Thank you for trying Sticky AMP!!

ছাপা বই থাকবেই

কাগজে ছাপা বইয়ের দিন কি শেষ? প্রযুক্তির বদলের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে ই–বুক, বইয়ের রূপ ও গড়নে এসেছে পরিবর্তন। তবে সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন গবেষণা ও পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। এ বিষয়ে তারা দিচ্ছে কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য–উপাত্তও। ছাপা বইয়ের ক্ষেত্রে জাগছে আশাবাদ। ছাপা বই ও ই–বুকের কড়চা এবারের প্রতিবেদনে।

বিগত বছরগুলোতে মানুষের জীবন একেবারে পাল্টে দিয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি। সেই সঙ্গে বদলে গেছে তার ভাব প্রকাশের ধরনও। বদল এসেছে হাজার বছর ধরে চলে আসা পাঠের অভ্যাসে। বিশাল বইয়ের আলমারি এখন সে পকেটে নিয়ে বেড়াতে পারে। কিন্তু আসলে সেটা কাগজে ছাপা বইয়ের চিরচেনা জগৎকে কতটা বদলে দিয়েছে? ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক বুক কি সম্পূর্ণ উৎখাত করে দেবে ছাপা বইকে? এ বিষয়ে বিশ্বজোড়া বইয়ের বাজারের পরিসংখ্যান কী বলছে? ডিজিটাল বই কি আমাদের পাঠ আর বোঝার প্রক্রিয়ায় একেবারে ছাপা বইয়ের মতোই কাজ করে? প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার আগে হোর্হে লুইস বোর্হেসের ‘বাবেলের লাইব্রেরি’ গল্পের কথা মনে করুন। পুরো মহাবিশ্বই সেখানে একটা লাইব্রেরি, যেখানে অসংখ্য ছয় দেয়ালের ঘর। এক দেয়ালে ঘরে ঢোকার দরজা, আরেক দেয়ালে বাঁচার জন্য ন্যূনতম সরঞ্জাম, আর বাকি চার দেয়ালে শুধুই বই। বইগুলো এলোমেলো অর্থহীনভাবে সাজানো। তবে জগতের সব বই যেহেতু এখানে রয়েছে, তাই অর্থপূর্ণ বইগুলোও নিশ্চয়ই এর ভেতরেই কোথাও লুকিয়ে আছে। বইয়ের এত প্রাচুর্যের কারণেই সব বই এখানে পাঠকের কাছে অর্থহীন হয়ে আছে। আর এ কারণে এই লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক অসীম হতাশায় ডুবে থাকেন। সব বই এখানে পাওয়া যায়। তাই কোনো আশাবাদী সারা জীবন খুঁজে ফেরেন সেই বই, যেখানে মহাবিশ্বের সব বইয়ের গোছানো তালিকা দেওয়া আছে। 

মোদ্দা কথা, আমাদের চারপাশের বাস্তব আপাত অসীম এ জগতে মানুষ যা কিছু দেখে এসেছে এবং অনূভব করেছে, সেগুলো সে লিপিবদ্ধ করে রেখেছে বইয়ের মধ্যে। সেই বই মানুষকে তার রূপ নিয়ে বিস্মিত–বিহ্বল করেই চলেছে। 

বইয়ের যে যুগ গেছে...

পনেরো শ শতাব্দীতে ইউরোপে জার্মানির গুটেনবার্গের ছাপা মেশিন আবিষ্কার বড় একটা পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। এর কয়েক শ বছরের মধ্যেই আমজনতার মধ্যে বই পড়ে মনোরঞ্জনের নিয়ম চালু হয়ে গেল। তখনকার পণ্ডিত সমাজে এ নিয়ে পড়ে গেল হাহাকার। ভাবা যায়, মানুষ সব সৃষ্টিশীল কাজ ছেড়ে দিয়ে শুধু অন্যের লেখা পড়ে সময় কাটাচ্ছে! এরও আগে যখন লেখার কায়দা প্রচলন পাচ্ছিল, তখনো অনেকে এই আশঙ্কা করেছিলেন যে মানুষ নিজের স্মৃতিশক্তি কাজে লাগানো ভুলে যাবে। বই না থাকলে তখন কী হবে? সবচেয়ে ভালো তো নিজেই সব মনে রেখে বইয়ের ওপর নির্ভরশীল না থাকা। প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটেছিল বাংলাতেও—আমাদের বাংলা ভাষার জগতে মোহিতলাল মজুমদার ‘পুঁথির প্রতাপ’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। একসময় জগতের জ্ঞানী ব্যক্তিরা সারা জীবনের সাধনা একটি বা দুটি পুঁথিতে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। তাঁর মনে হয়েছিল ছাপা বই আজকাল খুব সহজে তৈরি করা যাচ্ছে। এর ফলে অনেক অপ্রয়োজনীয় আর অপাঠ্য লেখা গ্রন্থে রূপ নিতে পারে।

এসব অতীত পার হয়ে বইয়ের জগৎ বর্তমানে হাজির হয়েছে নতুন এক পর্বে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এত দিন ধরে আমরা যে রূপে বইকে চিনে এসেছি সেটা কি আর থাকবে? সোজা কথায়, ছাপা বই কি আর থাকবে?

ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর আমেরিকার ২৩টি দেশে ছাপা বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে জরিপ হয়েছে তাতে দেখা গেছে, ছাপা বইয়ের ভবিষ্যৎ খুবই ইতিবাচক। ছবি: আবদুস সালাম

বিনা কালির লেখা

১৯৯৩ সালে পিটার জেমস তাঁর হোস্ট নামের উপন্যাসটি দুটো ফ্লপি ডিস্কে প্রকাশ করেন। এ ঘটনায় চারদিকে ঝড় উঠে গিয়েছিল। সেই ঝড় পিটারের পক্ষে ছিল না। খবরের কাগজের একজন প্রতিবেদক তো সমুদ্রসৈকতে জেনারেটর আর তাঁর ডেস্কটপ কম্পিউটার নিয়ে ফ্লপিতে ছাপানো বই পড়তে লাগলেন। তিনি বলতে চাচ্ছিলেন, তাহলে কি এভাবেই এখন থেকে বই পড়তে হবে? পিটার তখনই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, একদিন ই–বুক ছাপা বইয়ের মতোই সহজলভ্য হবে আর একে আরাম করে পড়ার উপায়ও এসে যাবে। তাঁর কথা সত্য হয়েছে। সে সময় শ্লেষ করছিলেন যাঁরা, তাঁরা জানতেন না এটি একদিন ছাপা বইয়ের অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে পারে।

১৯৭০–এর দশকে প্রজেক্ট গুটেনবার্গ ইলেকট্রনিক টেক্সট ফাইল প্রকাশ শুরু করে। ’৮০ ও ’৯০–এর দশকে ভয়েজার আর ইস্টগেট সিস্টেমের মতো কোম্পানি আরও উন্নত প্রযুক্তিতে প্রকাশ করতে থাকে ইলেকট্রনিক বই। এ জন্য বাজারে আসে আলাদা ডিভাইস। আগে উল্লেখ করা পিটার জেমস সেই সময়ের সবচেয়ে অগ্রসর সাতটি কোম্পানির কাছে গিয়েছিলেন ইলেকট্রনিক বই ছাপার প্রস্তাব নিয়ে। এক বাক্যে সবাই বলেছিল ‘না’; তাদের যুক্তি, মানুষ কোনোদিন পর্দায় বই পড়বে না। কিন্তু ২০০৭ সালে এমাজন নিয়ে এল ‘কিন্ডল’ নামে বই পড়ার যন্ত্র। বই সম্পর্কে এত হাজার বছরের ধারণা বদলে গেল রাতারাতি। এতে কেঁপে উঠল ছাপা বইয়ের গোটা ইন্ডাস্ট্রি। এখানে সস্তায় ছাপা বইয়ের লেখা পৃষ্ঠা ওল্টানোর ভার্চুয়াল স্বাদসহ হাতে পাওয়া যায়। আর আমাজন পুরো দুনিয়ার ক্রেতার কাছে যেতে পারে নিমেষেই। ফলে প্রতিটি বইয়ে তার খুব অল্প লাভ করলেও চলে।

২০১৩ সালের মধ্যে প্রাপ্তবয়ষ্ক মার্কিনদের অর্ধেকের হাতে উঠে এল ট্যাবলেট বা ই-বুক রিডার। জানা গেল, ওই বছরই প্রতি দশজনের তিনজন একটা করে ই-বুক পড়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস–এর প্রতিবেদনে জানা গেল যে ২০০৮ থেকে ২০১০–এর মধ্যে ই-বুকের বিক্রি বাড়ল ১ হাজার ২৬০ শতাংশ! এবার স্বাভাবিকভাবেই এল প্রশ্ন, কাদায় লিখে পোড়ানো বই, ভুর্জপত্রের পুথির আর কাঠের ব্লকে ছাপার মতো কাগজে ছাপা বইও কি শখের জিনিস হয়ে রয়ে যাবে?

