Thank you for trying Sticky AMP!!

এ নহে সুখপাঠ্য ইতিহাস

>

মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে ১০০ বছর আগে এসেছিল অক্টোবর বিপ্লব। ১৯১৭ সালে গঠিত হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন। ইতিহাসের নানা উত্থান–পতনের পর নিপীড়িত-সর্বহারাদের সেই জাগরণ ফিরে দেখা

শিল্পীর তুলিতে অক্টোবর বিপ্লব

মনে পড়ে, ১৯৬৭ সালে মহাধুমধাম করে ঢাকায় পালিত হয়েছিল সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ৫০তম বার্ষিকী। পাকিস্তানে তখন দোর্দণ্ড প্রতাপে চলছে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের শক্ত-শাসন। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ, তবে নানা আবরণে বামপন্থীরা সমাজে সক্রিয়। তাঁদেরই উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল অক্টোবর বিপ্লব বার্ষিকী উদ্যাপনের বিশাল নাগরিক কমিটি। লেখক-সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার হয়েছেন এর সম্পাদক, তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন সংস্কৃতিক্ষেত্রে সক্রিয় বিশিষ্টজন ও তরুণ ছাত্রনেতৃত্ব। পল্টন ময়দানে দুই দিনব্যাপী উন্মুক্ত অনুষ্ঠানে শতকণ্ঠে পরিবেশিত হয়েছিল গণসংগীত, আলতাফ মাহমুদের সুরে গীত হয় শহীদুল্লা কায়সার রচিত গান ‘আমরা চলি অবিরাম’, গানের মালা দিয়ে গাঁথা নৃত্যনাট্য পরিবেশন করেছিল শিল্পীদল। ঢাকার বাইরেও নিবেদিত হয়েছিল অনুষ্ঠান এবং সব আয়োজন শেষে প্রকাশিত হয় প্রবন্ধসংকলন তরঙ্গ।
বিশ্বমানবের মুক্তির আকুতি বহন করে সংঘটিত হয়েছিল অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, নিপীড়িত সর্বহারাদের জাগরণ ও বিজয়ের সেই লাল পতাকা হাতে দেশে দেশে পরিচালিত হচ্ছিল মুক্তির সংগ্রাম। ৫০ বছরে অক্টোবর বিপ্লবের প্রভাব ও শক্তি তখন আরও সংহত হয়েছে, পূর্ব ইউরোপজুড়ে গড়ে উঠেছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র-পরিবার, চীনের বিপ্লব পৃথিবীর বৃহত্তম জনগোষ্ঠীকে সমাজতন্ত্রের আওতাভুক্ত করেছে। লাতিন আমেরিকায় ক্ষুদ্র দ্বীপ কিউবা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে জয়যুক্ত কেবল করেনি, লাতিন মহাদেশে সৃষ্টি করেছিল অভূতপূর্ব আলোড়ন। ভিয়েতনামে মার্কিন সেনাবহর নামিয়ে সমাজতন্ত্রের প্রসার ঠেকাতে চলছে মরণপণ মার্কিন প্রয়াস। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জোরদার হচ্ছে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম। ঔপনিবেশিক কাঠামো যেহেতু পুঁজিবাদী, তাই জাতীয় মুক্তির এই সংগ্রাম মিত্র হিসেবে স্বাভাবিকভাবে সম্পৃক্ত হচ্ছিল সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সঙ্গে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এমনই অনুকূল আবহে উদ্যাপিত হয়েছিল অক্টোবর বিপ্লবের পঞ্চাশৎ বার্ষিকী। আমরা নবীন ছাত্র-কর্মী হিসেবে জড়িত ছিলাম সেই উৎসব আয়োজনে, সমাজতন্ত্রের অব্যাহত ও অবধারিত বিজয় সম্পর্কে প্রবল আশাবাদ নিয়ে। সেই তারুণ্য আজ যখন বিপ্লবের শতবার্ষিকী উদ্যাপনের সাক্ষী