য। সিন্ডিকেটের দীর্ঘ ও অহেতুক কথায় অতিষ্ঠ হয়ে মিটিংয়ের মাঝখানে তিনি বাইরে গেছেন। শিক্ষকনেতাও তাঁর সঙ্গে গেছেন। তাঁর বক্তব্য অনুসারে আলাপচারিতার এক ফাঁকে তিনি হুমায়ূন আহমেদকে বললেন, আপনার নন্দিত নরকে আর শঙ্খনীল কারাগার তো নকল।

হুমায়ূন আহমেদ স্মিত হাসেন, কিসের নকল?

সোমেন চন্দের ‘ইঁদুর’ গল্পের।

‘ইঁদুর’ আমার পড়া গল্প। এর সঙ্গে হুমায়ূনের উপন্যাসগুলোর কোনো মিল নেই। আমি তবু বিরক্তি চেপে বললাম, আপনার কথা শুনে হুমায়ূন আহমেদ কী বললেন?

শিক্ষকনেতা বললেন, তিনি আর কী বলবেন। বলার তো কিছু নাই।

আমি বললাম, আপনার এই গল্পটা সত্যি না। এক. এই উপন্যাস দুটো কোনো কিছুর নকল না! তিনি কোনো কিছু নকল করার মানুষই না। দুই. এমন উদ্ভট অভিযোগ করলে তিনি এভাবে উত্তর দেবেন না।

আমার পেছনে ছিলেন প্রখ্যাত আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন। তিনি আরেকটু ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, তাঁকে নিয়ে এসব বলবেন না। আমি তো বহু বছর দেখেছি তাঁকে। তিনি অন্য রকম মানুষ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকনেতা মুখ কাঁচুমাচু করে থেমে যান। লেখালেখির প্রসঙ্গ থেকে একপর্যায়ে আমাদের আলাপ চলে যায় ‘অন্য রকম’ হুমায়ূন আহমেদ প্রসঙ্গে। নাসির আলী মামুন শুরু করেন তাঁর অভিজ্ঞতার গল্প।

বহু বছর আগে মফস্বলের এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে বাসে চেপে যাচ্ছিলেন হুমায়ূন। তাঁর পাশে বৃদ্ধ এক যাত্রী। হুমায়ূন গল্প করছেন। এ সময় মামুন হঠাৎ খেয়াল করে দেখলেন, পাশের যাত্রী হুমায়ূন আহমেদের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গেছেন। ক্লান্ত বৃদ্ধের হাঁ করা মুখ দিয়ে লালা পড়ছে তাঁর শার্টে। মামুন ঘুম থেকে তাঁকে জাগানোর প্রস্তাব দিতেই হুমায়ূন বারণ করেন। বহু দূর যাওয়ার পর বৃদ্ধের যখন ঘুম ভাঙে, হুমায়ূনের শার্ট তাঁর লালায় একাকার তখন। বাড়তি কোনো শার্ট না থাকায় পরে সেই শার্ট ধুয়ে শুকিয়ে অনুষ্ঠানে যেতে হয় তাঁকে।

পিনপতন নিস্তব্ধতায় আমরা শুনি মামুনের গল্প। মানুষের প্রতি হুমায়ূনের অসাধারণ মমত্ববোধের এমন বহু ঘটনা জানি আমি। জানার সুযোগটা আছে আমার। এ জন্যই মনে হয় প্রগাঢ়ভাবে মানুষকে ভালোবাসার শক্তিই ছিল তাঁর লেখকসত্তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। এ জন্যই তাঁর গল্প, তাঁর সৃষ্টি এত ঘনিষ্ঠভাবে ছুঁয়ে যায় মানুষের মন। আজও। 

দুই.

