Thank you for trying Sticky AMP!!

এ পৃথিবী একবার পায় যাঁকে

দ্বিজেন শর্মা

পৃথিবীজুড়ে প্রকৃতি ধ্বংসের যাবতীয় আয়োজন আমাদের শুধু হতাশই করে না, আতঙ্কিতও করে। মন খারাপের এমন দিনগুলোতে খুবই মনে পড়ে শ্রদ্ধেয় দ্বিজেন শর্মাকে। সম্প্রতি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অপরিকল্পিত বৃক্ষ নিধনের বিরুদ্ধে সবাই যখন এককাট্টা, তখন তাঁর প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি অনুভূত হয়। কারণ, উদ্যানটির সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল। মস্কো থেকে ফিরে তিনি যুক্ত হন বাংলাপিডিয়ার কাজে। তখন প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে বেরিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কিছু সময় কাটিয়ে ফিরে যেতেন বাসায়। এ সময় কর্তৃপক্ষের অনুরোধে বিনা পারিশ্রমিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উদ্ভিদগুলোর একটি পরিসংখ্যান তৈরি করে কীভাবে গাছগুলো বাঁচিয়ে ওয়াকওয়ে তৈরি হবে, তার একটি সুচিন্তিত পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। কাজটি ছিল বেশ শ্রমসাধ্য। কিন্তু এমন কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ কাজে একবারও তাঁকে বিরক্ত হতে দেখিনি। আসলে তিনি এমনই অকৃত্রিম এবং নির্মোহ ছিলেন। তাঁর সান্নিধ্যে পৌঁছানোর সব দ্বার ছিল যেমন উন্মুক্ত, তেমনি বেরিয়ে আসার সব পথ ছিল রুদ্ধ। কখনো কখনো তাঁর কাজের পরিধি ছাড়িয়ে অতি মানবিক দ্বিজেন শর্মা হয়ে উঠেছিলেন দেবতুল্য এক মানুষ। কিন্তু ভুল সমাজে, ভুল সময়ে আসা মানুষটি পেলেন না তাঁর কাজের যথার্থ স্বীকৃতি। তাতে কী, এসবে কোনো ভ্রুক্ষেপই ছিল না তাঁর। তিনি জন্মেছিলেন সমাজকে শুধু উজাড় করে দেওয়ার জন্য, পাওয়ার জন্য নয়।

অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা পরিপূর্ণ জীবন পেয়েছিলেন। এই পূর্ণতা তাঁর জীবন ও কর্মকে ঘিরে আবর্তিত। সাহিত্য, বিজ্ঞান, প্রকৃতি, পরিবেশ ও শিক্ষার ক্ষেত্রে চমৎকার এক সম্মিলন ঘটেছে তাঁর সৃজনে। বিশেষত তাঁর প্রতিটি গ্রন্থই একেকটি আকরগ্রন্থসম। বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ ও পরিপূরক হতে পারে, তাঁর রচনায় তা নানাভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি নির্মাণ করেছেন জনবোধ্য এক আশ্চর্য ভাষাশৈলী। রমনা গ্রিনের অপার সৌন্দর্য তাঁকে ঢাকার উদ্ভিদ নিয়ে বই লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। মোটরসাইকেল চালিয়ে সারা ঢাকা শহর ঘুরে বেড়াতেন। কোথায় কী গাছ আছে, কোন গাছ লাগানো হচ্ছে, সেই সন্ধান করতেন। এসব নিয়ে লেখালেখির পাশাপাশি একটি বই লেখার কাজেও মনোনিবেশ করেন। বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৮১ সালে শ্যামলী নিসর্গ নামে এটি প্রকাশিত হয়। শ্যামলী নিসর্গ দেশের বৃক্ষানুরাগীদের প্রকৃতি সমীক্ষা ও লেখার কাজে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। গ্রন্থটিতে প্রতিটি বৃক্ষের বর্ণনায় তিনি তুলে ধরেছেন প্রাসঙ্গিক কবিতার উদ্ধৃতি, গাছপালার আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তিগত অনুভূতি ও উপযোগিতা। বৃক্ষ পরিচিতিমূলক গ্রন্থের ক্ষেত্রে এটি একটি নতুন ধারা, যার প্রবর্তক স্বয়ং দ্বিজেন শর্মা। পরবর্তী সময়ে এই ধারাবাহিকতায় আরও যুক্ত হয়েছে ফুলগুলি যেন কথা, নিসর্গ, নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা, চার্লস্ ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি, ডারউইন: বিগল্-যাত্রীর ভ্রমণকথা, কুরচি তোমার লাগি, হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ড্যালটন হুকার ইত্যাদি বই। প্রকৃতি ও মনের ক্ষত সারাতে এসব বই এখন সবচেয়ে বড় দাওয়াই।

