আজ শিল্পী কালিদাস কর্মকারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধা।
বাংলাদেশের সত্তর দশকের যে কজন শিল্পী নিজস্ব শৈল্পিক গুণ প্রদর্শন করেছেন, তাঁদের অন্যতম সফল শিল্পী কালিদাস কর্মকার। স্বতন্ত্রধারার সাহসী চিত্রশিল্পীকে বলা হয় ‘পাললিক বাংলা শিল্পের রূপকার’। প্রতিথযশা এই গুণী শিল্পী নিরীক্ষাধর্মী কাজের জন্য বিখ্যাত। বিমূর্ত চিত্রকলা যাঁর ক্যানভাসে তৈরি হয়েছে দেশীয় আবার কখনো আন্তর্জাতিক রূপরেখায়।
দেশ ও দেশের বাইরে কালিদাস কর্মকারের একক চিত্র প্রদর্শনীর সংখ্যা ৭২টি। চারুকলায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি একুশে পদক, শিল্পকলা পদকসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
জীবনের শেষ দিকের অনেকটা সময় বিদেশে কাটানোর পরও নিজের দেশমাতৃকার প্রতি তাঁর যে ভালোবাসা, আত্মার বন্ধন, তা আমরা তাঁর কাজে, চিন্তায়, শিল্পকর্মের প্রকাশে বারবার খুঁজে পাই। ‘পাললিক প্রাণ, মাটি ও প্রতীক’ শিরোনামে তাঁর একক প্রদর্শনী এরই সাক্ষ্য বহন করে। এই শিল্পী মাটিকে রূপ দিয়েছেন অনন্য, ভিন্নমাত্রায়।
২.
ব্যক্তি কালিদাস কর্মকারকে আমরা সবাই চিনি ‘কালিদা’ হিসেবে। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ২০১৬ সালে। অল্প সময়ের বন্ধুত্ব আমাদের। এত গুণী, এতটা তারুণ্যের প্রাণোদ্যমে ভরা ব্যক্তি কালিদা, যাঁকে খুব কাছ থেকে, কলকাতা ও ঢাকার রাস্তায়, অলিগলিতে হাঁটতে হাঁটতে চেনার ও জানার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
তিনি বলতেন, ‘শিল্প, শিল্পের উপাদান আমাদের চারপাশে অজস্র, আমাদের শুধু খুঁজে বের করতে হবে।’ একটি শুকনা পাতা, টাইলস, কাদামাটি, ভাঙা-পড়ে থাকা নষ্ট বা ফেলে দেওয়া জিনিসও যে আর্টের উপকরণ হতে পারে, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের বোধের, জানার, বোঝার, উপভোগের জায়গায় পৌঁছাতে পারে, তা মানুষটির সঙ্গে দুই পা না হাঁটলে আমার জানার বৃত্তের বাইরে থেকে যেত।
কালিদাসের কাজে এবং রঙের ব্যবহারে, এমনকি তাঁর পরিধেয় বস্ত্রে যে রংটি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে, সেটি লাল। লাল অপরিসীম, সীমাহীন শক্তির জ্বলজ্বলে প্রতীক হিসেবে কাজ করে বলে মনে করতেন তিনি। এ নিয়ে শান্তিনিকেতনে কোনো এক পৌষ মেলায় দাদার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তাঁর লাল রঙের প্রতি তাঁর পক্ষপাতের কারণ কী? উত্তরে তিনি বলেন, ‘ভালো লাগা বা ভালোবাসা যেমন নির্দিষ্ট কোনো কারণে হয় না, পথ চলতে চলতে যেমন আমাদের ভালো লাগা বা ভালোবাসা তৈরি হয়, লালের প্রতি আমার ভালোবাসাটাও ঠিক তেমন। তোমাদের মতো তরুণ–তাজা প্রাণের এক বিশাল এনার্জি যেন এই লাল রঙে আছে। আর আমিও তোমাদের মতো তরুণ থাকতে চাই মনেপ্রাণে, যত দিন বাঁচি।’
আমাদের প্রজন্ম, আমরা অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। কালিদা বলতেন, ‘মানুষের আসল ক্যামেরা, যেটি আমাদের মগজের মধ্যে শক্ত অবস্থান নিয়ে বসে আছে, তা যেন আমরা ভুলে না যাই। একজন শিশু যখন ছবি আঁকে, তার ছবিতে আমরা পেলবতা খুঁজে পাই, কোথাও গিয়ে একটা শান্তি, মনের আরাম কাজ করে। একজন শিল্পীরও মাঝেমধ্যে নিজেকে আরাম দেওয়া উচিত, মনকে অক্সিজেন নেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত, যাতে আমাদের মনন-চিন্তন মুক্ত বাতাস নেওয়ার সুযোগ পায়।’
আজ কালিদাস কর্মকারের মৃত্যুদিনে মনে পড়ছে তাঁকে, তাঁর কথাগুলো। শারীরিকভাবে তিনি এখন না থাকলেও প্রবলভাবে হাজির আছেন তাঁর কাজের মাধ্যমে। এই গুণী শিল্পীর প্রথম প্রয়াণবার্ষিকীতে রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com