একনজরে তিনি ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু তিনি অসামান্য ও অদ্বিতীয় হয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টি আর সৃজনশীলতার কারণে। গত শতকের আশি আর নব্বইয়ের দশকে ইন্টারনেট আর স্যাটেলাইট টিভি ছিল না। হয়তো এ কারণেই আমরা, সে সময়ের তরুণেরা বড় হয়েছি নির্বিচারে গল্প-উপন্যাস পড়ে পড়ে। আমরা নীহাররঞ্জন-ফাল্গুনী পড়তাম, তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণও পড়তাম, পড়তাম রশীদ করিম আর মাহমুদুল হক। পুশকিন, গোর্কি, চেখভ, তলস্তয় না পড়ার কথাও তখন চিন্তা করা যেত না। বিচিত্রা, সচিত্র সন্ধানী আর রোববার ঈদসংখ্যা খুঁজে পড়তাম প্রত্যেক লেখকের লেখা।

তাঁর উপন্যাস ছিল সবকিছুর মধ্যে অনন্য। মাত্র ষাট-সত্তর পাতার ছোট্ট একটা গল্পে মানুষকে বিভিন্নভাবে অভিভূত করার যে ক্ষমতা তাঁর ছিল, তা আদতেই অতুলনীয়। সামান্য বর্ণনায় চরিত্রের গভীরতা আর দৃশ্যকল্প সৃষ্টিতে তাঁর পারঙ্গমতাও ছিল অনন্য। লেখক হিসেবে তিনি একই সঙ্গে সহজাত, সহজবোধ্য ও শক্তিশালী ছিলেন। ফলে সমাজের সব স্তরের মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যেতে পেরেছিল তাঁর গল্প-উপন্যাস।

তাঁর লেখা সুনীল আর শীর্ষেন্দুকে হটিয়ে দিয়েছিল, তাঁর নাটকের ছোট সংলাপ ‘তুই রাজাকার’ সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুনর্জন্ম ঘটিয়েছিল, তাঁর প্রতি মানুষের আগ্রহ ছাপিয়ে গিয়েছিল দেশি-বিদেশি সিনেমা-তারকাদেরও।

সব অর্থেই তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র মেগাস্টার! 

তিন.

হুমায়ূন আহমেদকে অন্য অধিকাংশ মানুষের মতো আমিও প্রথম চিনতাম পাঠক হিসেবে। পরে একটি লেখাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে আইনজীবীরা তাঁর বিরুদ্ধে মামলা শুরু করলে তিনি একদিন বিচিত্রা অফিসে চলে আসেন। বিচিত্রায় তখন কাজ করতেন শাহাদত চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির আর চিন্ময় মুৎসুদ্দীর মতো তাঁর ঘনিষ্ঠ মানুষেরা। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, তাঁর বিরুদ্ধে মামলাগুলোকে উপজীব্য করে একটি প্রচ্ছদকাহিনি রচনার। ‘সাহিত্য বনাম আদালত’ নামের সেই লেখাটি লিখতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার সূচনা। ঘনিষ্ঠতা হয় তাঁর পরিবারের সঙ্গেও।

লেখক হিসেবে উত্থানকাল থেকে মধ্যগগন পর্যন্ত হুমায়ূনকে সবচেয়ে অবিরামভাবে দেখেছেন তাঁর তখনকার জীবনসঙ্গী। তাঁর দৃষ্টিতে হুমায়ূন আহমেদ কেমন, এ রকম একটি প্রচ্ছদকাহিনি আমি বিচিত্রার জন্য লিখেছিলাম আজ থেকে ২৪ বছর আগে।

মনে আছে, ‘গুলতেকিনের চোখে হুমায়ূন আহমেদ’ শিরোনামে এই লেখাটির ধারণা আমি দেওয়ামাত্র হুমায়ূন নিজেই আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি গুলতেকিনকে ‘যা ইচ্ছে বলো’ এমন কথা বলে বলে সাক্ষাৎকারটি দিতে রাজি করান। সাক্ষাৎকার নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ‘দু-একটা ভালো কথাও কি বলেছ,’ এ ধরনের রসিকতা করেছেন। চারপাশের মানুষজনকে ‘ভাই রে, গুলতেকিন বোধ হয় ডুবিয়ে দিচ্ছে আমাকে’ বলে নিজেই প্রচুর আনন্দ করেছেন। তখনকার সময়ে প্রবল সমাদৃত এই লেখার কিছু অংশ সংক্ষেপিতভাবে এখানে তুলে দিচ্ছি ব্যক্তি ও লেখক হুমায়ূন সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের ভক্তদের জানার আগ্রহের কথা ভেবে।

বিচিত্রা: হুমায়ূন আহমেদ লেখালেখি করার সময় আপনি কাছে থাকেন?