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ই–বুক পড়ার ফলে লেখার ভেতরে আমাদের প্রবেশের ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

ই-বুকের কালো দিক

মারিয়ান উলফ ম্যাসাচুসেটসের টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর রিডিং অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ রিসার্চের পরিচালক। ২০০৮ সালে বই পড়া নিয়ে একটা গবেষণা করেছেন তিনি। বিষয়: ছাপা বই আর অন্য ধরনে, ভিন্ন মাধ্যমে বই পড়া—এই দুই পাঠের মধ্যে কীভাবে কাজ করে মানুষের মস্তিষ্ক। তাঁর ভাবনা হলো, পাঠকের স্বার্থেই যেন হারিয়ে না যায় কাগজের বই। এমন ভাবনার পেছনে শক্ত যুক্তিও আছে তাঁর। মারিয়ান ও তাঁর সহগবেষকেরা গবেষণা করে দেখিয়েছেন, কাগজে ছাপা এবং ইলেকট্রনিক উপায়ে ছাপার মধ্যে মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন হয়। পড়ে বোঝা, মনোযোগ দেওয়া, লেখার বিষয়, ধারাবাহিকতা, ঘটনা ধরে পাঠকের এগোনোর ক্ষেত্রে দুই মাধ্যমের পাঠে দু–রকমভাবে কাজ করে মানুষের মস্তিষ্ক। সেন্টার ফর রিডিং অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ রিসার্চের গবেষণায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে কাগজ ও ইলেকট্রনিক পাঠে আমাদের মস্তিষ্কের দুই অংশ কাজ করে। এদের মধ্যে আবার তফাত অনেক। কাগজের লেখায় সে নিবিষ্ট হয়, কিন্তু ইলেকট্রনিক পাঠে সে থাকে বিক্ষিপ্ত। আর কিন্ডলের মতো আলো বিকিরণ না করা পাঠ এই দুইয়ের মাঝামাঝি কোথাও থাকে। এ ক্ষেত্রে অধ্যাপক মারিয়ানের বক্তব্য হলো, ‘ই–বুক পড়ার ফলে লেখার ভেতরে আমাদের ঢোকার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এটি দুশ্চিন্তার ব্যাপার। ভয়ের বিষয় হচ্ছে, পড়ার পর আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে যে কাজ হতো, তার ব্যাপ্তি কমে যাচ্ছে। সে এখন তথ্য জড় করতে খুব দক্ষ, কিন্তু সেই পাঠের পর জটিল, বিশ্লেষণী গভীর অনুধাবনের ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।’ এর আগে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল ২০১৫ সালে গবেষণা করে দেখিয়েছে যে রাতে ঘুমানোর আগে আলো বিকিরণকারী পর্দায় পাঠ করা আমাদের ঘুমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

জোয়ারে ভাটা

২০১৬ সালে বুক ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি প্রতিষ্ঠান জানাল, বাজারে আসার পর প্রথমবারের মতো বিক্রি কমেছে ই-বুকের, অথচ ছাপা বইয়ের বিক্রির হার বেড়েছে। ২০১৭–এর পয়লা মে নিউইয়র্ক ডেইলি নিউজ–এর তথ্যমতে, ২০১৬–তে ইংল্যান্ডে ই-বুকের বিক্রি কমেছে ১৭ শতাংশ, আর আমেরিকায় ১৯ শতাংশ। অন্যদিকে আমেরিকায় ছাপা বইয়ের বিক্রি বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ। এ ছাড়া সেখানে শক্ত মলাটের বইয়ের বিক্রি বেড়েছে ৪ শতাংশ, আর শিশুদের বইয়ের বিক্রি এক লাফে বৃদ্ধি পেয়েছে ১৬ শতাংশ। স্টোরা এনসো নামে ইউরোপীয় এক প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালে ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর আমেরিকার ২৩টি দেশে ছাপা বইয়ের ভবিষ্যৎ বিষয়ে একটি জরিপ চালায়। এ জরিপের চাঞ্চল্যকর যে তথ্য সামনে এসেছে তা হলো, ছাপা বইয়ের ভবিষ্যৎ খুবই ইতিবাচক। গবেষণায় অংশ নিয়েছিলেন ছাপা বইয়ের ব্যবসায়ী, ই-বুক ব্যবসায়ী, গবেষক, শিক্ষার্থী ও সাধারণ পাঠক। তাঁদের মাত্র ৮ শতাংশ বিশ্বাস করেন যে ই-বুকের বিস্তৃতি বাড়বে। তাঁরা মনে করেন, ই-বুক, অডিও বুক—এই সব ইলেকট্রনিক বুক ধরাছোঁয়া বইয়ের অনুসঙ্গী হতে পারে, তবে বিকল্প একেবারেই নয়। পরিসংখ্যান বলছে, ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় ই-বুকের বিক্রি বইয়ের মোট বিক্রির ২০ শতাংশ। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এর হার এখন আর ওপরের দিকে উঠছে না, এক জায়গাতেই থমকে আছে। আরও বলার মতো তথ্য হলো, ই–বুক বিক্রির এই হার ছাপা বইয়ের বাজারকে লক্ষণীয়ভাবে বিপদেও ফেলতে পারেনি। অন্যপক্ষে ফ্রান্স ও জার্মানিতে ই-বুক বিক্রি মোট বইয়ের বাজারের ১০ শতাংশের কম। এসব পরিসংখ্যান প্রকারান্তরে যেন এ কথাই বলতে চায়, হাল আমলে ট্যাবলেট বা স্মার্টফোন যেভাবে দুনিয়া দখল করেছে, সেই অনুপাতে ই-বুকের বিক্রি বেশ দুর্বল। আবার পুরোনো প্রজন্মের চেয়ে নতুনেরা ই-বুক বেশি পছন্দ করছে—পরিসংখ্যানে এই আলামতও সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না।