হচ্ছে, তখন পার হয়ে আসা পরবর্তী ৫০ বছরের পথের দিকে না তাকিয়ে উপায় থাকে না। পঞ্চাশৎ বার্ষিকী উদ্যাপনে যাঁরা শরিক হয়েছিলেন, তাঁদের যদি বলা হতো, প্রশ্ন করা হতো, শতবর্ষে পৌঁছে সাম্যের সমাজনির্মাণ সাধনা পাবে কতটা বিস্তার এবং কী দাঁড়াবে বিশ্বরূপ, তবে অনেকে নিশ্চয় আশাবাদে উদ্বেল অনেক কথা বলতেন। কিন্তু সমাজ, সভ্যতা, রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও মানব সম্পর্ক যে বিপুল পরিবর্তন দ্বারা আলোড়িত হয়েছে, সমাজতন্ত্র যেভাবে মুছে গেছে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ থেকে, তেমন কিছু তখন কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। একেবারে যে পারেনি, সেটা বলা যাবে না, তাহলে মানুষের জ্ঞানসাধনা ও মুক্তি-তপস্যার ওপর আস্থা হারাতে হয়। লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকেরা এ ক্ষেত্রে নানা ধরনের বার্তা দিয়ে গেছেন, রাষ্ট্র ও রাজনীতির বৃত্তে তা হয়তো হয়েছে উপেক্ষিত কিংবা বিবেচিত হয়েছে অপাঙ্ক্তেয় হিসেবে। জর্জ অরওয়েলের ভবিষ্যৎবাদী উপন্যাস নাইনটিন এইটিফোর এমনই এক রচনা, একদা সমাজতন্ত্রী ও পরবর্তীকালে পীড়নমূলক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর কঠোর সমালোচকের এই উপন্যাস প্রকাশকালে সমাজতন্ত্রবিরোধী সাহিত্য হিসেবে গণ্য হয়েছিল। সেই উপন্যাস এখনো গুরুত্ব হারায়নি এবং হালে নিউইয়র্কের ব্রডওয়েতে চলছে এর নিয়মিত অভিনয়। বিগত জুলাই মাসে হাসান ফেরদৌসের সৌজন্যে ব্রডওয়ের সেই অভিনয় দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল উত্তর-পুঁজিবাদী আধুনিক সমাজে ব্যক্তির ওপর সার্বিক নজরদারি এবং বাজার অনুগত ভোগবাদী সত্তায় তার রূপান্তরের যে মহাপ্রয়াস চলছে, জর্জ অরওয়েল বুঝি হালের সেই বাস্তবতাই মেলে ধরেছেন।
সোভিয়েত বিপ্লবের অসাধারণ রূপকার হয়েছেন শিল্পী-সাহিত্যিকেরা। শ্রমিক-কৃষক-বঞ্চিত মানুষের নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সভ্যতার বিকাশের নতুন পথ উন্মুক্ত করেছিল এবং সাবেকি ও পোশাকি সব আড়ম্বর ঘুচিয়ে নবযুগের উপযোগী শিল্পরূপ গড়ে তুলতে তাঁরা সচেষ্ট হয়েছিলেন। কবিতায় ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি হয়ে উঠেছিলেন এই চেতনার স্পর্ধিত রূপকার, চলচ্চিত্রে নবদিগন্তের উন্মোচক হলেন সের্গেই আইজেনস্টাইন, নাটকে মেয়ারহোল্ড, চিত্রকলায়-ভাস্কর্যে দেখা দিলেন একঝাঁক শিল্পী, যাঁরা বিপ্লবী আকুতি প্রকাশে সন্ধান করেছেন অভিনব শিল্পরূপ এবং বরণ করেছেন নবনিরীক্ষা। ‘তৃতীয় আন্তর্জাতিকের স্তম্ভ’-এর নকশা করেছিলেন ভ্লাদিমির তাতলিন, ঘুরে ঘুরে যে টাওয়ার বেয়ে একজন প্রায় যেন পৌঁছে যেতে পারেন মেঘলোকে। শেষাবধি এই টাওয়ার আর নির্মিত হয়নি; কিন্তু এর নকশা বুঝিয়ে দেয় শিল্পীর অভিপ্রায়। বিশ্বজনীন সাম্যের সমাজ নির্মাণ মানবকে পৌঁছে দেবে পরম উচ্চতায়, তবে উত্তরণের সেই পথ সরল কিংবা একরৈখিক নয়।
