Thank you for trying Sticky AMP!!

ক্র্যাক আন্তর্জাতিক আর্ট ক্যাম্প: শিল্প যেখানে মানুষের, মননের

ঢাকা-কুষ্টিয়া হাইওয়ের পাশে কুষ্টিয়ার রহিমপুরের স্মরণ মৎস্য খামারে প্রতিবছর ২৫ থেকে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ক্র্যাক আন্তর্জাতিক আর্ট ক্যাম্প। ছবি: সংগৃহীত

একমাত্র সনদধারী মানুষই শিল্পের আলোচনা করবে, শিল্প নির্মাণ করবে, এ ধারণা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এখন প্রতিষ্ঠানের বাইরের শিল্পচর্চা এবং শিল্পকেন্দ্রিক বিভিন্ন উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছে মানুষ। চারুকলার পেশাগত মানুষ নিয়ে প্রথাগত আর্ট ক্যাম্প আয়োজনের যে নাগরিক ধারা, তাকে পাশ কাটিয়ে কুষ্টিয়ায় একটি আন্তর্জাতিক আর্ট ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে ১৩ বছর ধরে। মেট্রো পলিশ জৌলুশ, ইজমের বাদানুবাদ, মুনশিয়ানার দাপট ইত্যাদি ছাপিয়ে বাঙালির সহজিয়া দর্শনের এক যৌথ মিথস্ক্রিয়ার সন্ধান মেলে এখানে।

কুষ্টিয়া শহরের অদূরে স্মরণ মৎস্য বীজ খামারে ১৩ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে চলা এই আর্ট ক্যাম্পের নাম ‘ক্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল আর্ট ক্যাম্প’। শিল্পভাবনা প্রকাশের নতুন পথ সন্ধানের উদ্দেশ্য সামনে রেখে ২০০৭ সাল থেকে যাত্রা শুরু করে এই আর্ট ক্যাম্প। শুরু থেকে এই আর্ট ক্যাম্প জ্ঞানকাণ্ডের বিভিন্ন শাখার মানুষের জন্য উন্মুক্ত। সে কারণে এখানে চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী, গবেষক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকর্মী, ফটোগ্রাফার, নাট্যকর্মী, কবি, বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষসহ শিল্প এ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিচরণকারী গুণীজনের অংশগ্রহণের পথ খুলে দেওয়া হয়। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসের ২৫ থেকে ৩০ তারিখ ক্যাম্পটি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

২০১৬ সালের একটি ইনস্টলেশন আর্ট। ছবি: সংগৃহীত

যেভাবে শুরু
২০০৭ সালে শিল্পী ও গবেষক শাওন আকন্দ এবং কুষ্টিয়ার শিল্পী দেলোয়ার হোসেন ক্র্যাক আর্ট ক্যাম্প গঠনের উদ্যোগ নেন। শাওন আকন্দ জানান, কুষ্টিয়া অঞ্চলের চারুকলার ইতিহাস বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ১৯৭০ দশকের শিল্পী দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁর। সে সময় দেলোয়ার হোসেন শিল্পচর্চা ছেড়ে নিজের খামারে কৃষিকাজে মনোযোগী ছিলেন। কুষ্টিয়ার রহিমপুরে স্মরণ মৎস্য বীজ খামারের বিস্তীর্ণ জায়গাকে কাজে লাগিয়ে একটি আর্ট ক্যাম্প করার প্রস্তাব দিলে দেলোয়ার হোসেন তাতে সম্মত হন। প্রথম থেকে এই আর্ট ক্যাম্প পরিচালনার ক্ষেত্রে কাজে লাগানো হয় বাউল সম্প্রদায়ের স্বতঃস্ফূর্ত ধারায় গড়ে ওঠা সাধুসঙ্গের ধারণাকে। সে বছরই মৎস্য খামারের পুরো জায়গাকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পী এবং অন্যান্য পেশার মানুষ নিয়ে প্রথম আর্ট ক্যাম্পটি আয়োজন করা হয়। পরের বছরও একই পদ্ধতিতে ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৯ সাল থেকে এটি আন্তর্জাতিক রূপ পায়। ২০০৭ সালের পর খামারের জায়গাটি কৃষিকাজের পাশাপাশি শিল্পী এবং বাউল, বলাহারি ও সহজিয়া সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেন দেলোয়ার হোসেন।

