Thank you for trying Sticky AMP!!

কাফকার গোলকধাঁধার জগতে

ফ্রানৎ কাফকা (৩ জুলাই ১৮৮৩—৩ জুন ১৯২৪)
>

সাহিত্যের পাঠকদের কাছে প্রাগ শহরটি পরিচিত বিশ্বখ্যাত কথাসাহিত্যিক ফ্রানৎস কাফকার শহর হিসেবে। দিন কয়েক আগে চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগে গিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। কাফকা শহর ঘুরে তাঁর জগতের গোলকধাঁধায় আলো ফেলেছেন তিনি।

প্রাগে যাচ্ছি! কাফকার প্রাগ! কাফকার প্রাগ কথাটা আশ্চর্য নয় কি? বর্তমান চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগ তো কত কোটি মানুষকেই তার হাজার বছরের ইতিহাসে জন্ম দিয়েছে; কিন্তু আমাদের কাছে প্রাগ বলতেই চলে আসে ফ্রানৎস কাফকারই নাম!

‘প্রাগে যে যাচ্ছ, তোমার পরিচিত কে কে আছেন?’—এই প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব তিনজনের নাম—কবি মিরোস্লাভ হোলুব, কথাসাহিত্যিক ফ্রানৎস কাফকা ও মিলান কুন্ডেরা। প্রাগে জন্ম নেওয়া এই তিন সাহিত্যিক আমার পরিচিত। আমার স্বজন। লেখকদের এখানে একটা জিত আছে; লেখকেরা পাঠকের টেবিলে থাকেন, শিয়রে বালিশের কাছে থাকেন; আর পাঠকের কাছে তাঁর প্রিয় লেখকেরা হয়ে ওঠেন একান্ত আপনজন।

১২ এপ্রিল ২০১৯। দুপুরবেলা এমিরেটসের বিমানখানা যখন দুবাই থেকে গিয়ে স্পর্শ করল প্রাগের রানওয়ে, সে সময় আমি কেবল তিন পরিচিত লেখকের সঙ্গে আমার পূর্বপরিচয়ের রেশ নিয়ে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে বাটা বাংলাদেশের মার্কেটিং প্রধান ইফতেখার মল্লিক। তরুণ এই ভদ্রলোক দারুণ এক চরিত্র, দর্শন ও সাহিত্যের মনোযোগী পাঠক; মিশেল ফুকো কিংবা আহমদ ছফা তাঁর নিয়মিত পাঠ্য। আমার মতো তাত্ত্বিকতাবিরোধী সৃজনশীল লেখক, যাঁদেরকে ইন্টেলকচুয়ালরা হালকা লেখক বা অপন্যাসিক বলে জ্ঞান করেন বলে শঙ্কা করি, তাঁকেও তিনি আগ্রহের সঙ্গে আপন করে নিলেন। আমিও সুযোগ পাওয়ামাত্রই তাঁর কাছ থেকে নিচ্ছিলাম দর্শনের ভ্রাম্যমাণ পাঠ।

কাফকা মিউজিয়ামের এক পাশে শোভা পায় বিশাল আকার ‘কে’। ইংরেজির কে। কাফকার কে। ট্রায়াল কিংবা ক্যাসলের কে। ছবি: লেখক

তো, আমরা দুই বাঙাল প্রাগের বিমানবন্দরে নেমেই পড়ে গেলাম কাফকার গোলকধাঁধায়। সবার মতো আমরাও নেমেছি বিমান থেকে। তারপর সামনের যাত্রীদের অনুসরণ করে হাঁটছি, গড্ডলপ্রবাহে। সামনের যাত্রীরা বামে মোড় নিলেন। আমরাও মোড় নিলাম বামে। এখানে দেখা যাচ্ছে সিকিউরিটি চেক! বিমানযাত্রায় আমার সবচেয়ে অপ্রিয় পর্ব। ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করো, কোমরবন্ধনী খোলো, জুতা খুলে এই ট্রেতে রাখো, এরপরও পকেটে খুচরা পয়সা রয়ে গেল তো ধরা। দুই দফায় ১৩ ঘণ্টা উড়াল শেষে এর চেয়ে বিরক্তিকর পর্ব আর কিছুই হতে পারে না। আমরা দুজন লাইনে দাঁড়িয়ে সিকিউরিটির বৈতরণি পার হয়ে পৌঁছালাম অপর পাড়ে। আধা ঘণ্টার বেশি সময় লাগল এতে। তারপর দেখি, বের হওয়ার জায়গা নেই। এটা আসলে বিমানে ওঠার একটা গেট। যাঁরা ভেতরে আছেন, তাঁরা কোনো একটা বিমানে চড়ে ডিপার্চার পর্ব সারবেন। সিকিউরিটির লোকদের বললাম, ভুল হয়ে গেছে। আমরা তো অ্যারাইভালের যাত্রী। ওরা বলল, বেরিয়ে যাও, কোনো অসুবিধা নেই।