গুলতেকিন: কাছাকাছি বসে থাকি। ও যখন এক পৃষ্ঠা লেখে, তখনই পড়ে ফেলি। বেশির ভাগ সময় অবশ্য শীলাই পড়ে।

বিচিত্রা: তিনি যেভাবে লেখার পরিকল্পনা করেন, সেভাবে লিখতে পারেন?

গুলতেকিন: মাঝে মাঝে পারে না। বিশেষ করে উপন্যাসের শেষের অংশগুলো। হুমায়ূন বলে কেউ একজন তাকে দিয়ে এভাবে উপন্যাসটা শেষ করিয়ে নেয়। তার কিছু করার থাকে না।

বিচিত্রা: আপনি লেখার সমালোচনা করলে কী করেন তিনি?

গুলতেকিন: রেগে যায়।

বিচিত্রা: রেগে যায়?

গুলতেকিন: হ্যাঁ। একেক সময় একেকভাবে রাগে। হয়তো আমি লেখা পড়ে কিছু বললাম না। ও জিজ্ঞেস করলে বললাম, ভালোই! ও রেগে বলে, ভালোই মানে কী? হ্রস্ব-ই কেন? তখন যদি বলি, এখনো তো লেখাটা শেষ করোনি। ক্যারেক্টার সেভাবে ডেভেলাপ হয়নি। সে বলে, ভাত তো একটা টিপে দেখলেই বোঝা যায়! আমি হয়তো বলি, এমন কাহিনি তো আগেও লিখেছ। সে কিছুক্ষণ তর্ক করে। তারপর চুপচাপ গম্ভীর হয়ে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর নিজেই লেখা চেঞ্জ করে। বা হয়তো দশ-বারো পৃষ্ঠা লেখা হলে ছিঁড়েই ফেলে।

বিচিত্রা: সম্ভবত অনেক বেশি লেখেন বলে তাঁর লেখায় ঘটনার রিপিটেশন হয়, কিছু চরিত্রের বিন্যাস একই রকম?

গুলতেকিন: ওকে আমি বলেছি। ও বলে, দেখো, লিমিটেশনের ঊর্ধ্বে কেউ না। বিভূতিভূষণও অপু ধরনের চরিত্রের বাইরে যেতে পারেননি।

বিচিত্রা: কোনো কোনো সমালোচক বলেন, হুমায়ূনের লেখায় গভীরতা নেই। আপনার তা মনে হয়েছে?

গুলতেকিন: হয়নি। গভীরতা আসলে কী? গভীরতা মানে কি কঠিন কঠিন কিছু কথা বলা? কঠিন করে বলা? আমি নিজে এর পক্ষপাতী নই।

বিচিত্রা: হুমায়ূনের মধ্যে হিমু ও মিসির আলী বিপরীতমুখী এ দুজনকেই পান?

গুলতেকিন: পাই। অনেক বইয়ের মধ্যেই তার ঘটনা, অভিজ্ঞতা তার কথা চলে আসে। আমার মনে হয়, নি ছাড়া তার পুরো কাল্পনিক কোনো উপন্যাস নেই। ও নিজে খুব বৈচিত্র্যপ্রেমী। এর ছায়া কোনো না কোনোভাবে উপন্যাসে আসে।

বিচিত্রা: তাঁর মধ্যে একটা শিশুও আছে। তাই না?