উদ্ভিদবিজ্ঞানে একাডেমিক পাঠের বাইরে যে আরেকটি বিশাল জগৎ আছে, তা আমরা কেবল দ্বিজেন শর্মার লেখা পড়েই জেনেছি। তাঁর এই ভাবনা সত্যিকার অর্থে বিচিত্র ও বহুমুখী। তিনি ছিলেন অনুসন্ধানী লেখক। অন্তর্দৃষ্টি, দূরদর্শিতা ও ভাবনার গভীরতার দিক থেকে তিনি দার্শনিক পর্যায়ের। এ কারণেই তাঁর লেখায় আমরা খুঁজে পাই উপমহাদেশের ঐতিহাসিক উদ্যানচর্চার সূত্র। একই সঙ্গে ব্রিটিশ ভারতের অরণ্যতরুসন্ধানীদের অজানা অধ্যায়ও। রমনা নিসর্গের স্থপতি বিস্মৃতপ্রায় আর এল প্রাউডলক তাঁর লেখাতেই আবার নতুন করে ফিরে আসেন।

প্রায় ছয় দশক আগে প্রকৃতিচর্চা শুরু করেছিলেন তিনি। সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা এই মানুষটি ৫০ বছর আগে যা কিছু ভেবেছেন, যা কিছু লিখেছেন, তা এখনো দারুণভাবে প্রাসঙ্গিক। নিসর্গ, নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা বইয়ের ছোট্ট একটি উদ্ধৃতি থেকে তা আরও স্পষ্ট হবে, ‘তরুনির্ভরতা নিয়তিকল্প বলেই হয়তো প্রকৃতির এই অনুষঙ্গ এতটা মুগ্ধকর। সভ্যতার অগ্রগতি মানুষের স্বাধীনতা বহুদূর প্রসারিত করলেও প্রকৃতির আওতা থেকে পূর্ণমুক্তির দিন আজও অস্পষ্ট।’ তাঁর এই বক্তব্য চিরকালীন। প্রকৃতির বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব ভাবা যায় কি? প্রায় ৩০ বছর আগে দ্বিজেন শর্মা বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর গভীরতর অসুখ’। পৃথিবীজুড়ে আজ যে মহাদুর্যোগ, মানবজাতি কি তার দায় এড়াতে পারে? প্রকৃতি ধ্বংসের এই মহোৎসব সহস্র বছর ধরেই চলমান। তাঁর লেখায় এসব হাহাকার বারবার ধ্বনিত হয়েছে,Ñ‘যত দূর যাই বালুঘড়ির চেহারাটা ক্রমেই স্পষ্টতর হতে থাকে। পাহাড়ের শ্যামল আঙরাখা বড়ই ছেঁড়াখোঁড়া। কোথাও সামান্যতম রিফুকর্মের চিহ্ন নেই। ফসলি মাঠে পুকুর কেটে বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে। কৈশোরের দেখা বনঘন টিলাগুলো এখন কচ্ছপের পিঠের মতো চাঁছাছোলা। নেওয়ার ইচ্ছা আগ্রাসী, দেওয়ার সামান্যতম সদিচ্ছাও অনুপস্থিত।’

১৯২৯ সালের ২৯ মে জন্ম এই মনীষীর। জন্মদিনে এই সমাজচিন্তক মনীষাকে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। প্রকৃতিকে আপন ছন্দে ফিরিয়ে আনতে তাঁর হীরকখচিত অনন্য সৃষ্টিসম্ভারে আমাদের আরও গভীর অভিনিবেশ প্রয়োজন। তাঁর জীবনাদর্শ পাথেয় হোক আমাদের।