বেরিয়ে গেলাম। মনে মনে বললাম, ওয়েলকাম টু দ্য ওয়ার্ল্ড অব কাফকা।

প্রিয় বিদগ্ধ পাঠক, আপনাদের বলে দেওয়ার দরকার পড়বে না, ফ্রানৎস কাফকার (১৮৮৩–১৯২৪) জগতে আসলে এ রকমই ঘটে। তিনি কাফকা, সম্ভবত বিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখক। আমার ফাঁদ উপন্যাসের নায়কের নাম ‘ম’। সে একটা দশতলার ছাদ থেকে পড়ে যেতে শুরু করে। আমার মনে পড়ে, ১৯৯৭ সালে যখন উপন্যাসটি বইমেলায় বের হয়, খোন্দকার আশরাফ হোসেন—কবি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক—বইমেলায় আমার বইটা হাতে নিয়ে প্রথম অনুচ্ছেদ পড়েই বলেছিলেন, ‘কাফকায়েস্ক’। তখন শুকনো হাসি হেসে সম্মতি দেওয়া ছাড়া আমার আর কোনো গত্যন্তর ছিল না।

কাফকার বইয়ের বিভিন্ন সংস্করণের প্রচ্ছদও আছে মিউজিয়ামে

ওই সময় কাফকা পড়ছি। আর পড়ছি আরেক চেক লেখক মিলান কুন্ডেরা।কুন্ডেরা বলছেন, কাফকাকে ব্যাখ্যা করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো কাফকার গুপ্তসংকেত উদ্ধারের চেষ্টা না করা। আর পড়ছি জাঁ পল সার্ত্রে। অস্তিত্ববাদীদের ঘোরের মধ্যে পাক খাচ্ছি। কাজেই ফাঁদ দুই লাইন পড়ামাত্র খোন্দকার আশরাফ যদি কাফকায়েস্ক বলে শনাক্ত করে থাকেন, অস্বীকৃতি জানাই কী করে!

বাংলাদেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে কত দিন কাফকার দ্বারস্থ হয়েছি গদ্যকার্টুনের মতো হালকা কলামেও। কাফকার সবচেয়ে যুগান্তকারী লেখা অবশ্যই মেটামরফোসিস। আমাদের আরেক প্রিয় লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বলেন, প্রথম যেদিন তিনি মেটামরফসিস-এর প্রথম লাইনটা পড়েন—‘একদিন সকালবেলা অস্বস্তিকর স্বপ্ন থেকে জেগে গ্রেগর সামসা দেখল যে সে পরিণত হয়েছে এক বিশাল পোকায়’—তিনি চমকে লাফিয়ে উঠেছিলেন। আমাদেরও কি এ রকম মনে হয় না যে আমরা পরিণত হয়েছি বিশাল পোকায়, আমাদের পিঠ মেঝেতে, পা ওপরের দিকে; সোজা হয়ে আর দাঁড়াতে পারছি না আমরা। কিংবা ধরা যাক, কাফকার ট্রায়াল উপন্যাসের কথা। জোসেফ কে। তার ঘরে এসে ঢুকে পড়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। এরপর জোসেফ কে বিচারপদ্ধতির মধ্যে ঢুঁড়ে মরছে, খুঁজে মরছে, তার অপরাধটা কী? কেন তাকে ধরা হয়েছে? তার বিরুদ্ধে অভিযোগটাই–বা কী?

