Thank you for trying Sticky AMP!!

গরম যদি মন্দ তবে

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

কালো যদি মন্দ তবে—হ্যাঁ, কথা ওই—গরম যদি মন্দ তবে ঠান্ডা চায়ে নারাজ ক্যানে? এই দুমুখো ব্যাপার তো মেনে নেওয়া যায় না। দুর্মুখেরা বলেন, মানুষের স্বভাবই এই—স্বভাবগতভাবেই সে দ্বিমুখী, চিন্তায় বহুমুখী, স্বার্থে একমুখী। লালন বহু আগেই গেয়ে গেছেন, ‘তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা মন জানো না...।’

এটা কোনো কথা হলো? যেখানে হনুমান চ্যালেঞ্জ ছুড়ে, এক থাবায় বুক চিরে দেখিয়ে দিচ্ছে তার মধ্যে রাম-সীতা ছাড়া কেউ নেই, সেখানে আমরা চ্যালেঞ্জটাই নিতে পারছি না! গরমে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায়। আর ভেতর থেকে কেউ একজন ফিসফিস করে, ‘কুল! কুল!’

বললেই হলো, এই গরমে এয়ারকুলার ছাড়া কুল মিলছে কোথায়? উল্টো দেশি কুলও হাইব্রিডের পাল্লায় জাত-কুল খুইয়ে বসে আছে! গোদের ওপর বিষফোঁড়া এই গরম। কুলকুল করে ঘামাচ্ছে। সব দেখেশুনে থার্মোমিটারে মেজাজের পারদ নামছেই না।

মানছি, আমরা অসহিষ্ণু। পরমতসহিষ্ণু আমরা নই। তর্কে পাহাড় ঠেলি। কথায় কথায় তেতে ওঠা, উঠতে উঠতে ডালিমের মতো ফেটে পড়া—শেষে মেজাজ হারিয়ে মাথা ফাটিয়ে কোন পথে ধাই কে জানে! দুর্মোচ্য এই বিশেষণ অনেক দুর্ভোগের কারণও বটে। তাতে ঢোলে বাড়ি দিচ্ছে এই বে-শরম গরম!

ঘরের বউ থেকে অফিসের বস, কাঁচাবাজার থেকে কালোবাজার, পাতি নেতা থেকে দলনেতা, পুলিশ থেকে পাবলিক—রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে—সবাই তেতে আছে। ভূতল থেকে ভূপৃষ্ঠ একই অবস্থা। দুরবস্থা বলাই শ্রেয়—শ্রীহীন ধরণি এই গরমে!

এর মধ্যে অসহিষ্ণু হওয়া ভদ্রলোকের মানায় না। ভদ্রলোক? এই টেম্পারেচারে বংশাচার রক্ষার উপায় আছে? নেচারটাই তো খাপ খাচ্ছে না। এয়ারকন্ডিশন্ড শপিংমলে মানুষ ঢুকছে। অথচ ক্যাশবাক্স গড়ের মাঠ। বিক্রেতা ঝিমুচ্ছে। ক্রেতা ঘুরে ঘুরে শরীর জুরোচ্ছে। সেলিব্রেটিদের কত্ত ফ্যান! তাতেও এখন তিতিবিরক্ত ভাব—বাতাস দেয় না যে! যখন-তখন প্রাণ হাঁফিয়ে উঠছে। লাফিয়ে বাড়ছে চার্জেবল পণ্যের দাম। খামারি মুরগিকে খাওয়াচ্ছে বরফকুচি। কে জানে সেদ্ধ ডিম পাড়লে আর রক্ষা নেই! শুনেছি ভয় পেলে নাকি শরীর ঠান্ডা হয়। এই আশায় হরর ফিল্ম দেখবেন, সেখানেও গুড়েবালি। গরম আর লোডশেডিং—হরিহর আত্মা।

ওদিকে ধৈর্য হারিয়ে হারান প্রামাণিক ছেলেকে নিয়ে এসেছেন উকিলের কাছে। এসপার–ওসপার করেই ছাড়বেন। এফিডেভিট করে ছেলের নাম পাল্টাবেন। উকিল নাক টেনে চশমা নামিয়ে বললেন, ‘কী কারণ?’

‘ওই লোডশেডিংই হইল কারণ।’

‘স্ট্রেঞ্জ!’ উকিল ভ্রু নাচিয়ে ছেলেটির দিকে তাকান, ‘তোমার নাম কী?’