বস্তুত অক্টোবর বিপ্লবের যাঁরা নেতৃস্থানীয় এবং এই বিপ্লবের যে জননির্ভরতা—উভয় দিকেই ছিল বৈচিত্র্য। নেতৃত্বে ছিলেন ভ্লাদিমির উলিয়ানভ, লেনিন নামেই বিশ্ব যাঁকে চিনেছে। সহকর্মীদের মধ্যে বুখারিন ছিলেন তথ্যসন্ধানী পণ্ডিত, ট্রটস্কি একাধারে সংগঠক ও তাত্ত্বিক, স্তালিন পার্টি-অনুগত কর্মী। বলশেভিক পার্টি ছাড়াও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা ছিল বিপ্লবের বড় শক্তি, ছিল মেনশেভিকদের সম্পৃক্ততা, নানা দৃষ্টিভঙ্গির বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ। বৈচিত্র্যের প্রতিফলন মেলে তৎকালীন বিপ্লবী ধারণাতেও, যখন বিশ্বের নানা প্রান্তের সাম্যবাদীরা সমবেত হন মস্কোতে, মিলিত হন কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে। ভারতীয় বিপ্লবীদের জন্যও মস্কো হয়েছিল মুক্তিসংগ্রামের তীর্থভূমি, বাঙালিদের সেখানে ছিল বিশেষ উপস্থিতি, মানবেন্দ্রনাথ রায় (এম এন রায়), বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অবনী মুখার্জি, গোলাম আম্বিয়া লুহানী, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সেই দলে। এখানে বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয় পদানত জাতিসমূহের মুক্তিসংগ্রাম-বিষয়ক প্রস্তাবনা তৈরিতে লেনিন ও এম এন রায়ের মতভিন্নতা। দুজনের মধ্যে কে বেশি প্রজ্ঞাবান ও সঠিক—সেসব নিয়ে পরে অনেক বিতর্ক হয়েছে, বিতর্কে লেনিন-অনুসারীদের জয় হয়েছে সর্বদা; কেননা, রাষ্ট্রশক্তি ও আন্তর্জাতিক পার্টিশক্তি ছিল লেনিনীয় অবস্থানের পেছনে। কিন্তু আজ বিপ্লবী উন্মাদনার সেই প্রাথমিক পর্বের দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি, উভয়ে ঔপনিবেশিক জনগণের মুক্তি আন্দোলনের পথানুসন্ধান করেছিলেন দুই পৃথক অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে, দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা থাকলেও মুক্তির আকুতিতে তাঁরা ছিলেন অভিন্ন।
কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজনির্মাণ প্রয়াসে চিন্তার বৈচিত্র্য, দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা ক্রমে চিহ্নিত হলো বিপ্লবের শক্তিহরণকারী হিসেবে। পার্টি হয়ে উঠতে লাগল সর্বশক্তিমান, একদেশদর্শী, এক নেতা-অনুসারী। সমাজের তথা মানুষের ওপর নির্ভরতার বদলে রাষ্ট্রযন্ত্র হয়ে উঠল নিয়ামক, রাষ্ট্রের ওপর প্রভাব দ্বারা পার্টি হয়ে উঠতে চাইল শক্তিমান, যে শক্তি মূলত ছিল পীড়নমূলক। যে স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতি বহন করছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, তার থেকে বহু যোজন দূরে সরে যেতে লাগল সমাজতান্ত্রিক দেশ।
সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর প্রবল চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল মহৎ আদর্শের ধ্বজা উঁচুতে ধরে। রাষ্ট্রের এই দ্বৈত সত্তা, একদিকে মুক্তিবাণী, অন্যদিকে চরম অমানবিকতা, সম্যক অনুধাবন করা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অনুসারীদের পক্ষে হয়ে উঠেছিল কঠিন, তবু উৎপীড়িতের আর্তনাদ বিভিন্নভাবে শ্রুত হচ্ছিল, বিশেষভাবে সাহিত্য-শিল্পের সুবাদে। এমনি এক