ক্র্যাক আন্তর্জাতিক আর্ট ক্যাম্পের উদ্যোক্তা শিল্পী ও গবেষক শাওন আকন্দ এবং দেলোয়ার হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

ক্র্যাক আর্ট ক্যাম্প গড়ে ওঠার মূল ধারণা সাধুসঙ্গ। সে কারণে এই আর্ট ক্যাম্পে কাউকে কোনো পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না, এখানে কোনো নিবন্ধন ফিও নেই। এই ক্যাম্প পরিচালনার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেওয়া হয় না আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা। কনক আদিত্য, রাহুল আনন্দসহ ক্র্যাক ট্রাস্টের অন্যান্য ট্রাস্টি এবং অল্প কিছু শুভানুধ্যায়ীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ১৩ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে ক্র্যাক আন্তর্জাতিক আর্ট ক্যাম্প। দেশ–বিদেশ থেকে শিল্পীরা এখানে নিজেদের খরচে আসেন, এখানে সবাই একসঙ্গে থাকেন, খান, ঘুমান এবং কাজ করেন। শাওন আকন্দ জানান, এই আর্ট ক্যাম্পে শিল্প নির্মাণের চেয়ে যে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তা হলো ভাববিনিময়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে বাংলাদেশের শিল্পীদের কিংবা বাংলাদেশের শিল্পীদের সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শিল্পীদের ভাববিনিময়, তথ্য ও কৃৎকৌশলের ধরন আদান–প্রদান, দার্শনিক চিন্তাভাবনার প্রসার ঘটানোই এই আর্ট ক্যাম্পের মূল কাজ বলে মনে করেন শাওন আকন্দ।

একটি শিল্পকর্ম। ছবি: সংগৃহীত

এই আর্ট ক্যাম্পের প্রথম দিন শিল্পীদের পুরো কুষ্টিয়া শহর, সেখানকার সংস্কৃতি, মানুষ ও সমাজ সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়া হয়। তারপর তাঁদের ঘুরিয়ে দেখানো হয় লালন আখড়া, রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি ও অন্যান্য দর্শনীয় স্থান। এরপর শিল্পীরা নির্দিষ্ট থিমের ওপরে নিজেদের শিল্পকর্ম নির্মাণ শুরু করেন। আর্ট ক্যাম্পটির শেষ দিন এটি সব শ্রেণির দর্শকের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

প্রথম দুই বছর আয়োজনের পর ২০০৯ ও ২০১০ সালে ‘সেন্টার ফর রিসার্চ অন আর্ট অ্যান্ড কালচার’ (সিআরএসি) নামে একটি প্রতিষ্ঠান এই আর্ট ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে। পরে ২০১১ সালে সিআরএসি তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিলে ক্র্যাক ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই ট্রাস্ট এখন প্রতিবছর আর্ট ক্যাম্পটি পরিচালনা করছে। ইতিমধ্যে এই ক্যাম্পে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ইরান, আফগানিস্তান, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া ও গ্রিস থেকে তিন শতাধিক শিল্পী অংশগ্রহণ করেছেন এবং তাঁদের শিল্পকর্ম প্রদর্শন করেছেন।

দেশি-বিদেশি শিল্পীদের চিন্তাভাবনা বিনিময় ক্র্যাক আন্তর্জাতিক আর্ট ক্যাম্পের মূল উদ্দেশ্য। ছবি: সংগৃহীত

শিল্পকর্ম ও শিল্প উপকরণ
ক্র্যাক আর্ট ক্যাম্পের প্রধান আকর্ষণ বিচিত্র শিল্পানুষঙ্গের প্রদর্শনী। এখানে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা নিজেদের শিল্প নির্মাণ করার জন্য যেমন ব্যবহার করেন শব্দ সম্পাদনার সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, তেমনি ব্যবহার করেন ক্যাম্পের চারদিকে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব উপকরণ। এখানে স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে শিল্পকর্ম নির্মাণে শিল্পীদের উৎসাহিত করা হয়। একইভাবে সিনথেটিক এবং পরিবেশের ক্ষতি করে—এমন উপকরণ ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হয়।