মিলান কুন্ডেরা তাঁর প্রবন্ধে ট্রায়াল নিয়ে আরেক নিষ্ঠুর মজার কাহিনি বলবেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রাগ দখল করেছে। বহু মানুষকে কারণ ছাড়া ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যেমন করা হয় মিলান কুন্ডেরার দ্য জোক উপন্যাসে। তো, একজনকে ধরা হয়েছে, জেলে রাখা হয়েছে, তিনি কমিউনিজমে বিশ্বাস করতেন; এবং বিনাবিচারে জেলে আটক থেকেও যিনি কমিউনিজমের প্রতি আস্থা হারাননি। তিনি বলেন, আমি যদি কমিউনিজমে আস্থা রাখি, তাহলে আমি যে জেলে আছি, তার একটা কারণ দাঁড়ায়। আমি একটা সান্ত্বনা পাই। কিন্তু যদি আমি কমিউনিজমে আস্থা হারিয়ে ফেলি, তবে তো আর আমার জেলে থাকার কোনো কারণ থাকে না। মিলান কুন্ডেরা বলেন, তাহলে ওই ভদ্রলোকের অবস্থা দাঁড়ায় কাফকার জোসেফ কে-এর মতো। সে কেন আটক আছে, সে জানে না। এ এক দুর্বিষহ অবস্থা, যেখানে অভিযোগকারী অভিযোগ খুঁজে বেড়ায় না, অভিযুক্তকে খুঁজতে হয় যে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগটা আসলে কী!

কাফকার আরেক উপন্যাস ক্যাসল। তাতে আমরা দেখতে পাই, এক ভূমি জরিপকারী গিয়েছে এক জনপদে, তার নাম কে। এক সরাইখানায় সে উঠেছে, রাতের বেলা জনপদের কর্তার ছেলে এসে তাকে ধরে বসে, তুমি কেন অনুমতি ছাড়া এ সরাইখানায় উঠেছ।

কাফকার জগৎ হলো এমনি অব্যাখ্যাত গোলকধাঁধার জগৎ। তাই আমরা, দুই বাঙাল—আমি আর ইফতেখার—দুজনে যে প্রাগে নেমে অহেতুক চক্কর খাব, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

আধা ঘণ্টা লাগল ইমিগ্রেশন পেরোতে। বেরিয়ে লাগেজ নিতে না নিতেই বাটার লাল রঙের ইউনিফর্ম পরা কর্মীরা স্বাগত জানালেন আমাদের। ভ্যানে করে এসে পৌঁছা গেল হোটেল ম্যান্ডারিন ওরিয়েন্টালে। ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে বিকেল।

আমাদের এখনকার কর্মসূচি হলো, পায়ে হেঁটে প্রাগ শহর পরিদর্শন।

ফ্রানৎস কাফকার আঁকা ছবি স্থান পেয়েছে মিউজিয়ামের ভেতরে

আমাদের গাইডের নাম স্তেফান। তার পেছনে জনাদশেক উপমহাদেশীয়, যাঁরা বাটার আমন্ত্রণে এসেছেন প্রাগে, উঠেছেন ম্যান্ডারিনে। পদব্রজে চললাম শহর দেখতে। ভীষণ শীত। দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস। পশ্চিমের শীতের বিরুদ্ধে আমার প্রস্তুতি শরৎচন্দ্রের নতুনদার মতোই, হাতে দস্তানা, গলায় গলাবন্ধ, পরনে লাল জ্যাকেট। শুধু মাথার মাংকিটুপিটা নিইনি বলে পরে আফসোস করেছি। কিন্তু ইফতেখার একটা শার্টের ওপর একটা সামার জ্যাকেট পরে কীভাবে এই হিমযাত্রা সারতে পারলেন, সে ধন্দ আমার যায় না।

প্রাগ শহরের ভালো দিক হলো, হাঁটার দূরত্বে সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। জন লেননের ছবি আঁকা দেয়াল, ৬৬৭ বছরের পুরোনো চার্লস ব্রিজ, ক্যাথিড্রাল, স্ট্রিটশপ, দুর্গ, প্রাসাদ—সব। আমরা হাঁটছি, স্তেফান বকবক করছে। আমরা চার্লস ব্রিজে উঠি। নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ভ্লাতাভা নদী। ১৩৫৭ খ্রিস্টাব্দে এই ব্রিজের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ব্রিজের সঙ্গে টাওয়ার। সব দেখে আমি হাঁ। বলি, এ তো একটা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ান্ডার। এত বছর আগে, রড–সিমেন্ট নেই, কীভাবে এরা এই সেতু বানাল! প্রাগে যে ভবনের দিকে তাকাই, তার বয়স কম করে হাজার বছর।

চার্লস ব্রিজে দাঁড়িয়ে দুই পাশের অপার সৌন্দর্য দেখি, ঠান্ডায় কাঁপি, আর দেখি নদীর বয়ে চলা, ওই যে প্রাগের আকাশরেখা; মিনারে, চূড়ায়, গথিক স্থাপনায় শেষ বিকেলের রোদ পড়েছে, দূরে মিউজিয়াম কিংবা প্রেসিডেন্ট হাউস অথবা ক্যাথিড্রালের চূড়ায় ঝকমক করছে সোনার স্তর।

স্তেফানকে বলেছিলাম, স্তেফান, তুমি আমাদের কাফকা মিউজিয়ামে নিয়ে যাচ্ছ তো?