গ্রন্থ, আকারে কৃশকায়, তবে স্তালিনের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী অসহায় এক সাধারণ নাগরিকের মানবিক বয়ান হিসেবে ষাটের দশকে আলোড়ন তুলেছিল বিশ্বময়। আলেকজান্ডার সলঝেনিৎসিনের ইভান দেনিসোভিয়েচের জীবনের একদিন বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, প্রকাশিত হয়েছিল হুমায়ুন কবীর সম্পাদিত চতুরঙ্গ পত্রিকায়। কিন্তু সমাজতন্ত্রীরা এসব বার্তা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেনি, সোভিয়েত-বিরোধিতার বিশাল পশ্চিমা আয়োজনের আরেক রূপ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল রাষ্ট্রীয় পীড়নের সাহিত্যিক বয়ান।
১৯৬৭ সালে যখন বিপ্লবের পঞ্চাশৎ বার্ষিকী পালনে আমরা সোৎসাহে শরিক হয়েছি, তখনো সংকটের লক্ষণ নানাভাবে ফুটে উঠছিল, তবে সেসব বিবেচনায় নেওয়ার মতো যোগ্য ব্যক্তি বিশেষ ছিল না। ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে জনপ্রতিক্রিয়া রুদ্ররূপ ধারণ করলে সমাজতন্ত্রী সরকারের পক্ষে রাস্তায় নামে সোভিয়েত ট্যাংক ও সৈনিক। এই বাস্তবতা পশ্চিম ইউরোপের কমিউনিস্ট পার্টিতে গভীর আত্মজিজ্ঞাসার জন্ম দেয়, পার্টি পরিত্যাগ করেন বিপুলসংখ্যক সদস্য। পরে চীন-সোভিয়েত বিরোধ বয়ে এনেছিল আরেক অভিঘাত। ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় সমাজতন্ত্রের শক্ত শাসন শিথিল করার উদ্যোগ ক্ষণকালের জন্য নববসন্তের জন্ম দিয়েছিল, যা আবারও দমন করা হয় জবরদস্তিতার সঙ্গে।
অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সামরিক ক্ষমতাবৃদ্ধি সমাজতন্ত্রকে বিশ্বরাজনীতিতে অন্যতম বৃহৎ শক্তিতে রূপান্তর করেছিল। ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল মোচন করে তৃতীয় বিশ্বের জাগরণে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সমর্থন বিশ্ব পটভূমিকায় ইতিবাচক প্রভাব সঞ্চার করেছিল। এই শক্তি বিন্যাসের সুফল বাংলাদেশ ভোগ করেছিল ১৯৭১ সালে, এর জের পড়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধে, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুরে এসে সুভাষ মুখোপাধ্যায় একবার লিখেছিলেন, ‘এই মাটিতে বুনেছি সব আশা।’ ছোট এই কবিতায় তিনি বর্ণনা করেছিলেন গ্রামের পথ, সমবায়ী চাষের বিস্তীর্ণ জমি, নিদাঘের দৃশ্য, সেই ভিত্তিতে উচ্চারণ করেছিলেন অমন রাজনৈতিক বক্তব্য, সাদামাটা কিন্তু গভীরভাবে। এমন আশা দেশে দেশে অনেক মানুষই অর্পণ করেছিল বাস্তব সমাজতন্ত্রের নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রের ওপর। প্রায়শ তা রূপ নিয়েছিল প্রশ্নহীন আনুগত্যে, কেউ রুশ ধারায়, আবার কেউ কেউ চৈনিক অনুসারীরূপে। ১৯৮৯ সালে বার্লিন দেয়াল গুঁড়িয়ে দেওয়া ছিল নাটকীয় ঘটনা, তবে জীবননাট্যের পরবর্তী ঘটনা ছিল আরও অভাবিত, প্রায় যেন হতবুদ্ধিকর। ১৯৯১ সালে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল সোভিয়েত সাম্রাজ্য, বিলুপ্ত হলো সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন, সাম্যের বিশ্ব ব্যবস্থা। এই পতন সমাজতন্ত্রের