বিষাদে হরিষ নাকি শাপে বর?

বর্তমানে ছাপা বইয়ের বাজারে এক অদ্ভুত প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। নিজের গবেষণায় মারিয়ান উলফ দেখিয়েছেন, মানুষ যতক্ষণ এবং যে পরিমাণে কোনো ডিভাইস বা যন্ত্রের পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকে, সেই একই পরিমাণে সে তার চোখ আর মস্তিষ্ককে আলো থেকে দূরে রাখতেও চায়। শরীর চায় এই আলো আর না-আলোর মাঝখানে একটা ভারসাম্য রাখতে। মনস্তাত্ত্বিক এই বিষয় স্বভাবতই ছাপা বইয়ের বিক্রিকে গতিশীল করতে ছাপ ফেলছে। আর সবকিছু যত ডিজিটাল হচ্ছে, ছাপা জিনিসের কদর তত বাড়ছে—এটি গবেষণালব্ধ সত্য। ছাপা বইয়ের স্পর্শ ভিন্ন এক অনুভূতি দেয়। কখনো এটি অভিজ্ঞতা, কখনোবা স্মৃতি, কখনো আবার ভালোবাসা। সেই কাগজ, মলাট, সেই বই হাতে আসার ইতিহাস—এই সবকিছু পাঠকের অনুভূতি মাত্র নয়, এগুলো বাজারে প্রভাব ফেলার বড় উপাদানও বটে।

মানুষ যা পড়ে তা দেখাতেও চায়। যা পড়লাম তার একটা চিহ্ন পাঠক নিজের মাথা আর যন্ত্রের বাইরেও রাখতে ভালোবাসে। বই তার ঘর সাজাতে পারে। পাঠকের অস্তিত্বের, জীবনের বাহ্যিক স্পর্শযোগ্য পরিচয় হলো বই। অনেকে এমনও বলেন, কোনো পাঠকের বইয়ের সংগ্রহ দেখলে বোঝা যায় মানুষ হিসেবে তিনি কেমন। তবে ডিজিটাল বই কি আবার ছাপা বইয়ের কদর বোঝাতে ‘শাপে বর’ হয়ে এল? 

কেন এখনো বেশি বিক্রি হয় ছাপা বই?

মার্কিন দেশে ২০১৮ সালে সব রকমের বইয়ের মোট বিক্রি ছিল ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ছাপা বইয়ের বিক্রি ২ হাজার ২৬০ কোটি ডলার। এই হিসাব পাওয়া গেছে অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকান পাবলিশার্সের বার্ষিক ২০১৯–এর প্রতিবেদনে। ইংল্যান্ডে বইয়ের সবচেয়ে বড় খুচরা বিক্রেতা ওয়াটারস্টোন ২০১৬ সালেই ই-বুক বিক্রির ব্যবসা বন্ধ ঘোষণা করেছে। কারণ আর কিছু নয়, ই-বুক বিক্রির বাজারের ধস। এই একই বছরে মার্কিন ই-বুক বিক্রেতা বার্নেস অ্যান্ড নোবেল ইংল্যান্ডে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে, তাদের বিক্রি এক তৃতীয়াংশ কমে যাওয়ার পর। আর কাগজের বইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ২০ বছর পর ২০১৫ সালের নভেম্বরে এমাজন বাধ্য হয়েছে কাগজের বই বিক্রির দোকান খুলতে। 