স্তেফান বলেছিল, না।

এখন সেতুর ওপরে দাঁড়িয়ে, গিজগিজ করছে পর্যটক, ভিখিরিরা সেতুর ওপরে মূর্তি সেজে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছে, চিত্রকরেরা মুখচ্ছবি এঁকে দিচ্ছে।

স্তেফান আমাকে বলল, ওই যে দেখছ, নদীর ধারে তাঁবুর মতো টাঙানো, ওটাই তোমার কাফকা মিউজিয়াম। এখান থেকে হেঁটে গেলে সাত মিনিট। ইফতেখারকে বললাম, ইফতেখার, কাল এটাই হবে আমাদের প্রধান গন্তব্য।

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে শীতে কাঁপতে কাঁপতে আমরা খেলাম হটডগ; আর কোনের মধ্যে দেওয়া ক্রিম কিংবা চকলেট। পয়সা দিলেন আমাদের দক্ষিণ ভারতীয় বন্ধুরা। আমার নিজের কাছে ছিল না ওই দেশি টাকা—চেক ক্রাউন। ইফতেখারের কাছে ইউরো ছিল, কিন্তু বিক্রেতার কাছে ভাংতি ছিল না। কাজেই ভারতীয় বন্ধুদের আপ্যায়নে প্রীত বোধ করলাম।

১৩ এপ্রিল ২০১৯। সকালটা কাটল জোফিন প্রাসাদে, বাটার ১২৫ বছরের ফ্যাশন শোতে। দুপুরের শাটল সার্ভিস আমাদের নামিয়ে দিল হোটেল। আমরা দুই বাঙাল এবার বেরোলাম নিজের দায়িত্বে। হাতে নিলাম ম্যাপ। হোটেল থেকে কাফকা মিউজিয়ামটা মানচিত্রের ওপরে মসিচিহ্নিত করে নিলাম। গুগল করে বাটার কর্মীরা জানালেন, আট মিনিট লাগবে হেঁটে যেতে।

ম্যাপ ধরে প্রথমে গেলাম চার্লস ব্রিজের কাছে। তারপর চললাম কাফকা মিউজিয়ামের সন্ধানে। প্রথমে পড়ল ‘শেক্‌সপিয়ার’, একটা বইয়ের দোকান। দোকানের তরুণী বিক্রেতাকে বললাম, কাফকা মিউজিয়াম কোথায়? দোকান থেকে বেরিয়ে তর্জনী নির্দেশ করলেন তিনি, এই যে পিংক বিল্ডিংটা দেখছ, ওটা।

অতঃপর আমরা গেলাম আমাদের অভীষ্টে—কাফকা মিউজিয়ামে।

মিউজিয়ামের সামনের উঠানে রাখা আছে বিখ্যাত মূত্রত্যাগকারী ভাস্কর্য

একটা ‘সি’ বা ‘৩’ আকারের নাতি-উচ্চভবন। নদীর ধারের অংশটা মিউজিয়ামের গ্যালারি। সি-এর খোলা পেটে উঠান, সেখানে রাখা বিখ্যাত মূত্রত্যাগকারী ভাস্কর্য। কাচের তৈরি দুই পুরুষ সারাক্ষণ মূত্রবিয়োগ করছে। তার একপাশে বিশাল আকার ‘কে’। ইংরেজির কে। কাফকার কে। ট্রায়াল কিংবা ক্যাসল-এর কে।

আরেক পাশে সুভেনির শপ। সেখানেই বিক্রি হচ্ছে টিকিট। টিকিটের দাম ২০০ ক্রাউন। আমাদের টাকায় ৮০০। আমি বললাম, আমি সাংবাদিক। নারী বিক্রেতা বললেন, সাংবাদিকের জন্য ফ্রি। ইফতেখার মুখটা এমন করলেন, যেন সাংবাদিক না হয়ে তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছেন।