কিংবা সাম্যের মতাদর্শের নয়, সমাজতন্ত্র নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মত-পথের সমন্বয় করে চলার ব্যর্থতা ইতিহাসের এক পর্যায়ে এমনই পরিণতি লাভ করেছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, সমাজের বিন্যাস ও রাষ্ট্রের রূপ নিয়ে কত সাধনাই না মানবসমাজ করে চলেছে, এর সরল একরৈখিক কোনো রূপ নেই। পার্টি-শাসিত রাষ্ট্রনির্দেশিত পথে চলার ওপর যখন গুরুত্ব আরোপিত হয় সর্বাধিক, তখন আর্তনাদ ধ্বনিত হয় মানুষের জীবনের গভীর থেকে। সেই কণ্ঠ শুনতে পাওয়া একান্ত জরুরি, তত্ত্ব ও বাস্তবের মিলনক্ষেত্র রচনার নানা উপায় অবলম্বন গুরুত্ববহ। ১০০ বছরের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এমনই অনেক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করেছে আমাদের, যত আমরা অভিজ্ঞতাগুলো যাচাই-বাছাই করে শিক্ষণীয় দিকগুলো স্মরণে রাখব, বিশ্বমানবের লক্ষ্মীলাভের প্রয়াস ততই জোরদার হবে।
এরিক হবসবাম, প্রখ্যাত মার্ক্সীয় ইতিহাসবিদ ও তাত্ত্বিক, হাঙ্গেরির জন-উত্থানের পর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পরিত্যাগ করেছিলেন পার্টি, তবে সাম্যের আদর্শ নয়, জীবনসায়াহ্নে উপনীত হয়ে সমাজতন্ত্রের ভগ্নদশা প্রত্যক্ষ করার পর, ৮০ বছরের বিশ্ব অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে দাখিল করেছিলেন জীবনভাষ্য, আ টোয়েনটিথ সেঞ্চুরি লাইফ। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার বাল্যকালে যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছিল সবচেয়ে বিশাল ও সবচেয়ে শক্তিধর, তার বিলীন হয়ে যাওয়া আমি প্রত্যক্ষ করেছি, দেখেছি ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির সম্পূর্ণ বিলুপ্তি। আমি দেখেছি বিভিন্ন পরাক্রমী বিশ্ব শক্তির গৌণ অবস্থানে তলিয়ে যাওয়া, দেখেছি জার্মান সাম্রাজ্য তথা তৃতীয় রাইখের পরিসমাপ্তি, যা হাজার বছর টিকে থাকার সংকল্প মেলে ধরেছিল। আমি দেখেছি চিরকালের জন্য থাকবে এমন প্রত্যাশাসম্পন্ন বিপ্লবী শক্তির অবসান। হালের ‘আমেরিকান শতাব্দী’র অবসান আমি দেখে যেতে পারব না বলেই মনে হয়, তবে এই বাজি নির্দ্বিধায় ধরা যায় যে আমার বইয়ের অনেক পাঠক তা প্রত্যক্ষ করবে।’
অক্টোবর বিপ্লবের সফলতা স্থায়ী রূপ পায়নি বটে, তবে মানুষের মুক্তিসাধনার পথ যে কুসুমাস্তীর্ণ নয়, সেই অভিজ্ঞতার বিশাল ভান্ডার মেলে ধরেছে বিপ্লবের শত বছরের অভিযাত্রা।
ভ্লাদিমির তাতলিনের স্বপ্নের সৌধ বেয়ে মানবের মেঘলোকে পৌঁছে যাওয়ার পথ ছিল সর্পিল ও জটিল, সেই সৌধ কখনো নির্মিত হয়নি, সেই অভিযাত্রাও হয়েছিল পথভ্রষ্ট, তবে সাম্য ও মুক্তির স্বপ্নের কোনো মৃত্যু নেই। সাম্যের চেতনায় মানবিক সমাজনির্মাণ সাধনা অব্যাহত থাকবে নানাভাবে, নানা পথে, এই প্রেরণা মিলতে পারে অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষী অভিজ্ঞতা থেকে, যার সুখপাঠ্য রূপ কোনো পথ দেখাবে না, চাই জটিল জঙ্গম পথপরিক্রমণ, বিপ্লবের পতাকা হাতে, বিপ্লবকে ছাপিয়ে। এখনো কানে বাজে গানের সেই সুর, ‘আমরা চলি অবিরাম’।