স্থানীয় এবং পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করে এখানে শিল্পকর্ম নির্মাণ করা হয়। ২০১৬ সালের একটি ইনস্টলেশন আর্ট। ছবি: সংগৃহীত

এই আর্ট ক্যাম্পে একদিকে যেমন দেখা যায় প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীদের গৎবাঁধা ফর্ম থেকে বেরিয়ে এসে কাজ করার প্রচেষ্টা, অন্যদিকে লক্ষ করা যায় অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীর নিজস্ব ফরমের কাজ কিংবা একজন স্বভাবশিল্পীর স্থানীয় উপকরণে তৈরি সাদামাটা ইনস্টলেশন আর্টও। প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীদের সঙ্গে চারুশিল্পের জগৎ থেকে বহুদূরের, ভিন্ন জগতের বাসিন্দা কণ্ঠশিল্পী, কবি, ফটোগ্রাফার কিংবা থিয়েটার অ্যাকটিভিস্টদের বিভিন্ন শিল্পকর্ম একই সারিতে প্রদর্শিত হয় এখানে, আর্ট ক্যাম্পের প্রথাগত ঢং ভেঙে। ফলে অংশগ্রহণকারী সবাই নিজেদের বিভিন্ন শিল্পানুষঙ্গ এবং পুরো আয়োজনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। সৃজনে মগ্ন হন।

২০১৮ সালের ১২তম ক্যাম্পে ইন্দোনেশিয়ার শিল্পী আজিজ আমরির পারফরমেন্স। ছবি: সংগৃহীত

ছড়িয়ে পড়ার গল্প
ক্র্যাক আর্ট ক্যাম্প যে শুধু অনুষ্ঠিত হয়েই চলেছে, তা নয়; এ আর্ট ক্যাম্প আয়োজন এবং পরিচালনার মূল ভাবও ইতিমধ্যে এখানে আসা শিল্পীদের আন্দোলিত করেছে ভীষণভাবে। এ ক্যাম্পের মূল ভাবনার ওপর ভিত্তি করে ইতিমধ্যে কলকাতায় তৈরি হয়েছে ‘কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল পারফরমেন্স আর্ট ফেস্টিভ্যাল’ (কিপাফ)। একাধিকবার ক্র্যাক ক্যাম্পে আসা কলকাতার শিল্পী তপতী চৌধুরী এবং অন্যরা মিলে গড়ে তুলেছেন এটি। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজর্ষি দাশগুপ্ত দিল্লিতে তৈরি করেছেন ‘বিং কমনস’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম। এ ছাড়া এই আর্ট ক্যাম্পে থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে ফিলিপাইনের শিল্পী রাইন স্টোন ২০১৪ সালে ‘ইনভেনটরি ইন্টারন্যাশনাল রেসিডেন্সি’ নামে একটি আয়োজন করেছিলেন। এভাবেই ক্র্যাক আর্ট ক্যাম্প দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বময়।

ক্যাম্পের শেষ দিন ৩০ ডিসেম্বর ক্যাম্পটি দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। আর্ট ক্যাম্প ২০১৯। ছবি: লেখক

পারফরমেন্স এবং সাইট স্পেসিফিক ইনস্টলেশন আর্ট সাধারণত এই দুটি শিল্পমাধ্যমে এখানে কাজ করে থাকেন অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা। এ ছাড়া ভিডিও আর্ট, চিত্রকর্ম, আলো ও শব্দকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্মও করা হয়ে থাকে। তবে এগুলো পুরোপুরি নির্ভর করে প্রতিবছরের নির্দিষ্ট থিমের ওপর।

ক্র্যাক আন্তর্জাতিক আর্ট ক্যাম্প গত ১৩ বছরে বাংলাদেশের শিল্পজগতে তৈরি করেছে নিজস্ব ধারা। ‘শিল্পের জন্য শিল্প’—এই প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে এসে আর্ট ক্যাম্পের আয়োজকেরা ‘মানুষের জন্য শিল্প’ ধারণাটির চর্চা করে চলেছেন নিজেদের মতো করে। ঔপনিবেশিক শিল্পশিক্ষার বৃত্তবদ্ধ ও গৎবাঁধা ধারণার বাইরে সৃজনে ও মননে নিরীক্ষা চলমান এখানে—ভাষা ও ভিসার দূরত্বকে সরিয়ে রেখে সযত্নে।