গুলতেকিন: হ্যাঁ আছে, কখনো এত সরল ও, নিজের পুরোনো বই পড়েই কাঁদতে থাকে। বলে, এত ভালো লিখেছি আমি! আনন্দে থাকলে যে কী করে। আমাদের ঘুরতে নিয়ে যায়, খাওয়াতে। আরও কত ছেলেমানুষি আছে ওর। খুব গভীরে একটা গুড সোল আছে ওর।

(সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ২১ বর্ষ, ৩৬ সংখ্যা, ১৯৯৪) 

চার.

হুমায়ূন আহমেদ আমার সবচেয়ে প্রিয় দু-তিনজন লেখকের একজন। তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়ে কোনো তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ করার গভীরতা আমার নেই। তবে লেখকদের আমি যে কয়েকটি ভাগে ভাগ করি, তিনি তার মধ্যে সর্বোত্তম। আমার বিশ্বাস, সেরা লেখা সেটিই যা আমাকে অভিভূত করবে, তীব্রভাবে গ্রাস করবে এবং একই সঙ্গে বা জীবনের কোনো একটা ঘটনা/অনুষঙ্গ সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবার খোরাক দেবে। সোজা ভাষায় যার সঙ্গে আমি কোনো না কোনোভাবে অনায়াসে নিজেকে সম্পর্কিত ভাবতে পারি। এই বৈশিষ্ট্য তাঁর অধিকাংশ লেখার মধ্যে রয়েছে।

তবে তিনি প্রকাশকদের পীড়াপীড়িতে দ্রুত হাতে বা অনিচ্ছুক মনে অনেক উপন্যাস লিখেছেন। কিছু লেখায় তাড়াহুড়া হয়েছে, কিছু লেখা অপূর্ণ থেকে গেছে, কিছু লেখায় পুনরাবৃত্তি হয়েছে। কিন্তু যেসব লেখা তিনি লিখেছেন নিজের আনন্দে সেখানে বোঝা যায় কতটা শক্তিশালী তাঁর লেখনী।

আমার ধারণা, সবচেয়ে বেশি নিজের পছন্দে তিনি লিখেছেন তাঁর বিজ্ঞানকল্প কাহিনিগুলো। ফলে এখানে কাহিনির বৈচিত্র্য, চরিত্র ও দৃশ্যকল্প নির্মাণের পারঙ্গমতা এবং অতুলনীয় কল্পনাশক্তির প্রমাণ পাওয়া যায় প্রতিটি লেখায়। আমি তো মনে করি, তিনি যে কত শক্তিশালী, ক্ষমতাশালী ও সৃজনশীল ছিলেন, তার সবচেয়ে বড় পরিচয় পাওয়া যায় এই কল্পকাহিনিগুলোতে। এন্ড্রেমিডা নক্ষত্রপুঞ্জে আটকে পড়া তিনটি মাকড়সা-জাতীয় প্রাণীর গল্প বলে তিনি কীভাবে মানুষের ক্ষুদ্রতাকে উন্মোচিত করেন (তারা তিনজন), কীভাবে অমরত্ব অর্জন করা মানুষের যন্ত্রণাকে ফুটিয়ে তোলেন (ইরিনা), ‘মেন্টালিস্ট’ আর মানুষের দ্বন্দ্বের মাঝে তিনি কীভাবে সামান্য বর্ণনায় একটি হৃদয়ছোঁয়া প্রেমের গল্প তৈরি করেন (ফীহা সমীকরণ), সামান্য একটা এক্স-রের ভুল থেকে কীভাবে এক অসামান্য মানবিক সম্পর্কের গল্প বলেন (কুহক), গাছের সঙ্গে কথা বলা একটা মেয়ে কেমন করে পরিণত বয়সের মানুষের জন্য মনোমুগ্ধকর কাহিনি হয়ে ওঠে (অন্য ভুবন), কোনো দিন এসব না পড়লে তা কল্পনাও করা যাবে না।

তাঁর কল্পকাহিনিগুলোতে বৃদ্ধ নিশানাথের প্রতি দীপার মমত্ব, জ্যোৎস্না ম্লান করে দেওয়া রেডিয়েশন গানে ফীহার মৃত্যুদৃশ্য, আহত অয়ূর প্রতি লী আর নীমের ভালোবাসা, অমরত্বের জগতে আটকা পড়া ছেলে মীরের জন্য বাবা অরচ লীওনের আত্মত্যাগের বিবরণ পড়ে এই মাঝবয়সেও আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি।