যেভাবে এল অক্টোবর বিপ্লব
১৯০৫: ৯ জানুয়ারি (নতুন পঞ্জিকা অনুসারে ২২ জানুয়ারি)। রাশিয়াজুড়ে ধর্মঘট। সেন্ট পিটার্সবুর্গের শ্রমিকদেরও ধর্মঘটে যোগদান। মিছিলে চলল গুলি। দিনটি ইতিহাসে ‘রক্তাক্ত রোববার’ নামে পরিচিত।

১৯১৪: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু।

১৯১৬: লেনিনের সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর বইয়ের প্রকাশ। ‘পুঁজিবাদের অসম বিকাশের জন্য একই সময়ে পৃথিবীর সব দেশে বিপ্লব অসম্ভব’—বললেন লেনিন।

১৯১৭:  ৯ জানুয়ারি (২২ জানুয়ারি) পেত্রোগ্রাদ, মস্কো, বাকু, নিজ নিনভগোরাদে ধর্মঘট।

 ২৩ ফেব্রুয়ারি (৮ মার্চ) আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারীরাও রাস্তায়।

 ২৭ ফেব্রুয়ারি (১২ মার্চ) শ্রমিকদের ওপর গুলি চালাতে পেত্রোগ্রাদের সৈনিকদের অস্বীকৃতি। তাঁরা দাঁড়ালেন শ্রমিকদের পাশে। সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা। জার দ্বিতীয় নিকোলাই পদচ্যুত। এটি ‘ফেব্রুয়ারি বিপ্লব’ বা ‘বুর্জোয়া বিপ্লব’ নামে পরিচিত। এ সময় রাশিয়ায় চলছিল দ্বৈতশাসন—বুর্জোয়া ও শ্রমিক শ্রেণির।

 ১৬ এপ্রিল (২৯ এপ্রিল) রাশিয়ায় লেনিনের প্রত্যাবর্তন। পেত্রোগ্রাদে সাঁজোয়া যানের ওপর দাঁড়িয়ে তাঁর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ডাক।
বুর্জোয়া শ্রেণিকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে সর্বহারাদের ক্ষমতা দখল করতে হবে—সে সময় বলশেভিক পার্টির ভাবনা ছিল এমন। জুলাই মাসের বিক্ষোভের দমন-পীড়নের সময় আবার লেনিনের আত্মগোপন।

 ২১ অক্টোবর (৩ নভেম্বর) আত্মগোপন থেকে লেনিনের আবার প্রত্যাবর্তন, ফিরে এলেন পেত্রোগ্রাদে।

 ২৩ অক্টোবর (৫ নভেম্বর) বলশেভিকদের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক শুরু।

 ২৪ অক্টোবর (৬ নভেম্বর) কেরেনস্কি সরকারের সৈন্যরা বলশেভিকদের রাবোচি পত্রিকা বন্ধ করতে উদ্যত। শ্রমিকদের প্রবল প্রতিরোধ। সেদিনই লেনিন লিখলেন নির্দেশনামা, ‘যেকোনো মূল্যে আজ রাতেই কেরেনস্কি সরকারকে গ্রেপ্তার করতে হবে। দেরি করলে আমরা সব হারাব।’ তখন তিনি স্মোলনিতে থাকেন। সেখান থেকেই দিলেন শীতপ্রাসাদে অবস্থিত কেরেনস্কি সরকারকে উৎখাতের নির্দেশ।

 ২৫ অক্টোবর (৭ নভেম্বর) জয়যুক্ত হলো বিপ্লব। বলশেভিক পার্টি এল ক্ষমতায়।