গত কয়েক বছরে প্রকাশকদের প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে এটি স্পষ্ট যে বাংলাদেশেও বেড়েছে ছাপা বইয়ের িবক্রি।

ডিজিটাল জগতের আগেও অন্য অনেক মাধ্যমের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে বিস্তর। যেমন, টেলিভিশন আসার পর বলা হলো, রেডিওর দিন শেষ। কিন্তু তা বেঁচে থাকল নতুন পথ উদ্ভাবন করে—গাড়িতে, ট্রেনে ও কারখানায়।

ছাপা বই কি মরে যাবে?—প্রশ্নটিও নতুন নয়। সেই ১৮৯৪ সালের দিকেই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, ফোনোগ্রাফের সঙ্গে পেরে উঠবে না বই, হারিয়ে যাবে। এরপর আলোকচিত্র, রেডিও, টেলিভিশন, ওয়েবের বর্ণিল জগৎ আর স্মার্টফোন—সবাই এসেই একবার করে বলেছে, ‘গুডবাই প্রিন্টেড বুক, ছাপা বইয়ের দিন শেষ।’

ডিজিটালের দাপটে সংগীতশিল্পের মতো অনেক শিল্প যখন এলোমেলো হয়ে গেছে, তখনো হাতে ধরে স্পর্শ করা যায়—এমন ছাপা বইকেই ভালোবাসছে মানুষ। অপরাধ সাহিত্য, রোমান্টিক ধাঁচের লেখা ই-বুকে কিছু পড়লেও গবেষণা ও প্রকৃতি–সংক্রান্ত লেখা, ভ্রমণ বা রান্নার বই নিয়ে একচেটিয়াভাবে মানুষ ছাপা বইয়ের ভক্ত। সম্প্রতি এটি বলেছেন ইংল্যান্ডের বুকসেলারস অ্যাসোসিয়েশনের ব্যবস্থাপক পরিচালক মেরিল হোল। একই সঙ্গে জানিয়েছেন, ‘আমার মনে হয় ই-বুক নামের বুদবুদ ফেটে গেছে। এর বিক্রির পরিমাণ পড়েছে থমকে। যা হাতে ধরা–ছোঁয়া যায় তার আবেদনই অন্য রকম।’

 সত্য যে মানুষের মনে তথ্যের জন্য ক্ষুধা আছে। আবার ই–বুকের যান্ত্রিক চৌকোনো পর্দার ভেতর সে হাঁপিয়েও ওঠে। ফলে মানুষ যেমন শহর এবং কাজ ছেড়ে ভ্রমণে বের হয়, তেমনি সে ফিরে আসে ছাপা বইয়ের কাছে। সে চায় এমন কিছু যা কেবল নীরস তথ্যের উৎস হবে না, একই সঙ্গে তার আবেগও ধারণ করবে। এমন প্রসঙ্গে বোধ হয় অনেকের মনের কথাই বলেছেন রে ব্রাডবেরি। বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত মার্কিন লেখকদের অন্যতম রে ব্রাডবারি মোটেই ই-বুকের পক্ষপাতী ছিলেন না। ২০১০ সালে প্যারিস রিভিউ–এর ১৯২তম সংখ্যায় এক সাক্ষাৎকারে ই-বুক, কিন্ডল নিয়ে তাঁর কথা ছিল, ‘এগুলো বই না। আপনি বইয়ের মতো করে এদের ধরতে পারবেন না। এগুলোতে বইয়ের গন্ধ নেই। বইয়ের মধ্যে দুই রকমের গন্ধ পাওয়া যায়। নতুন বইয়ের গন্ধ চমৎকার। পুরোনো বইয়ের গন্ধ আরও ভালো, প্রাচীন মিসরের মতো। বইয়ে গন্ধ থাকতে হবে।...বই আপনার সঙ্গে চিরকাল থাকবে। আমি দুঃখিত যে কম্পিউটার সেটা পারে না।’ 

ছাপা বইয়ের দিন শেষ—এভাবে সরল করে বলা কথাটি আসলে একটা মিথ। আবার নতুন দিনের ই-বুক প্রযুক্তি যে সম্ভাবনা হাজির করেছে তাকেও একেবারে অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। কিন্তু মানুষের জ্ঞান আর ভাবনাজগতের কাছে, প্রজন্মের পর প্রজন্মের সামনে ছাপা বই নিজের যে শক্তি দেখিয়েছে, ডিজিটাল জগৎ তাকে এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। ফলে এই দুইয়ের মিলনেই সামনের ভবিষ্যৎ। তবে সেখানে কাগজের বইয়ের পাল্লাই বেশি ভারী।