ছেলে এমনিতে চটপটে। একবার মা আঁচল দিয়ে ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে ‘উফ্! গরমে পুড়ে যাচ্ছি’ বলায়, সে একদৌড়ে ঘর থেকে বার্নল ক্রিম এনে দিয়েছিল। সে জানে বার্নল কাটা–পোড়ায় সমান কার্যকর। কিন্তু উকিলের কাছে তার কী কাজ তা এন্টেনায় ধরছে না।

ছেলে চুপ করে আছে দেখে খেঁকিয়ে উঠলেন হারান প্রামাণিক, ‘নাম কস না ক্যান, শরম লাগে?’ উকিলের দিকে ফিরে নিজেই বললেন, ‘অর নাম বিদ্যুৎ।’

কবি পূর্ণেন্দু পত্রী ছিলেন লোডশেডিংয়ের পক্ষে। তিনি বলছেন, ‘হে সময় অশ্বারোহী হও/মাঝে মাঝে লোডশেডিং হোক’। তিনিই আবার ‘কথোপকথন’-এ বলছেন, ‘পরের জন্মে দশদিগন্তের অন্ধকার হব আমি।’ কোন অভিপ্রায়ে তিনি অন্ধকার হবেন কবিতাপ্রিয় পাঠকের অজানা নয়। অথচ অলাত তরুণ কবি। অতলার প্রেমে ডুবে আছেন। অতলা নানা ছলে ঘনিষ্ঠ হতে চাইলে এই গরমে তিনিই এখন গরম তেলে পাঁচফোড়নের মতো ছিটকে উঠছেন—কী, হচ্ছে কী?

যে পুরুষ অফিসে বেলের মতো—বাইরে শক্ত, ভেতরে নরম। স্ত্রীর সামনে সে-ই আইসক্রিম—গলে গলে পড়ে। স্ত্রী যত সূর্যের মতো তেতে ওঠে, সে তত গলে। তাতেও বেচারা মন পায় না। উল্টো তার ঘেমে যাওয়া দেখে স্ত্রী হেসে ওঠেন—তুমি মাত্র ছত্রিশেই গলে যাচ্ছ? হায় হায়! তোমার গলনাঙ্ক মাত্র ছত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। স্বামী বেচারা কিন্তু সিরিয়াস। সংসারের অভিজ্ঞতা অথবা এই গরম—তাকে সিদ্ধ পুরুষ বানিয়ে ছেড়েছে। শুধু দামটাই বাড়ায়নি।

গরমেরও রকমফের আছে। কেউ সম্মান পেতে দেখায় টাকার গরম, প্রেমের জন্য রূপের গরম, চাকরির জন্য মামার গরম, বাঁচার জন্য ক্ষমতার গরম, ছিনিয়ে নিতে শক্তির গরম, আবার কেউ প্রতিপক্ষকে বিপদে ফেলতে কূটবুদ্ধির গরমও দেখায়। চোরের মার যেমন বড় গলার গরম, তেমনি এই সংসারে অক্ষমের গরম আরও বেশি। শরম ভুলে ওই গরমটুকুই তার রক্ষাকবচ—বেঁচে থাকার ব্রহ্মাস্ত্র।

কথায় বলে, খালি কলস বাজে বেশি। আবার সূর্যের চেয়ে বালির গরমও কম নয়। বলিহারি এই সংসার! নিয়মের এত অনিয়ম দেখে পৃথিবীটাও গরম হয়ে উঠছে। ধরণির ধড় শুকিয়ে আমসত্ত্ব। বৈশাখেও বৃষ্টির দেখা নেই। ১৬ কোটি চাতকের শুরু হয় বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা। গানের অনুষ্ঠানে লাইভ কল, ‘ভাই, “আল্লাহ মেঘ দে পানি দে” গানটা শুনতে চাই।’

ওপরওয়ালা যখন দেন ছাপ্পর ফেড়ে দেন। চাই বৃষ্টি, দেন ঘূর্ণিঝড়। দেখান বাতাসের গরম। এবার শুরু হয় ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার প্রস্তুতি। বাড়ে আতঙ্ক। একসময় ঝড় থামে। পরদিন পত্রিকার পাতায় লাল কালির হেডিং—কেউ বলে, ফণী এল ফণা তুলে, কেউ বলে, ফণী তোলেনি ফণা।

রেস্টুরেন্টে চায়ের কাপে পুনরায় ঝড় ওঠে। পরিবেশ গরম হতে থাকে। ঠান্ডা হয়ে যাওয়া অপাঙ্​ক্তেয় ডালপুরি মুচকি হেসে বলে, গরম যদি মন্দ তবে...।