কল্পনা করি কোনো একদিন তাঁর এসব বই অনূদিত হয়েছে, এসব নিয়ে ছবি বানিয়েছেন স্পিলবার্গ বা জেমস ক্যামেরুনের মাপের কোনো পরিচালক। সারা পৃথিবীতে কি হুলুস্থুলই না পড়ে যাবে তাঁর বিজ্ঞান কল্পকাহিনিগুলো নিয়ে!

হুমায়ূন আহমেদের আরেক অনন্য সৃষ্টি তাঁর মুক্তিযুদ্ধের গল্প আর উপন্যাস। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী আর এ দেশে তাদের সহযোগীদের নারকীয় কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের জীবন ও মনস্তত্ত্বকে কী জটিল, ভয়াবহ এবং অদ্ভুতভাবে প্রভাবিত করেছিল, তা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর উপন্যাসগুলো পড়লে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তাঁর শ্যামলছায়ায় আছে অপারেশনের ঠিক আগে তরুণ এক মুক্তিযোদ্ধা দলের মানসিক অবস্থার বিবরণ, ১৯৭১-এ আছে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের পর ধরে আনা বিভিন্ন ধর্ম আর বয়সের মানুষের আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা, আগুনের পরশমণিতে আছে এক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দেওয়া পরিবারের সদস্যদের টানাপোড়েন। মুক্তিযুদ্ধের কারণ আর ইতিহাস সম্পর্কে এমনকি কোনো ধারণা না থাকলেও এই যুদ্ধের মহত্ত্ব, দেশের জন্য জীবন বাজি রাখা মুক্তিযোদ্ধাদের বিশালত্ব আর সাধারণ মানুষের দুঃসহ ভোগান্তি—এগুলো শুধু হুমায়ূনের উপন্যাস পড়লেই অনায়াসে জানা যায়।

তাঁর সৃষ্টিকর্মগুলো ছিল তাঁর মতোই বৈচিত্র্যময়, গভীর ও আনন্দময়। 

পাঁচ.

মাত্র কয়েকটা বছর তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলাম আমি। মারা যাওয়ার বেশ কয়েক বছর আগে থেকে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হতো না, কথাও না। কিন্তু তবু তার মৃত্যুসংবাদ শুনে আমারও মনে হয়েছিল, বুকের ভেতরে কিছু যেন খসে পড়ল হঠাৎ। সেই শূন্যতা কোনো দিন পূরণ হবে না কোনোভাবে। না আমার, না তাঁর একজন পাঠকেরও!

হুমায়ূন আহমেদ এখন আছেন অন্য এক ভুবনে। আমাদের ধরা-ছোঁয়া-দেখার পৃথিবীর চেয়ে সম্পূর্ণ অচেনা এক জগতে। কিন্তু এখনো অদ্ভুত কোনো নীলিমা দেখে, দূর কোনো নক্ষত্রের দিকে অপলক চেয়ে, ঘোর লাগা কোনো জ্যোৎস্নার প্লাবনে ডুবে ডুবে তাঁর কথা মনে পড়ে।

এই অপরূপ আর রহস্যময় বিশ্ব, মহাবিশ্ব। তার ভেতরে ভঙ্গুর মানুষের বিচিত্র জীবন সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে উপলব্ধি করতে পারতেন তিনি। ঘাসফুল, দিঘির জল আর লিলুয়া বাতাসকে সবচেয়ে বেশি হৃদয় দিয়ে ছুঁতে পারতেন তিনি। আপাত তুচ্ছ, সামান্য আর অনুল্লেখ সবকিছুর মধ্যে অপরূপ কিছু দেখতে পেতেন তিনি।

এসব রেখে কেন যে চলে যেতে হলো তাঁকে। এমন একটা মানুষকেও কেন যে যেতে হয়!