 টিকিট কেটে আমরা ঢুকলাম জাদুঘরে। প্রথমে একটা কাঠের সিঁড়ি। তারপর পুরোটাই কালো। কালো দেয়ালে কাফকার বিভিন্ন বয়সের ফটো। তাঁর বাড়ির ছবি। তাঁর বাবার ছবি। ম্যাক্স ব্রডের ছবি। ম্যাক্স ব্রড ছিলেন কাফকার বন্ধু। কাফকা নিজের লেখা পাণ্ডুলিপি এই বন্ধুর হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর এ পাণ্ডুলিপি যেন পুড়িয়ে ফেলা হয়। ব্রড শোনেননি সে কথা। আমরা তাই পেয়েছি কাফকার লেখাগুলো। আর পৃথিবী পেয়েছে প্রভাবশালী একজন বিশ শতকীয় লেখককে।

পিতার সঙ্গে কাফকার সম্পর্ক ছিল আনুষ্ঠানিক। পিতাকে তিনি অনেক চিঠি লিখেছিলেন। চিঠি লিখেছিলেন প্রেমিকা মিলেনাকে। সেসব থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া আছে মিউজিয়ামের দেয়ালে। আছে কাফকার আঁকা ছবি, পাণ্ডুলিপি এবং বইয়ের নানা সংস্করণ। কাফকা মারা গিয়েছিলেন ৪১ বছর বয়সে, যক্ষ্মায় ভুগে। কাফকা বলেছিলেন, আমাকে অবশ্যই লিখতে হবে, তা নাহলে মারা যেতে হবে। তিনি বলতেন, কলম লেখকের কোনো হাতিয়ার নয়, শরীরের একটা অঙ্গ। কিন্তু মাত্র ৪১ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে যা লিখেছিলেন, সেসবকেও পুড়িয়ে ফেলতে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন।

সব মিলিয়ে খুব বেশি কিছু নেই। কিন্তু সবকিছু সাজানো হয়েছে কাফকায়েস্ক কায়দায়। গোলকধাঁধার মতো করে। সাজানোটাই এই মিউজিয়ামের আসল দিক।

পূর্ণকালীন লেখক হতে চেয়েছিলেন কাফকা। পারেননি। জার্মান স্কুলে পড়ে ইনস্যুরেন্স কোম্পানির অফিসার হয়েছিলেন তিনি। চাকরি তাঁকে পীড়া দিত। পীড়া দিত তাঁর ক্ষীণ স্বাস্থ্য, অসুখী প্রেম। এসব বলে তাঁর উপন্যাসের এই উদ্ভট আইডিয়াগুলোকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়, ব্যাখ্যা করা হয় পুঁজিবাদী সমাজের বিচ্ছিন্নতার বোধ হিসেবেও, কিন্তু কুন্ডেরা যেমনটা বলেন, কাফকাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা না করাই ভালো।

কিংবা মানি মিরোস্লাভ হোলুবের কবিতার মর্ম: শিল্পী হওয়া মানেই ব্যর্থ হওয়া আর শিল্পমাত্রই ব্যর্থতার বশংবদ, যেমনটা বলেছেন স্যামুয়েল বেকেট: কবিতা তবু মানুষের শেষ কাজগুলোর নয়, প্রথম কাজগুলোর একটা।

কাফকা মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে আসি। সুভেনির কিনি। দাম দিতে আবার লাইনে দাঁড়াই। লাইন শেষ হলে নারী বিক্রেতাটি বলেন, এটা টিকিটের কাউন্টার, ওই লাইনে দাঁড়াও। উফ! এ যে কাফকার ধাঁধা। কে-এর সামনে ছবি তুলি। আর ‘শেক্‌সপিয়ার’ নামের বইয়ের দোকানে এসে কিনি বই। বিক্রেতা তরুণীটির দাঁতের সারি এত সুন্দর যে তার হাসি যেন ফাঁদে ফেলতে চায়।

দাম দিয়ে বেরিয়ে আবারও ফিরে তাকাই। কাফকার দেশে এসে ফাঁদে পড়তে চাই না। চার্লস ব্রিজ পেরিয়ে আবারও হাঁটি দুজনে। পুরো পুরোনো শহর চষা শেষ করে বুঝি, পথ হারিয়ে ফেলেছি। এবার ফিরব কী করে?

ট্যাক্সি ডাকি! ১৫ মিনিটের পায়ে হাঁটা পথের দূরত্ব থেকে গাড়িতে ফিরতে লাগে এক ঘণ্টা। ধাঁধা নয় তো কি!